ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন ও গণভোট ১২ ফেব্রুয়ারি

■ নাগরিক প্রতিবেদন ■

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের তফসিল ঘোষণা করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন। তফসিল অনুযায়ী আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন ও গণভোট অনুষ্ঠিত হবে।

বৃহস্পতিবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে এ তথ্য জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার  (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন।

ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের মনোনয়পত্র জমা দেওয়ার শেষ সময় ২৯ ডিসেম্বর। মনোনয়নপত্র বাছাই ৩০ ডিসেম্বর থেকে ৪ জানুয়ারি। রিটার্নিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল দায়ের ১১ জানুয়ারি এবং আপিল নিষ্পত্তি হবে ১২ থেকে ১৮ জানুয়ারি। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময় ২০ জানুয়ারি। চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ ও প্রতীক বরাদ্দ করা হবে ২১ জানুয়ারি। নির্বাচনী প্রচার শুরু হবে ২২ জানুয়ারি, প্রচার শেষ হবে ১০ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে সাতটায়।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দীন বলেছেন, আমাদের অঙ্গীকার হচ্ছে একটি সুষ্ঠু ও সুন্দর নির্বাচন অনুষ্ঠান। যা জাতি হিসেবে আমাদের প্রত্যাশা পূরণ করবে। বিশ্বদরবারে আমাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আপনারা একই প্রত্যাশা ধারণ করেন এবং একই অঙ্গীকারে অঙ্গীকারাবদ্ধ।

বৃহস্পতিবার (১১ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দীন। সন্ধ্যা ছয়টায় বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার ও বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশন সিইসির ভাষণ সম্প্রচার করে।

মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা এবং একইসঙ্গে জুলাই আগস্ট ২০২৪ এর ছাত্র-জনতা গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা এবং তাদের আত্মার শান্তি কামনা করে ভাষণ শুরু করেন সিইসি। তিনি বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে ২০২৪ এর ছাত্র গণঅভ্যুত্থানা পর্যন্ত সার্বভৌমত্ব এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও রক্ষার সব আন্দোলনে যারা আহত, নির্যাতিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদের প্রতি জানাই আমার আন্তরিক সমবেদনা। আহতদের দ্রুত আরোগ্য এবং স্বাভাবিক জীবনের জন্য প্রার্থনা করছি।
 
তিনি আরও বলেন, জাতি হিসেবে আমাদের অমূল্য শক্তি হচ্ছে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব এবং গণতন্ত্রের জন্য আমাদের ভালোবাসা ও আত্মত্যাগ। জাতির প্রত্যাশাকে ধারণ করে আমাদের সংবিধান রাষ্ট্রের ওপর জনগণের একচ্ছত্র মালিকানা নিশ্চিত করেছে। জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল মালিকানা প্রতিষ্ঠার একমাত্র পথ হচ্ছে নির্বাচন। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, মানসম্মত নির্বাচনের অনুপস্থিতি প্রায়শই আমাদের ঐতিহ্য এবং সামষ্টির প্রত্যাশাকে নিরাশ করেছে। এমনিই এক প্রেক্ষাপটে ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে। আমাদের ভাইবোন সন্তানদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে আমাদের অঙ্গীকার হচ্ছে একটি সুষ্ঠু ও সুন্দর নির্বাচন অনুষ্ঠান যা জাতি হিসেবে আমাদের প্রত্যাশা পূরণ করবে এবং বিশ্বদরবারে আমাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আপনারা একই প্রত্যাশা ধারণ করেন এবং একই অঙ্গীকারে অঙ্গীকারাবদ্ধ।

সুষ্ঠ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে গত এক বছরে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদন করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, একটি স্বচ্ছ নির্বাচনের পূর্ব শর্ত হচ্ছে একটি নির্ভুল পূর্ণাঙ্গ ও স্বচ্ছ ভোটার তালিকা। আমরা শুরুতেই এই কাজে হাত দেই। গত এক বছরে নতুন ভোটার অন্তর্ভুক্তির পাশাপাশি ভোট বিমুখ এবং বাদ পড়া প্রায় ৪৫ লাখ ভোটকে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ২১ লক্ষাধিক মৃত ভোটারকে তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। নারী ভোটারদের যথাযথ অন্তর্ভুক্তির অভাবে পুরুষের সঙ্গে নারী ভোটারের ব্যবধান বেড়ে প্রায় ২৯ লাখে গিয়ে দাঁড়ায়। বাদ পড়া নারী ভোটারদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে সেই ব্যবধান উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনা হয়েছে।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, আইন সংশোধন করে ভোটার হওয়ার যোগ্যতার তারিখ প্রতিবছর ১ জানুয়ারির পরিবর্তে কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত দিনে নির্ধারণ করা হয়েছে। এর ফলে ৩১ অক্টোবর ২০২৫ পর্যন্ত যোগ্য তরুণ ভোটাররা ভোট দিতে পারছেন। 

গত ১৮ নভেম্বর প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী বর্তমানে দেশে ভোটারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২ কোটি ৭৬ লাখ ৯৫ হাজার ১৮৩ জনে। এর মধ্যে পুরুষ ভোটারের সংখ্যা ৬ কোটি ৪৮ লাখ ১৪ হাজার ৯০৭ জন এবং নারী ভোটারের সংখ্যা ৬ কোটি ২৮ লাখ ৭৯ হাজার ৪২ জন। গত এক বছরে নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সবার জবাবদিহিতা বাড়াতে আমরা বহুবিধ আইনি ও প্রথাগত সংস্কার সম্পন্ন করেছি। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ এবং রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের আচরণবিধিতে যথাযথ পরিবর্তন সংসদ ও পরিমার্জন করা হয়েছে। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের বিভিন্ন সুপারিশের পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব মূল্যায়ন ও অংশীজনের পরামর্শের ভিত্তিতে এসব সংস্কার করা হয়েছে। এই উদ্যোগ সফলভাবে সম্পন্ন করতে সহযোগিতার জন্য আমি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন ও জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশন সহ সব অংশীজনদের জানাই আমার কৃতজ্ঞতা।

এবারের নির্বাচনে মোট ভোটার ১২ কোটি ৭৬ লাখের বেশি। প্রবাসী বাংলাদেশি ভোটারেরাও পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। এখন পর্যন্ত ৩ লাখের বেশি প্রবাসী ভোটার ভোট দেওয়ার জন্য নিবন্ধন করেছেন। এ বিপুল সংখ্যক ভোটারের জন্য ইসি ৪২ হাজার ৭৬১টি ভোটকেন্দ্র চূড়ান্ত করেছে। জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে হওয়ায় ভোটের সময় এক ঘণ্টা বাড়ানো হয়েছে। পাশাপাশি সময় সাশ্রয় করতে প্রতিটি কক্ষে দুটি গোপন বুথ রাখা হয়েছে।

এর আগে, ৯ ডিসেম্বর প্রধান নির্বাচন কমিশনার জানিয়েছিলেন, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল চলতি সপ্তাহে হতে পারে। ওই দিন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে তিনি সাংবাদিকদের এ কথা জানান।

তফসিল ঘোষণার আগে নির্বাচনী নানা বিষয় নিয়ে প্রধান বিচারপতির খাসকামরায় প্রায় ঘণ্টাব্যাপী তাদের মধ্যে একান্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া, গতকাল বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টায় রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নির্বাচন কমিশন। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতের পর বিকেল ৪টায় তফসিল সংক্রান্ত ভাষণ রেকর্ড করা হয়।

নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার জানান, আসন বিন্যাস, আইন অনুযায়ী রিটার্নিং অফিসার, সহকারী রিটার্নিং অফিসার যারা থাকবেন তাদের প্রজ্ঞাপন, বিভিন্ন বিষয়ে ২০টির মতো পরিপত্র জারি করা হবে। মোবাইল কোর্ট, ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ, ইলেকটোরাল ইনকোয়ারি কমিটি নিয়োগ, বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ, মনিটরিং সেল গঠন, আইনশৃঙ্খলা সেল গঠন— এগুলোর ফরমেটও তৈরি রয়েছে।

নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ জানিয়েছিলেন, তফসিল ঘোষণার পূর্বে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ইসির দায়িত্ব নয়। আনুষ্ঠানিকভাবে সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টির দায়িত্ব আসবে তফসিল ঘোষণার পর। চূড়ান্ত পোস্টাল ব্যালটে নিষিদ্ধ বা স্থগিত কোনো দলের প্রতীক থাকবে না। তফসিল ঘোষণার পর রাজনৈতিক দলসহ সবার সহযোগিতার বিষয়ে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হবে।

৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সরাতে হবে প্রচার সামগ্রী

 এতোদিন নির্বাচন আমেজ ধারণ করে যেসব প্রার্থী ব্যানার, ফেস্টুন, বিলবোর্ড টাঙ্গিয়েছেন, সেগুলো আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সম্ভাব্য প্রার্থী বা সংশ্লিষ্টদের সরিয়ে ফেলার নির্দেশনা দিয়েছে নাসির উদ্দিন কমিশন।

গতকাল ১০ ডিসেম্বর ইসির নির্বাচন ব্যবস্থাপনা শাখার উপ-সচিব মোহাম্মদ মনির হোসেন এ সংক্রান্ত নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিবকে চিঠি দিয়েছেন।

চিঠিতে বলা হয়েছে, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে তফসিল ঘোষণার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ওই নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রার্থীদের পোস্টার, ব্যানার, দেয়াল লিখন, বিলবোর্ড, গেট, তোরণ বা ঘের, প্যান্ডেল ও আলোকসজ্জা ইত্যাদি প্রচার সামগ্রী ও নির্বাচনী ক্যাম্প থাকলে তা সংশ্লিষ্ট সম্ভাব্য প্রার্থী/ব্যক্তিদের তফসিল ঘোষণার পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে নিজ খরচে/দায়িত্বে অপসারণ করার জন্য নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত প্রদান করেছেন। এ লক্ষ্যে সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদসহ বিভিন্ন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহকে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের জন্য নির্দেশনা দেওয়া প্রয়োজন।

ইসি জানায়, নির্ধারিত সময়ে উপযুক্ত প্রচারণা সামগ্রীসমূহ অপসারণ সংক্রান্ত কার্যক্রম বাস্তবায়নে সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদসহ বিভিন্ন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহকে নির্দেশনা দেওয়ার জন্য আদিষ্ট হয়ে অনুরোধ করা হলো।

শুক্রবার থেকে সারাদেশে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আচরণবিধি প্রতিপালন নিশ্চিতকরণের জন্য সারা দেশে এক্সিকিউটিভ (নির্বাহী) ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবকে চিঠি দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।

নির্বাচন কমিশনের নির্বাচন পরিচালনা শাখার উপসচিব মোহাম্মদ মনির হোসেন স্বাক্ষরিত চিঠিটি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিবকে পাঠানো হয়।

চিঠিতে ইসি জানায়, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম চলমান রয়েছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে তফসিল ঘোষণার পরদিন থেকে ভোটগ্রহণের দুদিন পর পর্যন্ত সময়ের জন্য মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯ এর আওতায় আচরণ বিধি প্রতিপালনার্থে প্রতি উপজেলা/থানায় অন্যূন ২ জন করে এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করার জন্য নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

ইসি আরও জানায়, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তফসিল ঘোষণার পরদিন থেকে ভোটগ্রহণের দুদিন পর পর্যন্ত সময়ের জন্য মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯ এর আওতায় আচরণ বিধি প্রতিপালনার্থে প্রতি উপজেলা/থানায় অন্যূন ২ জন করে এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *