■ নাগরিক প্রতিবেদক ■
ইতিহাস গড়ে প্রথম মুসলিম ও দক্ষিণ এশিয়ান বংশোদ্ভূত রাজনীতিবিদ হিসেবে নিউইয়র্কের মেয়র হলেন জোহরান মামদানি। ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী ৩৪ বছর বয়সী মামদানি নিউইয়র্ক সিটির ১১১তম মেয়র নির্বাচিত হলেন।
গত একশত বছরেও বেশি সময়ের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে শহরটির মেয়রের চেয়ারে বসছেন মামদানি। এতদিন নিউইয়র্ক ও যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ মেয়র খেতাব ছিল হিউ জে গ্রান্টের, যিনি ১৮৮৯ সালে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন।
ভোটের প্রাথমিক ফলাফলে জোহরান মামদানি ১০ লাখ ৩৫ হাজার ৬৪৬ ভোট (৫১ শতাংশ), অ্যান্ড্রু কুয়োমো ৮ লাখ ৫৪ হাজার ৭৮৩ ভোট (৩৯ শতাংশ) এবং কার্টিস স্লিওয়া ১৪ হাজার ৬২৬ (৭.১ শতাংশ) ভোট পেয়েছেন। নিউইয়র্ক সিটি বোর্ড অফ ইলেকশনস জানিয়েছে- পাঁচ দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে এবার ভোটার উপস্থিতি ছিল সর্বোচ্চ।
মেয়র নির্বাচিত হয়ে মামদানি ধন্যবাদ জানালেন তাঁর স্ত্রী ও মা–বাবাকে।
নির্বাচনে জয়ী ঘোষণার পর আবেগঘন এক ভাষণে জোহরান তাঁর মা-বাবা ও স্ত্রীর প্রতি শ্রদ্ধা জানালেন।
জোহরান মা-বাবাকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আজ আমি যে মানুষ হয়েছি, তা তোমাদের জন্যই। তোমাদের সন্তান হতে পেরে আমি গর্বিত।’
স্ত্রী রামাকে উদ্দেশ করে জোহরান বলেন, ‘এই মুহূর্তে ও জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে তোমাকে পাশে পেতে চাই। এটাই আমার সবচেয়ে প্রিয় মুহূর্ত।’
৫৫ বছর বয়সী আইনজীবী অ্যালেক্স লরেন্স বলেন, “প্রাইমারিতে আমি মামদানিকে ভোট দিইনি। পরে ভেবে দেখেছি, তার কথাবার্তায় ইতিবাচকতা আছে, সততা আছে। আমি তাকে সুযোগ দিতে চেয়েছি।”
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ড্রাইভার ইফতেখার খান বলেন, “এই নির্বাচনে মুসলিম ও দক্ষিণ এশীয় ভোটারদের ঐক্যই মামদানির বড় শক্তি। ২০০১ সালের ৯/১১ হামলার পর যেভাবে মুসলিমরা বৈষম্যের শিকার হয়েছিলেন, সেই বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে তার জয় আমাদের জন্য এক নতুন সূচনা।”
যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় মঙ্গলবার সকাল ৬টা থেকে শুরু হয়ে ভোট চলে রাত ৯টা পর্যন্ত মেয়র নির্বাচনে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। শেষ মুহূর্তে নির্বাচনে আসে নাটকীয় মোড়। ডেমোক্রেটিক দলের প্রার্থিতার দৌড়ে জোহরান মামদানির কাছে হেরে গিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া অ্যান্ড্রু কুয়োমোকে সমর্থন জানান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁর দল রিপাবলিকান পার্টি কার্টিস স্লিওয়াকে প্রার্থী করেছে। ট্রাম্পের সমর্থনের কারণে রিপাবলিকান ভোটাররা কুওমোর দিকে ঝুঁকতে পারেন, যা নতুন এক সমীকরণ দাঁড় করাতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছিল।
নিউইয়র্কের নির্বাচন শেষ পর্যন্ত মামদানি বনাম ডোনাল্ড ট্রাম্পের লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে। এদিন সকালেই কুইন্সের অ্যাস্টেরিয়ার আর্টস হাই স্কুল কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেন মামদানি। সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্ত্রী রামা দুয়াজি। ভোট দিয়েছেন কুয়োমো এবং স্লিওয়াও। তিন প্রার্থীর ভাগ্য নির্ধারণী এ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। এর আগে আগাম ভোট দেন নিউইয়র্কের সাত লাখ ৩৫ হাজার বাসিন্দা, যা গত রোববার শেষ হয়। এ ভোটের হার ২০২১ সালের নির্বাচনের চেয়ে চার গুণেরও বেশি।
৮৪ লাখেরও বেশি জনসংখ্যার এই শহরে তার এই জয় ইতিহাস গড়ল। অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই শহর এবার পেল এক নতুন নেতৃত্ব।
তবে নিউইয়র্কের মানুষ তার ধর্ম বা জাতিগত পরিচয়ের জন্য নয়, বরং তার মূল বার্তা—‘সাশ্রয়ী জীবনযাপন’—এর জন্যই তাকে সমর্থন করেছেন। মামদানি নিজেকে ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী’ হিসেবে পরিচয় দেন।
তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুয়োমো, যিনি এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়েছিলেন। কুয়োমো ভোটের দিনে বলেন, ‘ডেমোক্রেটিক পার্টির মধ্যে এখন এক ধরনের গৃহযুদ্ধ চলছে। সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার এক দল আছে, যারা মাঝারি অবস্থানের ডেমোক্র্যাটদের চ্যালেঞ্জ দিচ্ছে।’
ব্রঙ্কসের জোশুয়া উইলসন বলেন, ‘ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় প্রেসিডেন্সির পর থেকে রাজনীতি অনেক বেশি তীব্র হয়েছে। নতুন তরুণদের উঠে আসা অনেকেই ভয় পাচ্ছে। কিন্তু মামদানী এই পরিস্থিতিতে এক নতুন কণ্ঠ।’
শেষ মুহূর্তে ট্রাম্প কুয়োমোকে সমর্থন দিলেও তা উল্টো ফল দেয়। এমনকি কুয়োমোর আগের সমর্থকরাও এবার মামদানীর পক্ষে ভোট দেন।
মামদানীর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলোর মধ্যে আছে বিনামূল্যে বাস সেবা, সার্বজনীন শিশু যত্ন এবং ভাড়ার সীমা নির্ধারণ। তিনি বলেছেন, বড় কর্পোরেশন ও ধনীদের ওপর কর বাড়িয়ে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবেন।
তবে সামনে তার জন্য চ্যালেঞ্জও কম নয়। মধ্যপন্থীদের সমর্থন ধরে রাখা এবং প্রগতিশীলদের প্রত্যাশা পূরণ – দুই দিকই সামলাতে হবে তাকে।
অবশ্য প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনের ভোটগ্রহণের কয়েক ঘণ্টা আগে কুয়োমোকে সমর্থন ঘোষণা দিয়েছিলেন। রক্ষণশীল ভোটারদের একত্রিত করার উদ্দেশ্যে এই ঘোষণা দেওয়া হলেও তা উল্টো ফল দেয় বলে মনে করা হচ্ছে।
কুয়োমো নিউইয়র্কের সাবেক মেয়র। তাঁর বিরুদ্ধে যৌন হেনস্তার নানা অভিযোগ রয়েছে। তিনি শহরটির মেয়র থাকাকালে সেখানকার আদালতে ট্রাম্পের মামলা চলে। এ নিয়ে ট্রাম্প বিভিন্ন সময় সরাসরি অ্যান্ড্রু কুয়োমো সমালোচনা করেছেন। কিন্তু অনেকটা ইউটার্ন নিয়ে শেষ মুহূর্তে ট্রাম্প সামাজিক মাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে লেখেন, ‘আপনি ব্যক্তিগতভাবে কুয়োমোকে পছন্দ করেন বা না করেন, আপনার সামনে আর কোনো পছন্দ নেই। আপনাকে অবশ্যই তাঁকে ভোট দিতে হবে। আশা করি, তিনি চমৎকার কাজ করবেন। আর তিনি এটা করার সামর্থ্য রাখেন, মামদানি নয়।’
বিবিসি জানায়, ট্রাম্পের সমর্থনের কড়া জবাব দিয়েছেন মামদানি। তিনি বলেন, কুওমোকে সমর্থন করেছেন ট্রাম্প ও তাঁর দলের লোকজন। তিনি নিউইয়র্ক সিটি বা নিউইয়র্কের বাসিন্দাদের সেরা মেয়র হবে না, তিনি হবেন ট্রাম্প ও তাঁর প্রশাসনের সেরা মেয়র।
জোহরান মামদানি জিতলে কেন্দ্রীয় তহবিল বন্ধ করে দেবেন বলেও ঘোষণা দেন ট্রাম্প। এর আগে গত রোববার এক সাক্ষাৎকারে তিনি তহবিল বন্ধের হুমকি দেন। তখন তিনি বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিউইয়র্ককে অধিক অর্থ দেওয়া আমার পক্ষে কঠিন হতে যাচ্ছে।’ এ প্রসঙ্গে মামদানি বলেন, এটা কোনো নিয়ম নয়, হুমকি।
গত সোমবার দুই প্রতিদ্বন্দ্বী জোহরান মামদানি ও অ্যান্ড্রু কুয়োমো শেষ সভা-সমাবেশ করেন। মামদানিকে নিউইয়র্কের অভিবাসীদের পাশাপাশি স্বল্প আয়ের মানুষ সমর্থন জানাচ্ছেন। মঙ্গলবার ভোটকেন্দ্রে এর প্রতিফলন দেখা গেছে। ৪৬ বছর বয়সী শিল্পী অধ্যাপক ম্যাট মার্কেল হেস তাঁর ১১ বছরের ছেলেকে নিয়ে কেন্দ্রে এসে মামদানিকে ভোট দেন। তিনি জানান, ছোট ব্যবসা, ছোট ছোট উদ্যোগের প্রতি মামদানির সমর্থন ও বিনামূল্যে শিশুসেবা দেওয়ার আশ্বাস তিনি খুব পছন্দ করেছেন।
কার্যত মামদানি নিউইয়র্কে স্বল্প আয়ের মানুষের প্রতিনিধিত্ব করছেন। তিনি নিজে অভিবাসী এবং অভিবাসী বাবা-মায়ের সন্তান। তাই নিউইয়র্কের অভিবাসীরা তাঁকে সমর্থন করছেন। মামদানিও তাদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করার অঙ্গীকারের কথা জানিয়েছেন। অন্যদিকে, শহরটির তথাকথিত অভিজাত শ্রেণি কুওমোর পক্ষে।
সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর এটা প্রথম বড় কোনো নির্বাচন। নিউইয়র্ক ছাড়াও ভার্জিনিয়া ও নিউ জার্সি অঙ্গরাজ্যে গভর্নর নির্বাচন হচ্ছে। এসব নির্বাচন তাঁর দলের জনপ্রিয়তার জন্য এক পরীক্ষা। এমন একসময় এ ভোট হচ্ছে, যখন মার্কিন সরকারের অচলাবস্থা বা শাটডাউন ৩৫তম দিনে পৌঁছেছে। এতে ভুগছেন হাজার হাজার ফেডারেল কর্মী।
জোহরান মামদানি ১৯৯১ সালের ১৮ অক্টোবর উগান্ডার রাজধানী কাম্পালায় জন্মগ্রহণ করেন। তার মা প্রখ্যাত ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা মীরা নায়ার, আর বাবা মাহমুদ মামদানি একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সমাজবিজ্ঞানী, যিনি ভারতের মাটিতে জন্ম নিলেও উগান্ডার নাগরিক।
মাত্র পাঁচ বছর বয়সে পরিবারসহ দক্ষিণ আফ্রিকায় যান জোহরান, এরপর সাত বছর বয়সে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন নিউইয়র্কে। ছোটবেলা থেকেই তিনি বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি ও অভিবাসী জীবনের অভিজ্ঞতা অর্জন করেন, যা পরে তার রাজনৈতিক চিন্তাধারায় গভীর প্রভাব ফেলে।
২০২০ সালে ডেমোক্রেটিক পার্টির হয়ে তিনি নির্বাচিত হন নিউইয়র্ক স্টেট অ্যাসেম্বলির সদস্য হিসেবে। এখান থেকেই শুরু হয় তার রাজনৈতিক উত্থান। সাধারণ মানুষের সমস্যা, বিশেষত ভাড়া, গণপরিবহন ও শিক্ষা নিয়ে সরাসরি কাজ করে তিনি দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
২০২৪ সালে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দেন—তখনো তিনি তুলনামূলক অপরিচিত মুখ। কিন্তু মাত্র এক বছরের মধ্যেই তিনি নিউইয়র্কের রাজনীতিতে সবচেয়ে আলোচিত প্রার্থী হয়ে ওঠেন।
এই নির্বাচনে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুয়োমো এবং রিপাবলিকান প্রার্থী কার্টিস স্লিওয়া। প্রথমে বর্তমান মেয়র এরিক অ্যাডামস প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দিলেও জনসমর্থনের অভাবে সরে দাঁড়ান। যদিও মামদানি তরুণ ও তুলনামূলক অনভিজ্ঞ, তার প্রচারাভিযান ছিল জনমানুষের ইস্যুতে সরাসরি সংযুক্ত। তিনি বারবার বলেছেন, বিশ্ব বদলাতে বয়স বা অভিজ্ঞতা নয়, প্রয়োজন হয় ইচ্ছা আর সততা।
তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলোর মধ্যে ছিল- স্থায়ী ভাড়ার সীমা নির্ধারণ গণপরিবহন বিনামূল্যে করা, শিশু যত্নের সার্বজনীন সুযোগ, ধনীদের ওপর অতিরিক্ত কর আরোপ করে সামাজিক কল্যাণে ব্যয়। এই প্রতিশ্রুতিগুলো শহরের শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে দ্রুত সাড়া ফেলে দেয়।
জোহরান মামদানি শুধু অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেই নয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও সরব। তিনি গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসন ও গণহত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার। তার দাবি, গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত নেতানিয়াহু নিউইয়র্কে এলে তাকে গ্রেপ্তার করা উচিত।
এমন অবস্থানের কারণে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রকাশ্যে তার সমালোচনা করেন এবং হুমকি দেন, মামদানি জিতলে নিউইয়র্কের ফেডারেল তহবিল বন্ধ করে দেবেন। কিন্তু এই বক্তব্য উল্টো মামদানির জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে দেয়।
