আগুনে কড়াইল বস্তির ১৫০০ ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত

■ নাগরিক প্রতিবেদন ■

‎রাজধানীর কড়াইল বস্তিতে ভয়াবহ এই অগ্নিকাণ্ডে কেউ হতাহত না হলেও পুড়ে গেছে ১ হাজার ৫০০ ঘরবাড়ি। বুধবার সকাল সাড়ে ৯টায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আগুন পুরোপুরি নিভিয়ে ফেলেন।

সকালে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সদর দপ্তর থেকে খুদে বার্তায় বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়।

ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে কড়াইল বস্তিতে আনুমানিক দেড় হাজার ঘরবাড়ি পুড়েছে এবং বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিটের প্রচেষ্টায় পাঁচ ঘণ্টারও বেশি সময় পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে, এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।

বৈদ্যুতিক লাইন পরীক্ষা করতে আসা ডেসকোর এক কর্মকর্তা বলেন, অনেক জায়গায় তার পুড়ে গেছে, কোথাও আবার ঝুলে আছে। আমরা সেগুলো পরীক্ষা করছি। কিন্তু এই এলাকায় এতো মানুষ যে, ঠিকমতো কাজ করা যাচ্ছে না। এভাবে কাজ চললে নিরাপত্তাজনিত মারাত্মক ঝুঁকি আছে।

ক্ষতিগ্রস্ত স্থানে পৌঁছাতে গিয়ে রাস্তায় দু–এক জায়গায় দেখা গেছে, ভিড় ঠেলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো নিজের ধ্বংসস্তূপে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে। ঘর হারানো আবদুল হামিদ বলেন, আমাদের ঘর তো শেষ, এখন অন্তত দেখতে চাই কী অবস্থা। কিন্তু ভিড়ের কারণে ঢুকতেই পারছি না।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, মানুষের ভিড় না থাকলে আমরা নিজেদের কিছু জিনিস খুঁজে নিতে পারতাম।

এদিকে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক, ফায়ার সার্ভিস, এলাকাবাসী বারবার অনুরোধ করছেন কৌতূহলী জনতাকে কিছুটা দূরে থাকতে, যাতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের চলাচল সহজ হয় এবং নিরাপত্তা ঝুঁকি না তৈরি হয়।

সকালে সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, বস্তির বিশাল একটি অংশে এখন পোড়া কাঠ, টিন ও ছাইয়ের স্তূপ। সেখানে এখনো ধোঁয়া উড়ছে। ক্ষতিগ্রস্তরা তাদের পুড়ে যাওয়া ঘরের ধ্বংসস্তূপের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করছেন। অনেকেই আশপাশে ত্রিপল, পলিথিন ও কাপড়-কম্বল বিছিয়ে অস্থায়ী আশ্রয়স্থল তৈরি করেছেন। তবে দুর্গতদের মধ্যে শিশু ও বৃদ্ধরাই সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছেন। এদের মধ্যে বহু মানুষ ভিজে যাওয়া কাপড় শুকিয়ে নিচ্ছেন এবং পোড়া মালামালের মধ্যে হাতড়ে বেড়াচ্ছেন কোনো কিছু অবশিষ্ট আছে কি না দেখতে।

ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একদিকে সব হারানোর বেদনা, অন্যদিকে শীত ও খাদ্যের অভাব মিলিয়ে সবাই এখন বিপর্যস্ত।

শাফিয়া বেগম নামের ক্ষতিগ্রস্ত এক নারী বলেন, ‘আমার গতর খাটা টাকা, সব পুড়্যা গেলো। রাইতে না খাইয়াই কাটাইছি। একটা কম্বলও পাই নাই। এই ছাইয়ের গন্ধ আর শীতে সারারাত ঘুমাইতেই পারি নাই। পেটে ক্ষুধা, খাবারও জোটেনি।’

পুড়ে যাওয়ার আগে ঘরের কয়েকটি টিন সরাতে পেরেছিলেন রিকশাচালক আব্দুল করিম। তিনি বলেন, ‘আমার ঘরের কিছুই নাই। বউ-পোলাপান নিয়ে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটলো। কাল থাইক্যা এ পর্যন্ত কেউ একটু খাবার দেয় নাই। সবাই খালি ফটো তুলে কিন্তু দরকারি সাহায্য পাইনি।

ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইন্টেন্যান্স) লেটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী আগুন নিয়ন্ত্রণের পর ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি জানান, স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে প্রাথমিকভাবে অনুমান করা হচ্ছে, অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ১৫০০ ঘর-বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তদন্তের পর জানা যাবে।

আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের একাধিক বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে বলে জানান লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আগুন লাগার ৩৫ মিনিট পর ঘটনাস্থলে পৌঁছায় প্রথম তিনটি ইউনিট। এর প্রধান কারণ ছিল ঢাকা শহরের তীব্র যানজট। বিকেলের দিকে যানজট বেশি থাকায় ফায়ার সার্ভিসের গাড়িগুলো দ্রুত মুভ করতে পারেনি।’

তিনি আরও উল্লেখ করেন, সরু রাস্তার কারণে বড় গাড়িগুলো বস্তির ভেতরে ঢুকতে পারেনি। ফলে দূর থেকে পাইপ টেনে কাজ করতে হয়েছে। এর আগেই আগুন “ডেভলপ স্টেজে” চলে যাওয়ায় নিয়ন্ত্রণে আনতে বেশি সময় লাগে। ফায়ার ফাইটাররা অক্লান্ত পরিশ্রম করে দ্রুত আগুন আটকানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন।

আগুন লাগার কারণ সম্পর্কে তাৎক্ষণিক কিছু জানাতে পারেননি ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘আগুন নেভানোর কাজ করার সময় দেখা গেছে, বস্তিতে যত্রতত্র বিদ্যুতের তার রয়েছে এবং প্রত্যেক বাসায় গ্যাস সিলিন্ডার রয়েছে। আগুনের উৎস তদন্ত সাপেক্ষে বলা যাবে।’

তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত কোনো হতাহতের খবর নেই, তবে ছোটখাটো আহত কেউ হতে পারে, যা পরে জানা যাবে। ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক মূল্য এবং সামগ্রিক পরিমাণও তদন্তের পরই নির্ধারণ করা হবে।

কড়াইল বস্তিতে প্রায় প্রতি বছর আগুন লাগার প্রবণতা থাকায় ফায়ার সার্ভিসের প্রস্তুতি প্রসঙ্গে লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘প্রতি বছরই এখানে মহড়া করা হয়। “মহড়ায় দুর্বল পয়েন্টগুলো চিহ্নিত করা হয় এবং আগুন লাগলে সে অনুযায়ী কাজ করা হয়। কিছুদিন আগেই মহড়া শেষ হয়েছিল, এজন্য আগুন দ্রুত নেভানো গেছে; অন্যথায় আগুন নেভাতে হয়তো আরও দুই-তিন ঘণ্টা বেশি সময় লাগতো।’

তিনি আরও সতর্ক করে দেন, সামনে শীত আসছে এবং এই সময়টিকে ফায়ার সার্ভিস ‘আগুনের সিজন’ বলে চিহ্নিত করা হয়। অন্য সিজনের চেয়ে এই সময়ে আগুনের ঘটনা বেশি দেখতে পাওয়া যায়।

পানি স্বল্পতা নিয়ে স্থানীয়দের দাবির জবাবে তিনি বলেন, পর্যাপ্ত পানির সাপোর্ট পাওয়া গেছে। ফায়ার সার্ভিসের নিজস্ব পানিবাহী গাড়ি, ওয়াসা এবং ড্রেন থেকেও পানি নেওয়া হয়েছে।

উল্লেখ্য, গতকাল বিকেল ৫টা ২২ মিনিটের দিকে কড়াইল বস্তিতে আগুন লাগার খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। প্রথমে ১১টি ইউনিট কাজ শুরু করলেও পরে আরও ৮টি ইউনিট তাদের সঙ্গে যোগ দেয়।

পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করবে সরকার

রাজধানীর কড়াইল বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে বিপুলসংখ্যক ঘরবাড়ি পুড়ে যাওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি এই ঘটনায় অসংখ্য পরিবারের নিঃস্ব হয়ে যাওয়াকে ‘সকলের জন্য বেদনাদায়ক’ বলে মন্তব্য করেছেন।

আজ বুধবার এক বিবৃতিতে প্রধান উপদেষ্টা এই ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করেন এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।

ড. ইউনূস বলেন, ‘কড়াইল বস্তির অগ্নিকাণ্ডে যেসব পরিবার গৃহহীন হয়েছে, তাদের দুঃখ-কষ্ট আমাদের সকলের জন্য বেদনার। ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে সরকার প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহায়তা নিশ্চিত করবে।’

বিবৃতিতে জানানো হয়, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দ্রুত ত্রাণ ও উদ্ধার কার্যক্রম জোরদার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধান করে ভবিষ্যতে এমন দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ারও নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *