মুক্তিযুদ্ধে জীবনবাজি রাখা বীর মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকা শেষ পর্যন্ত হেরে গেলেন ক্যান্সারের কাছে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা সোমবার বাংলাদেশ সময় বেলা বেলা ১টা ৫০ মিনিটে (নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় রাত ২টা ৫০ মিনিটে) ইন্তেকাল করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর।
সাদেক হোসেন খোকা দীর্ঘদিন ধরে কিডনির ক্যানসারে ভুগছিলেন।
সাদেক হোসেন খোকার মৃত্যুতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শোক প্রকাশ করেছেন বলেও জানান তিনি।
সংকটাপন্ন অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ম্যানহাটনের মেমোরিয়াল স্লোয়ান ক্যাটারিং ক্যান্সার সেন্টারে নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন ছিলেন এই গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা।
সেখানকার চিকিৎসকরা সাদেক হোসেন খোকার শারীরিক অবস্থা পরিবর্তনের আশা ছেড়ে দিয়ে সব চিকিৎসা বন্ধ করে দেন।
তবে খোকার জীবনের শেষ ইচ্ছানুযায়ী অন্তিম সময়ে তাকে দেশে আনা পরিবারের পক্ষে সম্ভব হয়নি। পাসপোর্ট না থাকায় দেশে ফিরতে পারেননি তিনি।
ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য ২০১৪ সালের ১৪ মে সপরিবারে নিউইয়র্ক চলে যান সাদেক হোসেন খোকা। তার পর থেকে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিউইয়র্ক সিটির কুইন্সে একটি বাসায় দীর্ঘদিন ধরে থাকছিলেন বিএনপির এ নেতা।
হাসপাতালে খোকার পাশে আগে থেকেই আছেন তার স্ত্রী ইসমত হোসেন, মেয়ে সারিকা সাদেক, ছেলে ইশফাক হোসেন। বাবার সংকটাপন্ন অবস্থার খবর পেয়ে ঢাকা থেকে তার বড় ছেলে ইশরাক হোসেনও নিউইয়র্কে ছুটে যান।
২০০২ সালের ২৫ এপ্রিল অবিভক্ত ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হন খোকা। ২৯ নভেম্বর ২০১১ সাল পর্যন্ত টানা ১০ বছর বিএনপি ও আওয়ামী লীগের শাসনামলে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ছিলেন তিনি।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও অবিভক্ত ঢাকার প্রথম মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকার প্রথম জানাজা জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টারে অনুষ্ঠিত হবে। নিউইয়র্ক সময় সোমবার বাদ আসর এ জানাজা অনুষ্ঠিত হবে।
বিএনপি নেতা গিয়াসউদ্দিন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
গেরিলা যোদ্ধা থেকে জননেতা
ঢাকার সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সফল মেয়র বলা হয়ে থাকে সাদেক হোসেন খোকা।
শুধু মেয়রই নন, মন্ত্রিত্বও করেছেন খোকা। দুই দুবার মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন তিনি। সেখানেও সফল বিএনপির এ অন্যতম নেতা।
একসময়কার দাপুটে বাম রাজনীতিক খোকা একপর্যায়ে তরী ভেড়ান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে। বিএনপির ঢাকা মহানগর কমিটির সভাপতি ছিলেন দীর্ঘদিন। আমৃত্যু তিনি বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান পদে ছিলেন।
খোকা মানুষকে নিয়েই রাজনীতি করেছেন। জনপ্রতিনিধিত্ব করেছেন দীর্ঘ সময়। এমপি-মন্ত্রী-মেয়র পদে থেকে ঢাকার মানুষের হৃদয় জয় করেছেন খোকা।
সাদেক হোসেন খোকা একজন দক্ষ সংগঠকও ছিলেন। রাজপথের আন্দোলনে তিনি ছিলেন অগ্র সেনানী। সরকারবিরোধী আন্দোলনে বারবার মার খেয়েছেন। গুলি খেয়েছেন একাধিকবার। তার রক্তে রাজপথ হয়েছে রঞ্জিত। মৃত্যুঞ্জয়ী খোকা শেষ পর্যন্ত হার মেনেছেন ক্যান্সারের কাছে।
সাদেক হোসেন খোকা ১৯৫২ সালের ১২ মে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার সময় বাম রাজনীতিতে সক্রিয় হন খোকা। পরে বামপন্থী রাজনীতি ছেড়ে আশির দশকে বিএনপির রাজনীতি শুরু করেন।
১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে ঢাকা-৭ আসন (সূত্রাপুর-কোতোয়ালি) থেকে বিএনপির মনোনয়নে জয়ী হন খোকা। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে ২৮ হাজার ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে তাক লাগিয়ে দেন খোকা। এর পর তাকে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী করা হয়।
১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ভাঙাকে কেন্দ্র করে পুরান ঢাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলার চেষ্টা হলেও তা প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি। তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর পাহারা দিয়ে সম্প্রীতির অনন্য নজির স্থাপন করেন। এতে খোকা পুরান ঢাকাবাসীর আস্থা অর্জন করেন।
১৯৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচনে ঢাকার আটটি আসনের মধ্যে সাতটিতে বিএনপি প্রার্থী পরাজিত হলেও একমাত্র খোকা নির্বাচিত হন।
২০০১ সালের নির্বাচনেও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে মৎস্য ও পশুসম্পদমন্ত্রী হন। পরে তাকে ঢাকার মেয়র পদে মনোনয়ন দেয়া হয়। তিনি বিপুল ভোটে অবিভক্ত ঢাকার মেয়র নির্বাচিত হন।
২৯ নভেম্বর ২০১১ সাল পর্যন্ত টানা ১০ বছর বিএনপি ও আওয়ামী লীগের শাসনামলে ঢাকা মহানগরের মেয়র ছিলেন তিনি।
রাজনীতিবিদ খোকা প্রথমে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব ছিলেন। বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য বিরোধী দল কঠোর আন্দোলন শুরু করলে ঢাকায় বিএনপি কোণঠাসা হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় খোকাকে ১৯৯৬ সালে মহানগর বিএনপির আহ্বায়কের দায়িত্ব দেয়া হয়। ওই সময় পুরান ঢাকায় বিএনপির রাজনীতিতে নিজস্ব বলয় তৈরির পাশাপাশি প্রতিটি থানা ও ওয়ার্ডে দলকে শক্তিশালী করার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল খোকার।
২০০২ সালের ২৫ এপ্রিল অবিভক্ত ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে তিনি মেয়র নির্বাচিত হন। পাশাপাশি খোকাকে সভাপতি ও আবদুস সালামকে সাধারণ সম্পাদক করে ঢাকা মহানগর বিএনপির কমিটি গঠন করা হয়।
সাদেক হোসেন খোকার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক রেজা কিবরিয়া। তাঁরা সদ্য প্রয়াত খোকার পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন।
সাদেক হোসেন খোকার মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও বিরোধী দলীয় উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের। তিনি আজ এক শোক বার্তায় প্রয়াত মেয়র সাদেক হোসেন খোকার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেছেন। পাশাপাশি শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনাও জানিয়েছেন কাদের।
শোক বার্তায় জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান আরও বলেন, দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সাদেক হোসেন খোকার অবদান অক্ষয় হয়ে থাকবে। একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবেও তিনি সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করেছিলেন।
সাদেক হোসেন খোকার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন। বিবৃতিতে খোকন মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন সেই সঙ্গে তাঁর পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।
খোকার মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি কাদের সিদ্দিকী। এক শোকবার্তায় কাদের সিদ্দিকী বলেন, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ ভূমিকার জন্য সাদেক হোসেন খোকা বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক জনগণের কাছে সব সময়ই স্মরণীয় ও বরণীয়। জীবনসায়াহ্নে তার মতো একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার মাতৃভূমিতে অবস্থানের আকুতি পুরো জাতিকে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। তিনি সাদেক হোসেন খোকার মাগফেরাত কামনা করে শোকাহত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন।
সাদেক হোসেন খোকার মৃত্যুতে অনুরূপ শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা।