:: নাগরিক প্রতিবেদন ::
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন গড়ে মৃত্যু হয় ৬৪ জনের। এই পরিসংখ্যান তুলে ধরে যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সহায়তা প্রদানের বিধান দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলা হয়েছে, দেশে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ৬৪ জনের; সে হিসাবে বছরে প্রাণহানির সংখ্যা ২৩ হাজার ৩৬০। বছরে আহত ৩ লাখের মধ্যে প্রতিবন্ধী জীবনযাপন করে কমপক্ষে ৮০ হাজার মানুষ।
বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের হিসাবে, গত এক দশকে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের ৫৪ শতাংশের বয়স ১৬ থেকে ৪০ বয়সের মধ্যে। যাদের বেশিরভাগই কর্মক্ষম জনবল।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, দেশের কর্মক্ষম ব্যক্তিরাই সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছেন। এর প্রভাব পড়ছে জাতীয় অর্থনীতিতে। দুর্ঘটনায় নিহত ও আহত ব্যক্তি এবং তাদের ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে।
গাড়িচালক, মালিক ও যাত্রীরা সচেতন না হলে সড়ক পরিস্থিতির উন্নয়ন হবে না, বলছেন বিআরটিএর চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার।
শুক্রবার বনানীতে বিআরটিএর কার্যালয়ে নিরাপদ সড়ক দিবসের অনুষ্ঠান তিনি আরও জানান, এ নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে নেয়া হয়েছে বিশেষ কর্মসূচি।
দুর্ঘটনার রাশ টানতে সড়ক আইন হওয়ার চার বছরেও শৃঙ্খলা ফেরেনি সড়কে। বরং দুর্ঘটনা বেড়েছে অন্তত ২৫ শতাংশ। এমনটাই বলছে বুয়েটের পরিসংখ্যান। বিধিামালা বাস্তবায়নে সমন্বয়হীনতাকেই এজন্য দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। আর বিআরটিএ বলছে, দুর্ঘটনা কমাতে তদারকি বাড়ানো হয়েছে, তবে প্রয়োজন সচেতনতা।
রাজধানী ছাড়া্ও দেশের কোথাও না কোথাও প্রায় প্রতিদিনই ঝরছে প্রাণ। কেউ কেউ বেঁচে ফিরলেও বরণ করতে হচ্ছে পঙ্গুত্ব।
দুর্ঘটনার লাগাম টানতে ২০১৮ সালে সড়ক আইন করা হয়। অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালকদের দাপট, ফিটনেসবিহীন পরিবহনের দৌরাত্ম্য এবং সড়ক আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ না থাকায় দুর্ঘটনায় লাগাম টানা যাচ্ছে না কিছুতেই।
পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে, ৯০ দশমিক ৬৯ ভাগ সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী অদক্ষ চালক। সারা দেশে নিবন্ধনবিহীন চালকের সংখ্যা ২৪ লাখ বলে জানিয়েছে বিভিন্ন সংগঠন। তাদের বেপরোয়া গতি ও ট্রাফিক আইন না মানায় সড়কে শৃঙক্ষলা ফিরছে না বলে মত নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের নেতাদের।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার তার মেয়াদের শেষ প্রান্তে চলে আসলেও নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী নিরাপদ সড়কের অঙ্গীকার বাস্তবায়নে উল্লেখযোগ্য কোন পদক্ষেপ দৃশ্যমান হয়নি। ফলে সড়কে প্রতিদিন অসংখ্য প্রাণহানি ঘটছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতি বছর সড়কে প্রায় ৮ হাজারের বেশি প্রাণহানির তথ্য মিলেছে। সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, সড়কে প্রতিদিন ৬৪ জন মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। এই তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় ২৩,৩৬০ জন মানুষের প্রাণহানি হচ্ছে। প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ আহত হচ্ছে। প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ৮০ হাজার মানুষ প্রতিবন্ধী হয়ে পড়ছে। এর মধ্যে ১২ হাজারের বেশি ১৭ বছরের কম বয়সী শিশু। এ হিসাবে দেখা যায়, প্রতিদিন গড়ে ২২০ জন মানুষ প্রতিবন্ধী হচ্ছে কেবল সড়ক দুর্ঘটনায়। অন্যদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, সারা বিশ্বে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় ১৩ লাখ মানুষ মারা যায়। বাংলাদেশে মারা যায় ২৪,৯৫৪ জন। সংস্থাটির তথ্য মতে হতাহতদের ৬৭ শতাংশই ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী। এক্ষেত্রে মৃত্যুর ঝুঁকিতে রয়েছে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী ব্যক্তিরা সবচেয়ে বেশি। সংস্থাটি দাবী করছে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনাজনিত জিডিপির ক্ষতি ৫.৩ শতাংশ।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোঃ মোজাম্মেল হক চৌধুরী আরো বলেন, দেশের কর্মক্ষম ব্যক্তিরাই সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে জাতীয় অর্থনীতিতে। দুর্ঘটনায় নিহত ও আহত ব্যক্তি এবং তাদের ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদের আর্থসামাজিক যে ক্ষতি হচ্ছে। বুয়েটের এআরআই এর হিসেব বলছে, গত তিন বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় এমন ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৯ হাজার কোটি টাকা। কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা যদি নির্ভরশীল মানুষের তুলনায় বেশি হয়, তাহলে সেটিকে জনসংখ্যার বোনাস বা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বলা হয়। বাংলাদেশ এ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের জন্য গর্ব করে। সড়ক দুর্ঘটনা এ গর্বের জায়গাতেই বেশি আঘাত হানছে। পুলিশের তথ্যভান্ডার বিশ্লেষণ করে এআরআই বলছে, গত এক দশকে দেশের সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের ৫৪ শতাংশের বয়স ১৬ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। আর দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের সাড়ে ১৮ শতাংশ শিশু। এদের বয়স ১৫ বছরের নিচে। তিনি আরো বলেন, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের হিসেবে সড়ক দুর্ঘটনায় একজন কর্মক্ষম ব্যক্তি প্রাণ হারানোর কারণে ২৪ লাখ ৬২ হাজার ১০৬ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়। সেই হিসেবে প্রত্যেক নিহত ব্যক্তির পরিবার এই পরিমাণ অর্থ রাষ্ট্র থেকে ক্ষতি পূরণ পাওয়ার হকদার। যদিও সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ এ গঠিত সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতদের আর্থিক সহায়তা তহবিল হতে নিহত ব্যক্তির পরিবারকে ৫ লাখ টাকা ও আহত ব্যক্তিকে ৩ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিধান থাকলেও আইন কার্যকরের ৩ বছরের মাথায় এই ক্ষতিপূরণ প্রদানের কার্যক্রম আজো শুরু করা হয়নি। তিনি জরুরি ভিত্তিতে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতদের আর্থিক সহায়তা কার্যক্রম চালুর দাবী জানান। একই সাথে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি কমাতে জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল সক্রিয় করার দাবী জানান।
এসময় ভিকটিম পরিবারের সদস্যরা তাদের নানা অভাব অভিযোগ তুলে ধরে সড়ক নিরাপত্তা তহবিল থেকে সহযোগিতা কামনা করেন। আরো বক্তব্য রাখেন বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের সহকারি অধ্যাপক কাজী সাইফুন নেওয়াজ, বিশিষ্ট সাংবাদিক আবু সাঈদ খান, যাত্রী কল্যাণ সমিতির সহ সভাপতি তাওহিদুল হক, যুগ্ম মহাসচিব এম মনিরুল হক, বাংলাদেশ মানবাধিকার সমিতির সভাপতি মনজুর হোসেন ইশা, সেইফ ড্রাইভের সাধারণ সম্পাদক কাজী আব্দুল কাইয়ুম প্রমুখ । এই সময় ভিকটিম পরিবারের পক্ষ থেকে বাস ভাড়া নিয়ে তর্কের জেরে রাজধানীর ওয়ারীতে গ্রীন বাংলা পরিবহনে সহকারীর ধাক্কায় বাসের নীচে পড়ে নিহত ইরফান আহমেদের স্ত্রী ইসমত আরা, মিরসরাইয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত গ্রীন লাইন পরিবহনের চালক আনোয়ার হোসেনের ছেলে আরাফাত হোসনে, রাজধানীর শেওড়াপাড়ায় বিমানবন্দর সড়কে জেব্রা ক্রসিংয়ের উপর দিয়ে সড়ক পারাপারের সময় বেপরোয়া বাসের চাপায় নিহত আদনান তাসিনের পিতা আহসানউল্লাহ টুটুল, গুলিস্থানে স্বদেশ পরিবহনের বাস চাপায় নিহত সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্ন কর্মী মোঃ ফারুকের স্ত্রী জোহরা বেগম, ঢাকা-চট্টগ্রামের মহাসড়কের গৌরীপুরে বাস চাপায় আহত তিশা পরিবহনের হেলপার মাহবুবুল ইসলাম, ভিকটিম পরিবারের সদস্য কামাল হোসেন, সাজ্জাদ হোসেন প্রমুখ। সড়ক দুর্ঘটনার শিকার এইসব পরিবারের সদস্যরা তাদের দুঃখ দুর্দশার চিত্র তুলে রাষ্ট্রের কাছে আইন অনুযায়ী আর্থিক সহায়তা দাবী করেন।