■ নাগরিক প্রতিবেদক ■
গণঅভ্যুত্থানের সময় ৫ আগস্ট আশুলিয়ায় লাশ পুড়িয়ে ফেলার ঘটনায় জুলাই শহীদদের পরিবারসহ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন রাজসাক্ষী পুলিশের সাবেক এসআই শেখ আবজালুল হক।
বুধবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ট্রাইব্যুনাল-২ এর বিচারক জজ মো. মঞ্জুরুল বাছিদের নেতৃত্বে দুই সদস্যের বেঞ্চে এই সাক্ষীর জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়।
এদিন আশুলিয়ায় ছয় মরদেহ পোড়ানোসহ সাতজনকে হত্যার দায়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক এমপি সাইফুল ইসলামসহ ১৬ আসামির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন আবজালুল।
জবানবন্দিতে আবজালুল বলেন, ‘গত বছর জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালীন আশুলিয়া থানার ওসি এ এফ এম সায়েদকে মোবাইলে আন্দোলন দমনসহ বিরোধীদের গ্রেফতার করতে মাঝেমধ্যে নির্দেশনা দিতেন এমপি সাইফুল ইসলাম। এসব নির্দেশনা অধস্তন কর্মকর্তাদের দিয়ে বাস্তবায়ন করতেন ওসি সায়েদ।’
তিনি আরো বলেন, ‘গত বছর ৫ আগস্ট সকাল সাড়ে ১০টার দিকে হ্যান্ডমাইক দিয়ে থানার সব কর্মকর্তা ও অধস্তনদের ডাকেন ওসি সায়েদ। সবার উদ্দেশে তিনি জুলাই আন্দোলনে শক্তভাবে দায়িত্ব পালনের নির্দেশনা দেন। এরপর অন্য ইউনিট থেকে আসা বেশিরভাগ কর্মকর্তা ও ফোর্সদের নিয়ে বাইপাইল কেন্দ্রীয় মসজিদের দিকে যান তিনি। একপর্যায়ে দুপুর আড়াইটায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে গেলে ফোর্স নিয়ে থানায় চলে আসেন ওসি সায়েদ।’
এরপর ওসি সায়েদের সঙ্গে থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মাসুদুর রহমান, পুলিশ পরিদর্শক (অপারেশন) নির্মল কুমার, পুলিশ পরিদর্শক (ডিবি) আরাফাত হোসেনসহ অন্যান্য কর্মকর্তা এবং অন্য ইউনিট থেকে আসা পুলিশ সদস্যদের নিয়ে থানার গেটে অবস্থান নেন। বিকেল ৪টায় ছাত্র-জনতার একটি অংশ থানার দিকে বিজয় মিছিল নিয়ে আসলে ওসি স্যারের নির্দেশে এএসআই বিশ্বজিৎ ও অন্য ইউনিট থেকে আসা কয়েকজন পুলিশ সদস্য মিছিলকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন। তাৎক্ষণিক কয়েকজন গুলিবিদ্ধ ও রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে যান। পরে ওসি সায়েদের নির্দেশে পুলিশ সদস্যরা লাশগুলোকে তিন চাকার ভ্যানে তুলে পুলিশের আরেকটি পিকআপ ভ্যানে ওঠান। এই ঘটনা দেখার পর দুইদিন আমি ট্রমায় ছিলাম।’
ওই সময় এসআই আব্দুল মালেক ও এএসআই বিশ্বজিৎকে নিয়ে পরামর্শ করছিলেন ওসি সায়েদ। এরপর থানায় গিয়ে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট খুলে সিভিল পোশাকে পিস্তলটি নিয়ে থানা থেকে বের হয়ে যাই। পরে ফল বিক্রেতা কামালের সঙ্গে তার ভাড়া বাসায় উঠি।’
এসআই আবজালুল হক আরো বলেন, ‘পরদিন ভোরে ওই বাসা থেকে বেরিয়ে আমার বাসায় যাই। ১৫ আগস্ট থানায় গিয়ে আমার নামে ইস্যু করা পিস্তল ও গুলি জমা দেই। থানায় গিয়ে সবকিছু এলোমেলো দেখতে পাই। তখন জানতে পারি, পুলিশ যাদের হত্যা করে পিকআপে রেখেছিল, সেসব লাশ ওইদিনই ওসি সায়েদ ও বিশ্বজিৎ মিলে পেট্রোল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেন। পরে তারা বিকেল সাড়ে ৫টায় থানা ছেড়ে সেনাবাহিনীর সঙ্গে ক্যান্টনমেন্টে চলে যান।’
এই এসআই বলেন, ‘তৎকালীন ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি নুরুল ইসলাম, তৎকালীন ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার আসাদুজ্জামান রিপন, সাভার (ক্রাইমস অ্যান্ড অপস) এডিশনাল এসপি (এসপি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) আব্দুল্লাহিল কাফি, সাভার সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহিদুল স্যারদের এ ঘটনা নিয়ে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখিনি।’
তিনি বলেন, ‘আমাকে চলতি বছরের মে মাসে গ্রেফতার করা হয়। তবে, আমি শহীদ ভাইদের আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বিবেকের দায়বদ্ধতা থেকে কোনো ধরনের প্ররোচনা ও প্রলোভন ছাড়া এই মামলায় রাজসাক্ষী হওয়ার জন্য আবেদন করি। যেন ট্রাইব্যুনালকে এ মামলার বিষয়ে সত্য তথ্য দিয়ে বিচারকাজে সহায়তা করে শহীদ ভাইদের ঋণ কিছুটা পরিশোধ করতে পারি। আমি শহীদ ভাইদের জন্য কিছু করতে না পারায় তাদের পরিবার ও ট্রাইব্যুনালের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।’
জবানবন্দি গ্রহণ শেষে আবজালুলকে আংশিক জেরা করেন আসামিপক্ষের আইনজীবী মিজানুর রহমান। বৃহস্পতিবার বাকি জেরা শেষ করা হবে।
