বেগম রোকেয়াকে ‘কাফের-মুরতাদ’ বললেন রাবি শিক্ষক

■ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি ■

নারী জাগরণ ও নারী অধিকার আন্দোলনের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনকে ‘কাফের-মুরতাদ’ আখ্যা দিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক খন্দকার মোহাম্মদ মাহমুদুল হাসান।

মঙ্গলবার (৯ ডিসেম্বর) সকালে নিজের ব্যক্তিগত ফেসবুক টাইমলাইনে একটি পোস্ট শেয়ার করে তিনি এ মন্তব্য করেন। তার মন্তব্য ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ব্যাপক সমালোচনা তৈরি হয়েছে ।

এদিকে এ পোস্টের জেরে আজ বিকেলে পুনরায় নিজের ব্যক্তিগত ফেসবুক টাইমলাইনে এক পোস্টে সহযোগী অধ্যাপক খন্দকার মোহাম্মদ মাহমুদুল হাসান জানান, ‘বেগম রোকেয়া আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার নাজিলকৃত কিতাব অস্বীকার করেছেন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রিসালাত অস্বীকার করেছেন, তাকে প্রতারক বলেছেন, আল্লাহর নাজিলকৃত বিধান নিয়ে কটূক্তি করেছেন। এত কিছুর পরে কোন মানুষের ঈমান থাকতে পারে না’।

তিনি আরো লেখেন, ‘আমার বক্তব্য একটু ফতওয়ার মত মনে হচ্ছে। ফতওয়া দেওয়ার অধিকার আলেমদের, আমার না। এই জায়গায় অনধিকার চর্চা করেছি বলতে পারেন। ঈমান ভঙ্গের কারণ সম্পর্কে যার মোটামুটি ধারণা আছে, তিনি কখনই এমন কাউকে ঈমানদার বলবেন না।’

এ বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সালেহ হাসান নকীব বলেন, ‘এটা তার ব্যক্তিগত অভিমত। অনেকের ভালো নাও লাগতে পারে। ব্যক্তিগতভাবে আমি এটি সমর্থন করি না।’

খন্দকার মোহাম্মদ মাহমুদুল হাসানের সেই পোস্টের স্ক্রিনশট শেয়ার করে রাকসুর গত নির্বাচনে বিতর্ক ও সাহিত্য সম্পাদক পদে প্রার্থী মামুনুজ্জামান স্নিগ্ধ লিখেছেন, ‘নারী শিক্ষার অগ্রদূত রোকেয়াকে (বেগম রোকেয়া) কাফের মুরতাদ বলা হয়েছে। পবিত্র ধর্মগুলোকে ব্যবহার করে ঐতিহাসিকভাবেই নারীদের ওপর নিপীড়ন-অত্যাচার করা হয়েছে— তা চার্চের অত্যাচার, হিল্লা বিয়ে কিংবা দাসী প্রথা— সবই ধর্মের নাম ব্যবহার করেই হয়েছে। রোকেয়া এসব কুসংস্কার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে লেখালেখি করেছেন।’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জনপ্রিয় অ্যাক্টিভিস্ট সাদিকুর রহমান খান লিখেছেন, ‘বেগম রোকেয়াকে কাফের-মুরতাদ গালি দিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক। পাশাপাশি ‘শাহবাগী-টাগি’ বলে গালাগালও দিয়েছেন। দেখে অবাক লাগে। মানে রোকেয়া এদের কত বড় ট্রমা দিয়ে গেছেন ভাবুন— এক মানুষ প্রায় ১০০ বছর আগে মারা গেছেন, তাকে এখনো গালাগাল করতে হয়! এ থেকেই প্রমাণ হয় বেগম রোকেয়া কতটা সফল ছিলেন।’

এ ঘটনায় ক্ষোভ জানিয়ে রাবির ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক পরমা পারমিতা বলেন, ‘বেগম রোকেয়া উপমহাদেশের নারীশিক্ষা ও মানবিক মূল্যবোধের অন্যতম পথিকৃৎ। তিনি কখনো ধর্মবিদ্বেষী ছিলেন না; বরং অন্ধ কুসংস্কার, বৈষম্য ও অজ্ঞতার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন— যা ইসলামসহ সব ধর্মই সমর্থন করে।’ তিনি আরো বলেন, ‘কোনো ব্যক্তিকে এভাবে ধর্মীয় গালি দেয়া শুধু অসম্মানজনক নয়, অন্যায়ও বটে। ভিন্নমত বা প্রগতিশীল চিন্তাকে অপমান করে নয়, যুক্তি ও ইতিহাস বুঝে আলোচনা করাই সভ্যতার লক্ষণ। বেগম রোকেয়ার জন্মদিনে তাকে হেয় করার চেষ্টা তার বিশাল অবদানকে ছোট করতে পারে না; বরং আমাদের সংকীর্ণ মানসিকতা প্রকাশ করে।’

রাকসুর গত নির্বাচনে বিতর্ক ও সাহিত্য সম্পাদক পদে প্রার্থী মামুনুজ্জামান স্নিগ্ধ ওই পোস্টের স্কিনশট শেয়ার করে লিখেছেন, “নারী শিক্ষার অগ্রদূত রোকেয়াকে কাফের-মুরতাদ বলা হয়েছে। ইতিহাস দেখলে দেখা যায়, নারী নিপীড়ন বা বৈষম্যের অনেক কিছুরই নামে ধর্মকে ব্যবহার করা হয়েছে। রোকেয়া এসব কুসংস্কার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে লিখতেন— তাই আজও তিনি অনেকের কাছে ‘ভয়ঙ্কর’ মনে হয়।”

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক পরমা পারমিতা বলেন, ‘বেগম রোকেয়া উপমহাদেশের নারীশিক্ষা, মানবিক মূল্যবোধ ও প্রগতিশীল চিন্তার অন্যতম পথিকৃৎ। তিনি ধর্মবিদ্বেষী ছিলেন না; তিনি কুসংস্কার, বৈষম্য ও অজ্ঞতার বিরুদ্ধে লড়েছেন— যেটি সব ধর্মই সমর্থন করে। একজন শিক্ষক হয়ে তাকে ধর্মীয় গালি দেওয়া শুধু অসম্মানজনক নয়, অন্যায়ও বটে।’

রাবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী এসএম আতিক মন্তব্য করেন, ‘৫ আগস্ট আমাদের বাকস্বাধীনতা এনে দিয়েছে। এর সুবাদে পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষকও এখন ফতোয়া দিতে পারেন।’

বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহিন বিশ্বাস এষা বলেন, ‘বেগম রোকেয়া পুরো উপমহাদেশেই নারী জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে স্বীকৃত। তার কারণেই আমাদের নারীরা বর্তমানে পড়াশোনা, রাজনীতিসহ সব ক্ষেত্রে নিজেদের যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখছে। তাকে নিয়ে এই ধরনের মন্তব্য করা মানে গোটা নারী সমাজকেই হেয় করা। তার এই বক্তব্য কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।’

তবে খন্দকার মোহাম্মদ মাহমুদুল হাসান সাংবাদিকদের জানান, তিনি সাজিদ হাসানের পোস্ট পড়ে মনে করেছেন রোকেয়া ‘ইসলামবিদ্বেষী’ ছিলেন।

তিনি বলেন, ‘এই লেখাগুলো ভেরিফিকেশনের জন্য বড় আলেমের কাছে যেতে হবে। আলেমরাই বলতে পারবেন তিনি কাফের ছিলেন কিনা।’

তবে রোকেয়ার অন্যান্য লেখার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি শুধু দাবি করেন, তার একটি উপন্যাস তিনি পড়েছেন।

খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, সাজিদ হাসানের পোস্টে বেগম রোকেয়ার রচনাবলী থেকে ইসলাম-সম্পর্কিত অংশগুলো খণ্ডিতভাবে তুলে ধরে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, সেখান থেকেই রাবির এই শিক্ষক তার মন্তব্য করেছেন।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *