সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল 

■ নাগরিক প্রতিবেদক ■ 

সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বৈধ উল্লেখ করে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের রায় দিয়েছে আপিল বিভাগ।

বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে ৭ বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বিভাগ ঐতিহাসিক এ রায় ঘোষণা করেন। 

বেঞ্চের অপর ৬ বিচারপতি হলেন— বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, বিচারপতি মো. রেজাউল হক, বিচারপতি এস এম ইমদাদুল হক, বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি ফারাহ মাহবুব।

এ রায়ের মাধ্যমে সংবিধানে টানা ১০ দিন শুনানি শেষে দেশের সর্ব্বোচ আদালত ঐতিহাসিক এ মামলার রায়ের দিন ঠিক করেন। 

গত ২, ৪, ৫, ৬, ১১ নভেম্বর ও ২৯, ২৮, ২৩, ২২ অক্টোবর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফেরাতে আপিলের টানা শুনানি হয়েছে।

আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী ড. শরীফ ভূঁইয়া, বিএনপির পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল। জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মোহামদ শিশির মনির। ইন্টারভেনর হিসেবে শুনানি করেন ব্যারিস্টার এহসান আবদুল্লাহ সিদ্দিকী, ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদল, অ্যাডভোকেট মহসীন রশিদ, ব্যারিস্টার শাহরিয়ার কবির। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার অনীক আর হক।

গত ২১ অক্টোবর নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফেরাতে আপিলের শুনানি শুরু হয়।

এর আগে গত ২৭ আগস্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে করা আবেদনের শুনানি শেষে আপিলের অনুমতি দেওয়া হয়।

এরপর ড. বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচজন বিশিষ্ট ব্যক্তি, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার আপিল করেন।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরলেও আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে অন্তর্বর্তী সরকারে অধীনে। চতুর্দশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা কার্যকর হবে। 

গত ২৭ আগস্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে করা আবেদন মঞ্জুর করে আপিলের অনুমতি দেওয়া হয়। এরপর ২১ অক্টোবর থেকে আপিলের শুনানি শুরু হয়।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রায় ছিল কলঙ্কিত ও ত্রুটিপূর্ণ

এই রায়ের পর্যবেক্ষণে আপিল বিভাগ বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের অতীতের রায় ছিল কলঙ্কিত ও একাধিক ত্রুটিতে ত্রুটিপূর্ণ। প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে ৭ বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বিভাগ সর্বসম্মতিক্রমে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। 

পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, আদালত এই মর্মে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন- পর্যালোচনাধীন আপিল বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রায়টি নথি দৃষ্টে স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান একাধিক ত্রুটিতে ত্রুটিপূর্ণ। এ কারণে আপিল বিভাগের অতীতের রায়টি সম্পূর্ণরূপে বাতিল করা হলো। এর ফলে ফলশ্রুতিতে সংবিধানের চতুর্থ ভাগের পরিচ্ছেদ ২(ক)-এর নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার-সম্পর্কিত বিধানাবলী, যা সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধন) আইন, ১৯৯৬ (১৯৯৬ সনের ১ নং আইন) এর ধারা ৩ দ্বারা সন্নিবেশিত হয়েছিল, তা এই রায়ের মাধ্যমে পুনরুজ্জীবিত ও সক্রিয় করা হলো।

রায়ে বলা হয়েছে, যদিও এইরূপ পুনরুজ্জীবন পরিচ্ছেদ ২(ক)-এ বর্ণিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারসংক্রান্ত বিধানাবলীর স্বয়ংক্রিয় পুনঃস্থাপন নিশ্চিত করে, তবে পুনরুজ্জীবিত অনুচ্ছেদ ৫৮(খ)(১) এবং অনুচ্ছেদ ৫৮(গ)(২)-এর বিধানাবলীর প্রয়োগ সাপেক্ষে তা কার্যকর হবে।

রায়ে আরও বলা হয়েছে, পুনঃস্থাপিত ও পুনরুজ্জীবিত পরিচ্ছেদ ২(ক)-এ বর্ণিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারসংক্রান্ত বিধানাবলী কেবলমাত্র উক্তরূপ ভবিষ্যৎ প্রয়োগযোগ্যতার ভিত্তিতেই কার্যকর হবে। 

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা যেভাবে সাংবিধানিক রূপ লাভ করে

এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে একটি অনানুষ্ঠানিক অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে হলেও, ১৯৯৪ সালের মাগুরা উপনির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ পরিস্থিতি পাল্টে দেয়।

১৯৯৬ সালে ক্ষমতাসীন দলের অধীনে কোনোভাবেই অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়, এই অভিযোগ তুলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিরোধী দলগুলো তীব্র আন্দোলন শুরু করে।

আন্দোলনের মুখে ১৯৯৬ সালে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে সাংবিধানিক রূপ দেওয়া হয়।

যেখানে বলা হয়েছিল, নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ শেষে একটি নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করবে, যার প্রধান কাজ হবে পরবর্তী তিন মাস বা ৯০ দিনের মধ্যে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিত করা।

 এ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ১৯৯৮ সালে অ্যাডভোকেট এম সলিম উল্লাহসহ তিনজন আইনজীবী হাইকোর্টে রিট করেন। ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট হাইকোর্ট বিভাগ এ রিট খারিজ করেন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বৈধ ঘোষণা করা হয়।

এই সংশোধনীর বৈধতা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এম সলিমউল্লাহসহ অন্যরা ১৯৯৮ সালে হাইকোর্টে রিট করেন। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট রুল দেন। হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চ চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট রায় দেন।

এ রায়ের বিরুদ্ধে সরাসরি আপিলের অনুমতি দেওয়া হয়। এর ধারাবাহিকতায় ২০০৫ সালে আপিল করে রিট আবেদনকারীপক্ষ।

এই ব্যবস্থার অধীনে ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালে তুলনামূলকভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এবং এর ফলে উভয় নির্বাচনেই শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর সম্ভব হয়েছিল। 

২০০৬ সালের পর থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার কাঠামো নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। বিশেষ করে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে বিচারপতি কে এম হাসানের নিয়োগ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তুমুল বিরোধ দেখা দেয়।

২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন নিয়ে রাজনৈতিক অচলাবস্থার কারণে দেশে জরুরি অবস্থা জারি হয় এবং একটি সেনা-সমর্থিত বিতর্কিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা নেয়, যা পরবর্তীতে এক-এগারো সরকার নামে পরিচিত হয়। এই সরকার দীর্ঘ দুই বছর ক্ষমতায় থেকে নিজেদের সাংবিধানিক এখতিয়ারের বাইরেও কাজ করে।

এমন প্রেক্ষাপটে ২০১১ সালের ১০ মে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ত্রয়োদশ সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে রায় দেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির আপিল বেঞ্চ।

ওই রায়ে বলা হয়েছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অর্থাৎ সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী আইন অগণতান্ত্রিক এবং তা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

এরপর সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এই ব্যবস্থা স্থায়ীভাবে বাতিল করা হয়।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *