:: নাগরিক প্রতিবেদন ::
চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজারের দিকে আরও এগিয়ে এসেছে ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’ । এটি বর্তমানে পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগর ও সংলগ্ন পশ্চিম-মধ্য বঙ্গোপসাগর এলাকায় অবস্থান করছে।
শক্তি বাড়িয়ে ঘূর্ণিঝড়টি বাংলাদেশের দিকে ধেয়ে আসছে। যে কারণে এর প্রভাব সোমবার ভোর থেকে বৃষ্টি হচ্ছে রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকায়। একই সঙ্গে বেড়েছে সতর্কসংকেত।
আবহাওয়ার বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে সোমবার সকালে উপকূলীয় ১৩ জেলায় ৭ নম্বর সংকেত জারি করা হয়েছে।
উপকূলীয় জেলাসমূহ হলো— সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চর।
এসব জেলা ও চরের নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৫-৮ ফুট বেশি উচ্চতার বায়ুতাড়িত জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে বলে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে।
মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরে ৪ নম্বর স্থানীয় হুশিয়ারি সংকেত নামিয়ে তার পরিবর্তে ৭ নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরে ৪ নম্বর স্থানীয় হুশিয়ারি সংকেত নামিয়ে তার পরিবর্তে ছয় নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। উপকূলীয় জেলা চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চর ছয় নম্বর বিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে।
সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার নদীবন্দরে ৩ নম্বর নৌ-বিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
ঢাকা আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ আব্দুর রহমান জানিয়েছেন, ‘এটা এখনো ঘূর্ণিঝড় অবস্থাতেই আছে। আমরা তিন ঘণ্টা পর পর আপডেট দেব। আমাদের হাতে এখনো ২০ ঘণ্টা থেকে ২৪ ঘণ্টা সময় আছে। উপকূল অতিক্রম করার সময় গতিবেগ ১০০ কিলোমিটার থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘এখন আমরা ৭ নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলেছি। একই সঙ্গে নৌ বিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।’
আবহাওয়ার পূর্ভাসে জানা যায়, এটি আজ সন্ধ্যা ৬ টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৭৭০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৭১০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৭০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৬৭৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণপশ্চিমে অবস্থান করছিল। এটি আরও ঘণীভূত হয়ে উত্তর দিকে অগ্রসর হতে পারে।
ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৫৪ কিলোমিটার এর মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২ কিলোমিটার। যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ৮৮ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের নিকটবর্তী এলাকায় সাগর বিক্ষুব্ধ রয়েছে।
ঘূর্ণিঝড়টির অগ্রবর্তী অংশ, অমাবশ্যা তিথি ও বায়ুচাপ পার্থক্যের আধিক্যের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহের নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৫-৭ ফুট অধিক উচ্চতার জলোচ্ছাসে প্লাবিত হতে পারে।
পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত নিম্নচাপটি উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে রোববার সকালে গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়। নিম্নচাপের প্রভাবে আজ ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে থেমে থেমে বৃষ্টি ঝরেছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ আবদুর রহমান বলেন, এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে, এটি মাঝারি মাত্রার ঘূর্ণিঝড়। তবে এটি আঘাত হানার সময় অমাবস্যা থাকবে। এ কারণে বাতাসের গতি কমলেও জলোচ্ছ্বাসের কারণেই উপকূলীয় এলাকায় ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে।
কানাডার সাসকাচোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ু গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ রোববার বিকেলে জানান, এটি সুপার সাইক্লোন নয়। সিত্রাং ‘ভেরি সিভিয়ার সাইক্লোনিক স্টর্ম’ অর্থাৎ খুবই শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়। এর গতিবেগ ঘণ্টায় ১১০ থেকে ১৩০ কিলোমিটার হতে পারে। সাত ক্যাটাগরির ঘূর্ণিঝড় আছে। শক্তির দিক থেকে সিত্রাং তিন নম্বর। সোমবার রাত অমাবস্যা হওয়ায় উপকূলীয় এলাকা ও চরাঞ্চলগুলোতে স্বাভাবিকের চেয়ে ১০ থেকে ১২ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। এই জলোচ্ছ্বাসের তীব্রতা হবে অনেক বেশি। তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড়টির কেন্দ্র পুরো বরিশাল বিভাগ ও চট্টগ্রাম বিভাগের নোয়াখালী, ফেনী ও চট্টগ্রাম জেলার ওপর দিয়ে স্থলভাগে প্রবেশ করার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। খুলনা বিভাগের উপকূলেও ঝড়ের প্রভাব পড়বে।
‘সিত্রাং’ এর প্রভাবে রাজধানীসহ সারা দেশে বৃষ্টি
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’ এর প্রভাবে রোববার মধ্যরাত থেকে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে।
গভীর নিম্নচাপটি আরও ঘনীভূত হয়ে ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’-এ রূপ নিয়েছে। এটি আরও ঘনীভূত হয়ে উত্তর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আগামী মঙ্গলবার ভোরে ঘূর্ণিঝড়টি বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হানতে পারে।
সোমবার সকাল থেকে কলকাতাসহ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায়ও দমকা ও ঝড়ো হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি এবং বজ্রসহ বৃষ্টি হচ্ছে।
বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে- ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে ময়মনসিংহ, ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় এবং রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের অনেক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা ও ঝড়ো হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি এবং বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে।
সেইসঙ্গে সারা দেশে কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারি থেকে অতি ভারি বর্ষণ হতে পারে।
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং মোকাবিলায় বার্তা দিয়েছে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ। বার্তায় জনগণকে নিজ নিজ স্থাপনা ও টেলিযোগাযোগ সম্পদ রক্ষায় প্রস্তুতি নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের পক্ষ থেকে রোববার সন্ধ্যার পর বিভিন্ন অপারেটরের গ্রাহকদের মোবাইল ফোনে পর্যায়ক্রমে এ ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হয়।
ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বঙ্গোপসাগর ও বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় সোমবার সকাল থেকে ৪০ থেকে ৫০ কিলোমিটার বেগে দমকা অথবা ঝড়ো বাতাস বইছে।
সেই সঙ্গে ৪৪ থেকে ৮৮ মিলিমিটার পর্যন্ত অতি ভারি বর্ষণ হতে পারে। এজন্য সমুদ্রবন্দরগুলোকে ৪ নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
দুর্বল বাঁধ নিয়ে আতঙ্কে উপকূল
দুর্যোগ মোকাবিলায় জেলা প্রশাসন বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও ষাটের দশকে নির্মিত বাঁধের ২০০ কিলোমিটার দুর্বল অংশ নিয়ে সবচেয়ে বেশি আতঙ্কে সাতক্ষীরাবাসী। এ ছাড়া খুলনার উপকূলীয় উপজেলা কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা, বটিয়াঘাটা ও বলেশ্বর নদীর তীরবর্তী বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার ঝুঁকিপূর্ণ বগী—গাবতলার দুই কিলোমিটার বেড়িবাঁধের অবস্থা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল খায়ের বলেন, সাতক্ষীরা উপকূলে পাউবোর আওতায় বেড়িবাঁধ ৭০০ কিলোমিটার। এর মধ্যে ২০০ কিলোমিটারের ৩৫ পয়েন্ট ঝুঁকিপূর্ণ। এর মধ্যেই আম্পানে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধগুলো সংস্কার করা হয়েছে। তা ছাড়া বাকি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় দুর্যোগ মোকাবিলায় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
উপকূলীয় বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্প (সিইআইপি—১)—এর প্রকল্প পরিচালক ও পাউবোর অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ হাসান ইমাম বলেন, দেশে বর্তমানে পোল্ডারের সংখ্যা ১৩৯। এগুলো ষাটের দশকে তৈরি। এর মধ্যে ৬০টি বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। বিভিন্ন কারণে আমরা এসব সংস্কার করতে পারিনি। বাকিগুলো পাউবো বিভিন্ন সময় সংস্কার ও পুনর্নির্মাণ করেছে। তবে নতুন করে কোনো বাঁধ তৈরি করা হয়নি।
পাউবো সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭০ ও ১৯৯১ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়সহ একের পর এক ঝড়—জলোচ্ছ্বাসে দেশের বাঁধের বেশিরভাগ অংশ নাজুক হয়ে পড়েছে। শুধু সিডরে উপকূলীয় ৩০ জেলার ২ হাজার ৩৪১ কিলোমিটার বাঁধ বিধ্বস্ত হয়। এর মধ্যে সম্পূর্ণ বিলীন হয় ৩৯১ কিলোমিটার। ১ হাজার ৯৫০ কিলোমিটার বাঁধ আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এ ছাড়া ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলার ৩৮টি পোল্ডারের ১৬৫১ কিলোমিটার বেঁড়িবাধের মধ্যে ৬৮৪ কিলোমিটার বিধ্বস্ত হয়। ২০২০ সালে ঘূর্ণিঝড় আম্পানে উপকূলীয় ১০ জেলার ৪৭৮ কিলোমিটার বাঁধ সম্পূর্ণ ভেঙে বিলীন হয়ে যায়। আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৬৭৮ কিলোমিটার।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ষাটের দশকে নির্মিত এসব বেড়িবাঁধ পুনর্নির্মাণ করা হয়নি। পুরনো—দুর্বল এসব বাঁধ ঝড়—জলোচ্ছ্বাসের ধাক্কা আর সামাল দিতে পারছে না। বালুর বস্তা ও রিং বাঁধ দিয়ে কোনোরকম টিকিয়ে রাখা হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ। উপকূলের বিপুলসংখ্যক মানুষের জন্য নেই পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টারও।
সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকায় ২০০৯ সালের ২৫ মে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় আইলা। সেসময় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এই এলাকা। এরপর ২০১৩ সালে মহাসেন, ২০১৫ সালে কোমেন, ২০১৬ সালে রোয়ানু, ২০১৭ সালে মোরা, ২০১৯ সালে ফণী ও ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর বুলবুল আঘাত হানে উপকূলে।
সবশেষ ২০২০ সালের ২০ মে সুন্দরবনের পাশ দিয়ে সাতক্ষীরা উপকূলে আছড়ে পড়ে ঘূর্ণিঝড় আম্পান। এতে বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলার বেশ কয়েকটি ইউনিয়ন, যার দগদগে ক্ষত এখনো শুকায়নি।