বাংলাদেশি শিল্প-সংস্কৃতির গভীরে যত যাবেন আপনি ততই বিস্মিত হবেন এর ভান্ডারে থাকা বাংলাদেশি রত্নগুলোকে দেখে। আফসোস হবে এসব রত্নগুলোকে বাংলাদেশের শিল্প সংস্কৃতির ব্র্যান্ডিং করতে না পারার। তেমনই এক বাংলাদেশি রত্ন সম্পর্কে এই লেখাটি।
‘সুখে থেকো ও আমার নন্দিনী’ … এই গানটির কথা মনে পড়লেই মনে পড়ে যায় সাদা প্যান্ট, সাদা সু ও সাদা টি-শার্ট পরা এক তরুণ কণ্ঠশিল্পীর কথা। তার চেয়েও বেশি মনে পড়ে যায় বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় একজন নায়কের কথা। যিনি এই গানটির গায়ক তিনি যতটা না গায়ক হিসেবে মানুষের কাছে জনপ্রিয় তার চেয়ে বেশি চলচ্চিত্র অভিনেতা হিসেবে জনপ্রিয়। অর্থাৎ যিনি গায়ক তিনিই নায়ক ।
আমার অগ্রজ-অনুজরা নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন আমি কার কথা বলছি? তিনি আমাদের বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের চিরসবুজ নায়ক জাফর ইকবাল। তিনি ছিলেন সেই সময়ের সবচেয়ে ফ্যাশন সচেতন ও স্টাইলিস্ট নায়ক ।যিনি শুধু একজন জনপ্রিয় চিত্রনায়কই ছিলেন না ছিলেন একজন গায়কও।
জাফর ইকবাল শুধুই একজন ‘স্টাইলিশ’ কিংবা ‘ফ্যাশনেবল’ হিরো হিসেবে রয়ে গেছেন দর্শকদের মাঝে যেখানে চলচ্চিত্রে জাফরের প্রায় ১০ বছরের জুনিয়র অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন হয়েছিলেন ‘সুপারস্টার’ অভিনয় জীবনের শুরুতে খলনায়ক থেকে পরে নায়ক হওয়া জসিম হয়েছিলেন ‘অ্যাকশন কিং’ আর ১৫ বছরের জুনিয়র অভিনেতা মান্না হয়েছিলেন ‘মহানায়ক’ । জাফর ইকবাল সারাজীবন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের বহুমুখী প্রতিভার এক অবহেলিত নায়ক হিসেবেই রয়ে গেলেন যার দায়টা প্রযোজক, পরিচালক , দর্শকদের চেয়ে জাফর ইকবালের নিজের ।
বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের সোনালী সময়ে যারা নিজেদের উজ্জ্বলতায় চলচ্চিত্রকে উজ্জ্বল করেছেন তাদের অন্যতম একজন জাফর ইকবাল। তিনি বাংলাদেশের গানের কিংবদন্তী সুরকার আনোয়ার পারভেজ এর ছোট ভাই ও কিংবদন্তী কণ্ঠশিল্পী শাহনাজ রহমতউল্লাহ’র বড় ভাই।
১৯৫০ সালের ২৫ শে সেপ্টেম্বর ঢাকায় জন্মগ্রহন করা জাফর ইকবালের শুরুটা গান দিয়ে। ভাই বোনের মতো নিজেও গান গাইতে ভালোবাসতেন। তিনি ভালো গীটার বাজাতেন। সেই সময়কার বিখ্যাত গায়ক এলভিস প্রিসলির দারুন ভক্ত ছিলেন। তাই তো চলনে-বলনে এলভিস প্রিসলিকে অনুকরণ করতেন।
গানের প্রতি ভালোবাসা থেকেই ১৯৬৭ সালে বন্ধু তোতা, মাহমুদ ও ফারুক’কে নিয়ে গঠন করেছিলেন ব্যান্ড দল ‘রাম্বলিং স্টোনস’।সেই সময়ে ব্যান্ড নিয়ে দারুন ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
১৯৬৮ সালে হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে( সাবেক রুপসী বাংলা) আইওলাইটস,
উইন্ডিসাইট অব কেয়ার, লাইটনিংস এর সাথে জাফর ইকবালের ব্যান্ড ‘রাম্বলিং স্টোনস’একটি প্রতিযোগিতায়
অংশ নেয়। ১৯৬৯ সালে একটি গানের অনুষ্ঠানে মঞ্চে জাফর ইকবালকে দেখে বাংলা চলচ্চিত্রের
প্রবাদ পুরুষ খান আতাউর রহমানের মনে ধরে যায় এবং তিনি অনুষ্ঠান শেষে জাফর ইকবালকে চলচ্চিত্রে
অভিনয় করার প্রস্তাব দেন। সেই বছরেই খান আতাউর রহমান পরিচালিত ‘আপন পর’ ছবির মাধ্যমে চিত্রনায়িকা
কবরীর বিপরীতে নায়ক হিসেবে পর্দায় আগমন ঘটে চিত্রনায়ক জাফর ইকবালের।
এরপর যুদ্ধ শুরু হলে জাফর ইকবাল মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। যুদ্ধ শেষে আবার চলচ্চিত্রে অভিনয়ে যোগ দেন। স্বাধীনতার পর জাফর ইকবাল সবার নজর কাড়েন ইবনে মিজান পরিচালিত ‘এক মুঠো ভাত’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। পরিচালক ইবনে মিজান রাজেশ খান্না অভিনীত ‘রুটি’ ছবিটির হুবহু অনুকরণ করে ‘এক মুঠো ভাত’ তৈরি করেন যেখানে রাজেশ খান্নার চরিত্রটি করেন জাফর ইকবাল। এই ছবির ‘শোন ভাইরা তোমরা শোন/ এমন একজন মানুষ আনো’ গানটি খুব জনপ্রিয়তা পায় । প্রথম থেকেই জাফর ইকবাল চলচ্চিত্রে অভিনয় ও ফ্যাশন সবদিক দিয়ে নিজেকে আলাদাভাবে তুলে ধরেন। জাফর ইকবাল ছিলেন তার সময়কার নায়কদের মধ্যে সবচেয়ে আধুনিক ফ্যাশন সচেতন নায়ক।তিনি ছিলেন সেই সময়ে তরুনদের ফ্যাশন আইকন ।
পরিবারের সাথে সিনেমাহলে ছবি দেখতে যাওয়ায় সেই শিশু বয়সেই অভিনেতা জাফর
ইকবালের সাথে আমার পরিচয় হয়। যতদূর মনে পড়ে জাফর ইকবালকে আমি প্রথম দেখি প্রয়াত দারাশিকো
পরিচালিত ‘ফকির মজনু শাহ’ ছবিতে। এই ছবির গানগুলো ছিল দারুন। তখন এতো
কিছু বুঝতাম না। ধীরে ধীরে জাফর ইকবালকে আরও দেখতে থাকি এবং মুগ্ধ হই। আমার কাছে জাফর
ইকবাল মানে কালজয়ী অনেক গানে অভিনয় করা প্রিয় একটি মুখ।সেই আশির দশকেই দেখেছিলাম প্রয়াত
বেলাল আহমেদ পরিচালিত ‘নয়নের আলো’ ছবিটি। ছবিতে গ্রামের একজন বাউলের ছেলে বাউল
শিল্পী হিসেবে অভিনয় করেন। একঘরে করে দেয়া অসুস্থ মায়ের পাশে বসে গেয়েছিলেন ‘আমার সারাদেহ খেয়ো গো মাটি / এই চোখ দুটো
তুমি খেয়ো না’ গানটি। যা আজ ও
বাংলার গানপাগল মানুষের মুখে মুখে।
এরপর জাফর ইকবালকে দেখেছি আরও অনেক রুপে অনেক ছবিতে। কখনও প্রেমিক, খনও পুলিশ অফিসার,কখনও
মাস্তান ,কখনও পিতৃহত্যার প্রতিশোধপরায়ণ এক সন্তান, কখনও ডাক্তার, কখনও ভিখারি,কখনও
গায়ক রুপে। সব ছবিতেই জাফর ইকবাল নিজের মতো করে। জাফরকে আমার ব্যক্তিগত ভাবে যেসব ছবিতে
বেশি ভালো লেগেছে সেগুলো হলো আশীর্বাদ, বেদ্বীন, মিসলংকা,আদেশ, ওগো বিদেশিনী, সিআইডি,অপেক্ষা
,উছিলা, অবদান,ভাইবন্ধু,প্রতিরোধ,যোগাযোগ, অবুঝ হৃদয়,গর্জন,চোরের বউ,গৃহলক্ষ্মী, লক্ষ্মীর
সংসার, সন্ত্রাস, বন্ধু। আদেশ ,ভাইবন্ধু ছবিতে কাঞ্চনের সাথে দুর্দান্ত অভিনয় করেন।
বিশেষ করে ভাইবন্ধু ছবিতে অন্ধ ভিখারি থেকে পর্দার আড়ালে থাকা এক গায়কের চরিত্রে দারুন
অভিনয় করেন।অপেক্ষা ছবিতে মায়ের আদর বঞ্চিত থাকা পিতার কাছে বড় হওয়া এক যুবক যাকে ছোট
বেলায় তাঁর বাবা আলমগীর ধনাঢ্য পরিবারের কন্যা শাবানার কাছ থেকে রাতের আঁধারে চুরি
করে নিজের কাছে নিয়ে আসেন। গর্জন ছবিতে প্রথমে শহরের নাম করা মাস্তান যুবক যে পরবর্তীতে
একজন পুলিশ অফিসার হিসেবে জীবন শুরু করে। মাস্তান ও পুলিশ অফিসার দুটো চরিত্রেই জাফর
ছিলেন সফল। গাজী মাজহারুল আনোয়ারের ‘সন্ধি’ ছবিতে সুচরিতার
সাথে ‘জয় আবাহনী , জয় মোহামেডান’ গানটির পর দর্শকরা মনে করেছিল জাফর ইকবাল
বুঝি মোহামেডান এর সমর্থক। ববিতার সাথে তাঁর জুটি সেই সময়ে বেশ জনপ্রিয় ও আলোচিত ছিল।
এক সময় জাফর ইকবাল ও ববিতার সম্পর্ক নিয়ে দর্শক ও ভক্তদের মাঝে গুঞ্জন উঠে। আজহারুল
ইসলাম খান পরিচালিত ‘অবুঝ হৃদয়’ ছবিতে জাফর ইকবাল ও ববিতার রোমান্টিক দৃশ্যগুলো
সেই গুঞ্জনকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। ‘অবুঝ হৃদয়’ ছবিতে ববিতা ও চম্পা
দুই বোনের বিপরীতে নায়ক হিসেবে অভিনয় করেছিলেন এবং দুজনের বিপরীতেই দারুন মানিয়ে গিয়েছিলেন।
জুটি হিসেবে শুধু ববিতা নয়,চম্পা,সুচরিতা,রাণী, দিতি সবার সাথেই দর্শক তাঁকে পছন্দ
করেছিল।
লেখার মাঝখানে বলছিলাম ছায়াছবির কিছু কালজয়ী গানের কথা। সেই গানের কথায় আবারো ফিরে আসি। প্রয়াত সঙ্গীত শিল্পী বশির আহমেদ এর বিখ্যাত ‘পিঞ্জর খুলে দিয়েছি / যা কিছু বলার ছিল বলে দিয়েছি’ গানটি আজো শ্রোতারা গায়। সেই গানটি ছিল জাফরের প্রথম ছবি ‘আপনপর ’ ছবির গান যা লিখেছিলেন ও সুর করেছিলেন খান আতাউর রহমান। গানটি যখন মনে হয় তখন মনে পড়ে যায় জাফর ইকবাল এর কথা। ঠিক তেমনি এন্ড্রু কিশোরের কণ্ঠে ‘আমার বুকের মধ্যখানে’ , ‘আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন’ , ‘এই আছি এই নাই’ গানগুলো মনে পড়লে মনে পড়ে যায়। গানগুলোর দৃশ্যে ছিলেন জাফর ইকবাল।একই ভাবে ‘আশীর্বাদ’ ছবির ‘চাঁদের সাথে আমি দিবো না তোমার তুলনা’, ‘ওগো বিদেশিনী’ ছবিতে ‘ওগো বিদেশিনী তোমার চেরি ফুল নাও’ , ‘প্রেমিক’ ছবিতে ‘ফুল ফোটা ফাগুনে’ , ‘মন পোড়া আগুনে’, ভাইবন্ধু ছবির ‘অন্ধ হয়ে থেকো না কেউ’ , ‘ভেঙ্গেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানা’, ‘যোগাযোগ’ ছবির ‘সকালটা যে তোমার বিকেলটা যে আমার’, প্রতিরোধ ছবির ‘শোন সোমা একটু দাঁড়াও’ , ‘কথা শুনে যাও’ , ‘উছিলা’ ছবিতে ‘কত যে তোমাকে বেসেছি ভালো’ , ‘সে কথা তুমি যদি জানতে’ ,বন্ধু আমার ছবিতে ‘একটাই কথা আছে বাংলাতে’ দারুন সব গানগুলোর কথা মনে পড়লেই মনে পড়ে যায় জাফর ইকবালের কথা।
লেখার শুরুতেই বলেছিলাম জাফর ইকবালের নিজের কণ্ঠের গানের কথা। মজার ব্যাপার হচ্ছে জাফর ইকবাল কোনদিন কারো কাছে গান শেখেননি। বড় ভাই আনোয়ার পারভেজ ও বোন শাহনাজ রহমতউল্লাহর দেখাদেখি নিজেও গান গাওয়ার চেষ্টা করতেন এবং কোথাও গান না শিখেও খুব ভালো গাইতে পারতেন। চলচ্চিত্রে ব্যস্ত হয়ে যাওয়ায় সেই কণ্ঠশিল্পীর ক্যারিয়ার আর গড়া হয়নি তারপরেও তিনি মাঝে মাঝে গান গেয়ে শ্রোতাদের মন কেড়েছিলেন। ফকির মজনু শাহ’ ছবিতে রুনা লায়লার সাথে প্লেব্যাক করেছিলেন আলাউদ্দিন আলির সুর ও সঙ্গীত পরিচালনায়। বদনাম ছবিতে বড় ভাই আনোয়ার পারভেজ এর সুরে ‘হয় যদি বদনাম হোক আরও ’ গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন যা ছবিতে নায়করাজ রাজ্জাক ঠোঁট মেলান। নিজের কণ্ঠে ‘কেন তুমি কাঁদালে’ শিরোনামে একটি অডিও অ্যালবাম প্রকাশ করেন আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে।জাফর ইকবালের হারিয়ে যাওয়া সেই একমাত্র অ্যালবামটি প্রায় তিন দশক পর অনলাইনে আমি প্রকাশ করে নতুন প্রজন্মের শ্রোতাদের শুনিয়েছিলাম যারা তখন প্রথম জেনেছিল নায়ক জাফর ইকবাল গানও করতেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনের স্বর্ণালী যুগে ‘সুখে থাকো নন্দিনী’ গানটি গেয়ে দারুন জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। এরপর বাংলাদেশ টেলিভিশনের ২৫ বছর (রজত জয়ন্তী) উদযাপন বিশেষ অনুষ্ঠানে গেয়েছিলেন ‘এক হৃদয়হীনার কাছে হৃদয়ের দাম কি আছে’ গানটি যা পরবর্তীতে শিল্পী রফিকুল আলমও গেয়েছিলেন। জাফর ইকবালের শেষ গানটি প্রচারের পর ভক্তরা মনে করেছিলেন ববিতার সাথে হয়তো সম্পর্ক বিচ্ছেদের কারনে তিনি ঐ গানটি গেয়েছিলেন। অর্থাৎ জাফর ইকবালকে নিয়ে ভক্ত দর্শকদের আলোচনা,সমালোচনা ও আগ্রহের কোন কমতি ছিল না।
এবার আসি একটু অন্য প্রসঙ্গে বা জাফর ইকবাল নিয়ে একটা আক্ষেপের বিষয়ে- জাফর ইকবালের চলচ্চিত্রের আগমন ঠিক স্বাধীনতা যুদ্ধের কিছু আগে। তখন পুরো চলচ্চিত্র ছিল রাজ্জাকময়। আলমগীর, ফারুক, বুলবুলরাও তখনও থিতু হোননি। স্বাধীন বাংলাদেশে চলচ্চিত্র শিল্পের বিকাশ ও বিস্তৃতি যখন ঘটে তখন রাজ্জাকের পাশাপাশি আলমগীর, ফারুক, বুলবুলরা থিতু হতে লাগলেন অন্যদিকে আগমন ঘটে সোহেল রানা, উজ্জ্বল, ওয়াসিমের মতো একাধিক তরুণ যার কিছুদিন পর ‘বসুন্ধরা’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে আগমন ঘটে ইলিয়াস কাঞ্চনের। ইলিয়াস কাঞ্চন আসার আগ পর্যন্ত আলমগীর মধুমিতা, মাটির মানুষ, ঝুমকা, মনিহার, ফারুক লাঠিয়াল, সারেং বউ এর মতো চলচ্চিত্র দিয়ে দর্শকদের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে জাফর ইকবাল তখনও একক নায়ক হয়ে তেমন সাফল্য পাননি। কিন্তু জাফর ইকবালকে অন্যদের চেয়ে একটু বেশি মেধাবী মনে হতো। ৭০-৮০-এর দশক স্বাধীন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সময় যখন সারাদেশে চলচ্চিত্র শিল্প বেশ নাড়া দিয়েছে এবং সিনেমা হলের সংখ্যাও দিনকে দিন বাড়ছিল। এই এক দশকে জাফর ইকবালের উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের দিকে তাকালে দেখবেন বেলাল আহমেদের নয়নের আলো, আজহারুল ইসলাম খানের অবুঝ হৃদয় , গাজী মাজহারুল আনোয়ারের সন্ধি, যোগাযোগ, ইলতুতমিশের মাই লাভ, প্রেমিক ব্যতীত একক বা কেন্দ্রীয় নায়ক হিসেবে চলচ্চিত্রের সংখ্যা নেই বললেই চলে। একই সময়ে জাফর ইকবালের অভিনীত ব্যবসাসফল চলচ্চিত্রগুলো ফকির মজনু শাহ’, ‘ বেদীন’, দিলিপ বিশ্বাসের ‘ আশীর্বাদ’, ‘অপেক্ষা’, ‘অবদান’, ‘গর্জন’, ‘বিস্ফোরণ’, ‘ভাইবন্ধু’, ‘ সাহস’, ‘আদেশ’, ‘প্রতিরোধ’, ‘উসিলা’, ‘সাজানো বাগান ‘, ‘ আকর্ষণ’, ‘লায়লা আমার লায়লা’, ‘জবাব চাই ‘, ‘মিসলংকা’র মতো চলচ্চিত্রগুলোতে ছিল আলমগির, জসিম, ইলিয়াস কাঞ্চন, উজ্জ্বল , ওয়াসিম , ফারুক, সোহেল রানা’র মতো অন্য জনপ্রিয় নায়কেরা যেখানে জাফর ইকবালের চরিত্রের চেয়ে অন্যদের গুরুত্ব একটু বেশী ছিল । অর্থাৎ জাফর ইকবাল ছবিতে থাকলেও কিংবা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে থাকলেও উল্লেখিত চলচ্চিত্রগুলোতে দর্শকদের কাছে জাফর ইকবালের চেয়ে অন্যদের জনপ্রিয়তা বেশী ছিলো এবং চলচ্চিত্রগুলো ব্যবসা সফল হওয়ার পেছনে কৃতিত্বটা কখনও আলমগির, কখনও কাঞ্চন , কখনও জসিমের উপর গিয়ে পড়েছে। এমনকি সন্ধি , যোগাযোগ চলচ্চিত্রে জাফর ইকবাল খুব ভালো অভিনয় করলেও চলচ্চিত্রগুলোর সাফল্যর কৃতিত্বটা ‘বুড়ো’ রাজ্জাকের উপর পড়েছিল । দারাশিকোর ‘’ভাইবন্ধু’ চলচ্চিত্রে জাফর ইকবালের খুব গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ছিল এবং অভিনয়ও দারুন ছিল কিন্তু ‘’ভাইবন্ধু’ চলচ্চিত্রের সাফল্যর পেছনে ইলিয়াস কাঞ্চনের চরিত্র ও অনবদ্য অভিনয়কেই সবাই কৃতিত্ব দিবে আগে কারণ ছবিটি দেখলে যে কেউই মনে করবে ‘’ভাইবন্ধু’’ রুপে এখানে ইলিয়াস কাঞ্চনকেই বুঝানো হয়েছে কারণ ছবির গল্পে কাঞ্চনই পথে ভিক্ষা করা অন্ধ জাফর ইকবালকে রাস্তা থেকে তুলে এনে অন্য এক জীবন দিয়েছিলেন কাঞ্চন এবং একেবারে শেষ দৃশ্যর আগ পর্যন্ত কাঞ্চনই সবসময় সেক্রিফাই করে গেছে সব পরিস্থিতে। ঠিক একই রকম দর্শকদের মাঝে জাফর ইকবালের চেয়ে বেশী গুরুত্ব কাঞ্চন পেয়েছে শিবলি সাদিকের ‘’আদেশ’’, ফজল আহমেদ বেনজিরের ‘’প্রতিরোধ ‘’, জসিম পেয়েছে জহিরুল হকের ‘’সাহস’’ ‘’ গর্জন’’, হাফিজউদ্দিনের ‘’অবদান’’ , এফ আই মানিকের ‘’বিস্ফোরণ’’ চলচ্চিত্রে ।
জাফর ইকবালকে পর্দায় দেখে কখনও মনে হয়নি উনি চলচ্চিত্রের ক্যারিয়ারে খুব বেশী সচেতন ছিলেন এবং নিজের চরিত্রগুলো সম্পর্কে খুব বেশী সচেতন ছিলেন অথচ জাফর ইকবালের জনপ্রিয়তা বেশ ভালোই ছিল তখন । জাফর ইকবালকে রোমান্টিক চরিত্রের বাহিরে খুব বেশী অভিনয় করার মতো চরিত্র খুব বেশী দেখা যায়নি বা সামাজিক অ্যাকশন, কমেডি কোন ধারার চরিত্রে জাফর ইকবাল নিজেকে একাই যথেষ্ট প্রমাণ করতে পারেননি। অন্য নায়কদের সাথে জাফর ইকবালের বেশিরভাগ চরিত্র ছিল পুলিশের আর বাকী গুলোতে একই রকম রোমান্টিক চরিত্র । জাফর ইকবালের জনপ্রিয়তাটা ছিল একটা শ্রেণী নির্ভর অর্থাৎ শহুরে শিক্ষিত শ্রেণী নির্ভর যেখানে অন্য নায়কদের জনপ্রিয়তা ছিল সব শ্রেণীর দর্শকদের মাঝে যার ফলে জাফর ইকবালের প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও প্রযোজক পরিচালকরা খুব বেশী পরীক্ষা নিরীক্ষা করেননি বা জাফর ইকবালকে নিয়ে ব্যতিক্রমধর্মী কোন কিছু করার চেস্টা করেননি । জাফর ইকবালকে সবসময় একটা গণ্ডীর ভেতর রেখেই পর্দায় উপস্থাপন করা হতো । ব্যক্তিগত জীবনেও জাফর ইকবাল ছিলেন খুব বেশী বেপরোয়া ধারার জীবন যাপনে অভ্যস্ত । চলচ্চিত্র পাড়ায় জাফর ইকবালের সাথে কখনও ববিতা, কখনও চম্পাকে নিয়ে নানারকম মুখরোচক আলোচনা / স্ক্যান্ডাল সেই সময় ছড়িয়ে পড়েছিল , যার ফলে জাফর ইকবালের উপর নির্ভর করে খুব বেশী রিস্কে / ঝুঁকিতে যায়নি প্রযোজক পরিচালকরা অথচ সেই একই সময়ে ইলিয়াস কাঞ্চন , জসিমরা তরতর করে সামনের দিকে নিজেদের এগিয়ে নিয়েছিলেন রোমান্টিক, সামাজিক অ্যাকশন, ফ্যামিলি ড্রামা, ফোক ফ্যান্টাসি সহ সব ধারার চলচ্চিত্রে নিজেদের প্রমাণ যোগ্যতা প্রমাণ করে । অথচ কাঞ্চন, জসিমের চেয়েও আরও বেশী এগিয়ে যাওয়ার যোগ্যতা ছিলো জাফর ইকবালের বেশী যার সদ্ব্যবহার তিনি করতে পারেননি।
জাফর ইকবাল শুধুই একজন ‘স্টাইলিশ’ কিংবা ‘ফ্যাশনেবল’ হিরো হিসেবে রয়ে গেছেন দর্শকদের মাঝে যেখানে চলচ্চিত্রে জাফরের প্রায় ১০ বছরের জুনিয়র অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন হয়েছিলেন ‘সুপারস্টার’ অভিনয় জীবনের শুরুতে খলনায়ক থেকে পরে নায়ক হওয়া জসিম হয়েছিলেন ‘অ্যাকশন কিং’ আর ১৫ বছরের জুনিয়র অভিনেতা মান্না হয়েছিলেন ‘মহানায়ক’ । জাফর ইকবাল সারাজীবন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের বহুমুখী প্রতিভার এক অবহেলিত নায়ক হিসেবেই রয়ে গেলেন যার দায়টা প্রযোজক, পরিচালক , দর্শকদের চেয়ে জাফর ইকবালের নিজের ।
জাফর ইকবাল ছিলেন প্রচণ্ড অভিমানী ও খামখেয়ালী একজন মানুষ । ১৯৯২ সালের ৮ই জানুয়ারী এই চিরসবুজ নায়ক মৃত্যুবরণ করেন । মৃত্যুর আগে তাঁর জীবিতঅবস্থায় শেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ছিল ৩ জানুয়ারি ১৯৯২ সালে ‘‘লক্ষ্মীর সংসার’’ যে ছবিতে একটি দৃশ্য ছিল জাফর ইকবাল গ্রাম থেকে ঢাকা শহরে নতুন এসেছেন এবং ঢাকার আজিমপুর যাওয়ার রাস্তা খুঁজছিলেন । ছবিটি মুক্তির ৫দিন পর জাফর ইকবাল মৃত্যুবরন করেন এবং আজিমপুরে গোরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত হোন যা নিয়তির এক নির্মম পরিহাস । সেদিন জীবিতবস্থায় জাফর ইকবালের শেষ মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা ” লক্ষীর সংসার” এর ‘ভাই আজিমপুর যাবো কিভাবে’ সংলাপটি ভক্তদের খুব কাঁদিয়েছিল। জাফর ইকবাল চলে গেছেন আজ ২৭ বছর কিন্তু নতুন আরেকজন জাফর ইকবাল আমাদের চলচ্চিত্রে আর আসেনি এবং হয়তো আসবেও না।একজন গায়ক , নায়ক জাফর ইকবালের জন্য আমাদের আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে জানিনা ।জাফর ইকবাল বেঁচে থাকবেন তাঁর অভিনীত ছবিগুলোর মাধ্যমে চিরদিন ।
জাফর ইকবালের অ্যালবাম থেকে দুটি গান
দুখিনী বকুল – https://app.box.com/s/re9zht06ax4eccl22r4m
প্রজাপতি নাই – https://app.box.com/s/kep0n23ma5mz8qeltmkp
জাফর ইকবালের অভিনীত ছবি থেকে কিছু দৃশ্যের লিংক –
ভাইবন্ধু- https://www.youtube.com/watch…
এক মুঠো ভাত – https://www.youtube.com/watch…
সন্ধি- https://www.youtube.com/watch…
নয়নের আলো – https://www.youtube.com/watch?v=B04KdiJnpOM
নয়নের আলো –https://www.youtube.com/watch?v=ddgbUuWNHDw
আপন পর – https://www.youtube.com/watch?v=IqRpJLDYgtw