■ নাগরিক প্রতিবেদক ■
রাজধানীর পল্লবীতে সন্ত্রাসীদের গুলিতে যুবদল নেতা গোলাম কিবরিয়া হত্যার ঘটনায় আটক এক ব্যক্তির ডিবি হেফাজতে মৃত্যু হয়েছে। নিহত ব্যক্তির নাম মোক্তার হোসেন। এ ঘটনায় তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)।
শুক্রবার (২১ নভেম্বর) দুপুরে ডিএমপির মিডিয়া বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি জানান, গত সোমবার (১৭ নভেম্বর) পল্লবীতে যুবদল নেতা গোলাম কিবরিয়াকে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় নিহতের স্ত্রী সাবিহা আক্তার পল্লবী থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে মামলাটি পরে ডিবিতে হস্তান্তর করা হয়।
ঢাকা মেডিকেলের মর্গে গিয়ে দেখা যায়, মোক্তার হোসেনের মরদেহ ঘিরে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ পুলিশের একাধিক টিম কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করে রেখেছে। মর্গের ভেতরে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। সেখানে ঢাকা জেলার একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে মোক্তারের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। তার স্ত্রী ও সন্তান সুরতহাল প্রতিবেদনে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানান।
মোক্তার হোসেনের মৃত্যুর পর ঢাকা মেডিকেলে আসা তার ছেলে মৃদুল সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, আটকের পর প্রথমে পল্লবী থানার কনফারেন্স রুমে নিয়ে নির্যাতন করা হয় মোক্তারকে। নির্যাতনের ফলে তার বাবার মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। এ সময় ঢাকা মহানগর ডিবি পুলিশের কর্মকর্তারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। গণমাধ্যমকর্মীরা তাদের বক্তব্য চাইলেও এ বিষয়ে তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
নিহত মোক্তারের ছেলে মৃদুল জানান, গতকাল (বৃহস্পতিবার) দুপুর ২টা থেকে ৩টার মধ্যে পল্লবীতে তাদের বাসার সামনের চায়ের দোকান থেকে কয়েকজন লোক মোক্তারকে ধরে দ্রুত গাড়িতে তুলে ফেলেন। জানতে পেরে তিনি এবং তার মা সেখানে আসেন। তারা দেখতে পান মোক্তারকে একটি মাইক্রোবাসের ভেতরে মারধর করা হচ্ছে। এর কিছুক্ষণ পর মৃদুলকেও আরেকটি গাড়িতে তুলে নেওয়া হয়।
‘সেখান থেকে তাদের নেওয়া হয় পল্লবী থানার কনফারেন্স রুমে। সেখানে বাবা-ছেলে দুজনকেই মারধর করেন ডিবি পুলিশের সদস্যরা।’
মৃদুল বলেন, আমার বাবাকে তারা পিটিয়ে হাত-পা বেঁধে একটি লাঠির সঙ্গে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখেন এবং তার গোপনাঙ্গে রশি দিয়ে ইট ঝুলিয়ে দেন। বাবা ডিবি পুলিশকে জানান, তার কাছে কোনো অস্ত্র নেই। মসি নামে একজন একটি ব্যাগে তিনটি অস্ত্র দিয়েছিল, পরে সেগুলো আরেকজন নিয়ে গেছে। কিন্তু ডিবি পুলিশ তার কথা বিশ্বাস করেনি, তারা তাকে ব্যাপক নির্যাতন করতে থাকে। আজ ভোরের দিকে আমাদের ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। আমার বাবা অনেক চিৎকার করে কান্না করছিলেন, সেটি আমি শুনতে পাচ্ছিলাম। তিনি আমার নাম ধরে ডাকছিলেন। ডিবি পুলিশ আমাকে বলে, ‘তুই এখানে শুয়ে থাক, এখান থেকে উঠবি না।’
মৃদুল আরও বলেন, সকালে দেখা যায় আমার বাবা আর নড়াচড়া করছেন না। তখন ডিউটিতে থাকা ডিবি কর্মকর্তারা বিষয়টি জানান তাদের ঊর্ধতন কর্মকর্তাদের। এরপর তারা আমার বাবাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যান। আমি তখনো ডিবি হেফাজতে ছিলাম। এর কিছুক্ষণ পর সাদা কাগজে দুটি সাইন নিয়ে আমাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসা হয়। এসে দেখি আমার বাবা আর বেঁচে নেই।
ঢাকা মেডিকেলে আসা মোক্তারের স্ত্রী মুক্তা শিকদার বলেন, আমার স্বামী পালানোর চেষ্টা করেননি। তাকে চায়ের দোকান থেকেই ধরে নিয়েছে ডিবি। আপনারা সেখানে থাকা অন্য লোকজনকে জিজ্ঞেস করলে জানতে পারবেন।
তিনি অভিযোগ করেন, তার স্বামীকে রাজনৈতিক কারণে চক্রান্ত করে মারা হয়েছে। বলেন, কয়েক ঘণ্টা আগে ডিবি আমাকে বাসা থেকে নিয়ে আসে– বলে, ‘ছেলে ডিবি অফিসে আছে, চলেন’। ডিবি অফিসের কথা বলে আমাকে ঢাকা মেডিকেলের মর্গে নিয়ে এসেছে তারা।
তিনি বলেন, বাবার সামনে ছেলেকে নির্যাতন করা হয়েছে। পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে তারা এখন নাটক সাজাচ্ছে।
মামলার অগ্রগতির অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবার (২০ নভেম্বর) শরীয়তপুর জেলার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে নজরুল, মাসুম ও জামান নামে তিনজনকে গ্রেফতার করে ডিবি। জিজ্ঞাসাবাদে তারা হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে এবং কিলিং মিশনে ব্যবহৃত অস্ত্র ও গুলি তাদের সহযোগী মোক্তার হোসেনের কাছে রয়েছে বলে জানায়।
ডিএমপির গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমানের পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত সোমবার সন্ধ্যায় মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনের বি ব্লকের বিক্রমপুর হার্ডওয়্যার অ্যান্ড স্যানিটারি নামের দোকানে ঢুকে মুখোশধারী দুর্বৃত্তরা এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে যুবদল নেতা কিবরিয়াকে হত্যা করে। এই ঘটনায় তার স্ত্রী সাবিহা আক্তার বাদী হয়ে পাঁচজনের নাম উল্লেখ করে পল্লবী থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। অজ্ঞাতনামা আসামি ৭-৮ জন। সুষ্ঠু তদন্তসহ জড়িত ব্যক্তিদের দ্রুত গ্রেফতারের লক্ষ্যে মামলাটি ডিএমপির ডিবিতে হস্তান্তর করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ডিবি গতকাল বৃহস্পতিবার শরীয়তপুর জেলার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ঘটনার সঙ্গে জড়িত নজরুল, মাসুম ও জামানকে গ্রেফতার করে।
ডিএমপির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গ্রেফতার ব্যক্তিরা ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা প্রাথমিকভাবে স্বীকার করেন। কিবরিয়া হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্র-গুলি মোক্তারের হেফাজতে আছে বলে জানান তারা। তাদের তথ্যের ভিত্তিতে ডিবির একটি দল গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় পল্লবীর একটি গ্যারেজে অভিযান চালায়। ডিবির উপস্থিতি টের পেয়ে মোক্তার দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। পরে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় কৌশলে তাকে আটক করা হয়। এ সময় উত্তেজিত জনতা মোক্তারকে মারধর করেন।
ডিএমপির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মোক্তারের তথ্যের ভিত্তিতে পল্লবীর একটি রিকশা গ্যারেজ থেকে পিস্তলের আটটি গুলি উদ্ধার করে ডিবি। পরে মোক্তারকে মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়। গতকাল দিবাগত রাত দেড়টার দিকে মোক্তার অসুস্থবোধ করেন। তাকে তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। কর্তব্যরত চিকিৎসকেরা প্রাথমিকভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে কিছু ওষুধ দিয়ে তাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেন। তাকে আবার ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়।
ডিএমপির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে খাবার খাওয়ার জন্য মোক্তারকে ডাকাডাকি করা হয়। কোনো সাড়াশব্দ না পাওয়ায় পুলিশ সদস্যরা দ্রুত তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। চিকিৎসকেরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
ময়নাতদন্তের জন্য মোক্তারের মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে বলে জানায় ডিএমপি।
এ ঘটনায় ডিএমপির পক্ষ তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে ডিএমপির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়। এতে বলা হয়, এই তদন্ত কমিটির প্রধান ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (প্রশাসন) মো. সরওয়ার।
