:: হাবিবুর রহমান ::
মিডিয়া যাদেরকে বুদ্ধিজীবী হিসেবে উপস্থাপন করে তাদের একটা বড়ো অংশ বিএনপির নিজস্ব রাজনৈতিক দর্শনকে স্বীকার করতে চান না। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, বিএনপির নিজের কোনো রাজনীতি নাই, আওয়ামী লীগ বিরোধিতা করার জন্য মানুষ বিএনপি করে।
দেশের আরেকটা জাতীয় নির্বাচন কাছাকাছি আসার আগে এই প্রশ্নটা আরেকবার সামনে আসতে পারে। তাই কিছু কথা –
এন্টি – আওয়ামী লীগ থেকে বিএনপি এই থিওরি মেনে নিলে, মুসলিম লীগের বিরোধিতা করার জন্যই আওয়ামী লীগের জন্ম যেমন জামায়াতের বিরোধিতা করার জন্য এবি পার্টি হয়েছে। কংগ্রেস মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষা করছে না সেই চিন্তা থেকে মুসলিম লীগের জন্ম। এভাবে চেইন খুঁজতে গেলে দেখা যাবে, এক্সিস্টিং বড়ো পার্টির পলিসি বা ইডিওলজিকে চ্যালেঞ্জ করেই আরেকটা বড়ো পার্টির জন্ম হয়। এটা বিএনপির জন্য যেমন সত্য, তেমনি আওয়ামী লীগের জন্যও সত্য। মুসলিম লীগের জন্যও সত্য।
কিন্তু সবচেয়ে বড়ো প্রশ্ন হচ্ছে, একটা প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের বিরোধিতা অনেকগুলো দলই করে থাকে। তাহলে মাত্র একটা দল কেন মূল প্রতিপক্ষ হয় ? একটা দলই কেন বিরোধী মতের ৮০-৯০% সমর্থন লাভ করে ?
এখন জামায়াত থেকে যেভাবে সংস্কারপন্থী এবি পার্টি বের করেছে সাবেক শিবির নেতারা তেমনি ছাত্রলীগের সমাজতন্ত্রী নেতারা আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে জাসদ প্রতিষ্ঠা করেছিল। জাসদ তৃণমূলে সমর্থন পায়নি। কমিউনিস্ট পার্টি বা ন্যাপ জনসমর্থন পায়নি। নেজামে ইসলাম বা অন্যকোনো ইসলামি দলও এই সমর্থন পায়নি।
কিন্তু বিএনপি তৃণমূলে জনসমর্থন পেয়েছে। জাসদ, জামায়াত, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, নেজামে ইসলাম সবাই আওয়ামী লীগ বিরোধী ছিল। জাসদ বাদে বাকি দলগুলোর জন্ম আওয়ামী লীগের সাথে প্রায় একই সময়ে। কিন্তু তারা কেউই সেই জনসমর্থনটি পাননি। পেয়েছে একমাত্র বিএনপি। ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা একজন মিলিটারি জেনারেলের হাতে তৈরি হওয়া একটা দল। আগে ক্ষমতা দখল করে দল গঠন করলেই জনসমর্থন পাওয়া যায় না। এরশাদও ক্ষমতায় এসে দল গঠন করেছিলেন। এরশাদ জিয়াউর রহমানের তুলনায় দ্বিগুণ সময় ক্ষমতায় ছিলেন। কিন্তু তার দল জনপ্রিয় হয়নি। নিজের এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন করে একটা অঞ্চলের মানুষের আংশিক সমর্থন পেয়েছেন। নানাবিধ চেষ্টা করেও দেশের কোনো ইউনিভার্সিটি – কলেজের ছাত্রদের তার রাজনীতিতে আকৃষ্ট করতে পারেননি।
কিন্তু জিয়াউর রহমান পেরেছেন। তার কারণ তার নিজস্ব একটা রাজনৈতিক দর্শন আছে। তিনি প্রথমেই জাতিকে একটা পরিচয় দিয়েছেন, যে পরিচয়টি এই ভূখণ্ডের যেকোনো মানুষ নির্দ্বিধায় ধারণ করতে পারে। আমরা বাংলাদেশি, এই পরিচয়টি পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে সমর্থ হয়েছিল। তিনি আর কোনো অতিরিক্ত শর্ত যোগ করে জাতিকে বিভক্ত করেননি।
মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকার কারণে গোটা ইসলাম ধর্ম এবং ধর্মভীরু মানুষজন কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন। এই সুযোগে বামপন্থীরা রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতি থেকে ইসলামিক সিম্বলগুলোকে সরিয়ে দেওয়ার সুযোগ খুঁজছিলেন৷ জিয়াউর রহমান এসে বললেন, “সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস হইবে রাষ্ট্র পরিচালনার মূল ভিত্তি”। জিয়ার দর্শনে দেশের মানুষ তাদের আশা ও আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন দেখেছে। বাংলা যুদ্ধ করে জিতে গেছে, হার জিতের চ্যাপ্টার ক্লোজড; এখন দীর্ঘদিন টিকে থাকার সংগ্রাম। তাই ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ — গণমানুষের স্লোগানে পরিণত হয়েছে।
এই দুটি বিষয়ই বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতা প্রচারকদের পছন্দ হয়নি। বিশেষ করে ১৯৪৭ এ ওপার বাংলায় তাড়া খেয়ে যারা সীমান্ত পেরিয়ে শরণার্থী হয়ে এসেছিলেন এদেশে, তাদেরই একটা অংশ এদেশে এসে বাঙালি বাঙালি আর ধর্মনিরপেক্ষ রব তুলেছে। তাদের ব্যাখ্যা শুনলে মনে হবে, ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি – পাঞ্জাবি কোনো রেসিয়াল যুদ্ধ ছিল অথবা কোনো ধর্মযুদ্ধ ছিল। অথচ দেশের মানুষ যুদ্ধ করেছিল বৈষম্যের বিরুদ্ধে এবং গণতন্ত্রের পক্ষে।
কিন্তু স্বাধীনতার মাত্র চার বছর পরে মানুষ দেখল গণতন্ত্রের বদলে একদলীয় শাসন। অমর্ত্য সেন জানিয়েছেন, চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের মূল কারণ বৈষম্যমূলক বণ্টন।
জিয়াউর রহমান এই জায়গাটিতে সফল হয়েছেন। তিনি দেশে পুনরায় নির্বাচন এবং বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছেন। সারাজীবন গণতন্ত্রের জন্য রাজনীতি করা নেতারা যদি একদলীয় শাসন কায়েম করতে পারেন, ক্যান্টনমেন্ট থেকে উর্দি পরে আসা একজন জেনারেল আবার গণতন্ত্রে ফিরে যেতে পারেন। দুইটাই সমানভাবে অবিশ্বাস্য এবং সত্য।
বিএনপি গণমানুষের দল হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড়ো ভূমিকা পালন করেছে দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ক্রেডিবিলিটি। দুর্ভিক্ষপীড়িত দেশটিতে কৃষি এবং খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, গার্মেন্টস এবং রেমিটেন্সের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নতি, সোভিয়েত ব্লক থেকে বের হয়ে চীন, যুক্তরাষ্ট্র এবং মধ্যপ্রাচ্যের সাথে সুসম্পর্ক তৈরি করে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে দেশের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান সৃষ্টি করা, স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়ার জন্য বাগাড়ম্বরহীন কিন্তু বাস্তবসম্মত ১৯ দফা কর্মসূচি — এসব মানুষকে আকৃষ্ট করেছিল এবং প্রথমবারের মতো স্বাধীনতার সুফল ভোগ করার স্বপ্ন দেখিয়েছিল।
চার বছরের মধ্যে বিশাল জনপ্রিয়তা পাওয়া বিএনপির জনসমর্থন টিকে গেছে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে আপোষহীন অবস্থানের কারণে। বেগম খালেদা জিয়া রাজপথে এরশাদকে মোকাবেলা করে নিজের এবং দলের ভিত্তিকে সংহত করেছেন। দ্বিতীয়বার দেশে গণতন্ত্র ফিরেছে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার হাত ধরে।
আবার যখন দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন চলছে তখনও দৃশ্যপটে কারাবন্দী বয়োবৃদ্ধ বেগম খালেদা জিয়া এবং তার নির্বাসিত পুত্র তারেক রহমান। কথিত বুদ্ধিজীবীদের মতে, গত দশ বছরে বিএনপি ‘কার্যকর’ বিরোধী দল ছিল না। তাহলে অন্য দলগুলোর জন্য একটা বড়ো ফাঁকা মাঠ ছিল। বিএনপি বাদে কেউ কেউ বা অনেকে মিলে একটা কার্যকর বিরোধী দল হয়ে উঠত পারত। কিন্তু পারেনি। বিএনপির বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা ‘জনসম্পৃক্ত দাবী’ নিয়ে মাঠে নামেনি। তাহলে বাকিদের সুযোগ ছিল ‘জনসম্পৃক্ত’ দাবী নিয়ে মাঠে নেমে দ্বিতীয় শক্তি বা তৃতীয় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়া। কিন্তু কেউ হতে পারেনি৷ কারণ, জনগণ তাদের কারো পেছনে দাঁড়ায়নি।
রংপুরের সমাবেশ নিয়ে প্রথম আলো অনলাইনের এক প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে-
“কাউনিয়া উপজেলা থেকে সমাবেশস্থলে এসেছেন ইমরান হোসেন (৩৫)। তিনি বলেন, ‘আমি কোনো দল করি না। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারকে আর চাই না। কারণ, সব জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়েছে সরকার। আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকেছে। চলতে পারছি না। সরকারের প্রতি অনাস্থা জানাতেই বিএনপির সমাবেশে এসেছি।’”
প্রশ্ন হচ্ছে, ইমরান হোসেন সরকারের প্রতি অনাস্থা জানাতে কেন এত কষ্ট করে বিএনপিরই সমাবেশে আসলেন ? আর কোনো প্লাটফর্মে কেন যাচ্ছেন না। ইমরান হোসেনের মতো সাধারণ মানুষ এখন ভয়কে জয় করে আবার বিএনপির কর্মসূচিতে আসতে শুরু করেছে৷ তারা দেখছে, বিএনপির সমাবেশে এখন জিয়াউর রহমান এবং খালেদা জিয়ার চেয়েও তারেক রহমানের ছবি ব্যানার অনেক বেশি। তারেক রহমানকে নিয়ে বুদ্ধিজীবীদের শত-শত অভিযোগ। কিন্তু সাধারণ মানুষ তার ডাকেই সমাবেশে আসছে। কারণ, তারা জানে এই অবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করার মতো ক্ষমতা একমাত্র তারেক রহমানের আছে। টিভি টকশো কিংবা পত্রিকার পাতায় ‘ এক স্বৈরাচার সরিয়ে আরেক স্বৈরাচার কেন আনা যাবে না’ এমন বুদ্ধিদীপ্ত আলোচনায় মানুষ কান দিচ্ছে না। আহমদ ছফা বলেছিলেন, বুদ্ধিজীবীদের কথা শুনলে দেশ স্বাধীন হতো না। এখন মানুষ বুঝতে পেরেছে, বুদ্ধিজীবীদের কথা শুনলে তারা আর আর কখনো ভোট দিতে পারবে না।
লেখকঃ শিক্ষানবিস আইনজীবী, হাবিব ল একাডেমীর শিক্ষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী