।। খাদিজাতুল কোবরা বীথি ।।
৩০ শে জানুয়ারি ১৯৮৮ ছিল আমার জন্মদিন। দিনটি ছিল বুধবার মধ্যরাত। আমার গল্পের শুরু এখানে না হলেও গল্পের পটভূমি এটাই। একজন ভালো স্বামীর গল্প, আমার বাবার গল্প, আমার ভালো বাবার গল্প। আমার সৎ ও আদর্শবান বাবার গল্প।
আমার দাদী বাড়ী বগুড়া জেলার সোনাতলা থানার ঠাকুরপাড়া গ্রামে। আমার দাদী ছিলেন জমিদারের মেয়ে আর দাদা ছিল প্রভাবশালী পরিবারের সন্তান। সেই সময় মেয়েরা এত পড়াশোনা করতে পারত না বা করানো হত না। কিন্তু আমার দাদীর ব্যক্তিত্ব ও জ্ঞান ছিল প্রখর। আমার মনে হয় দাদীর প্রজ্ঞার কিছু অংশ বাবার মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে। আমার বাবা তার সব ভাই-বোনদের মধ্যে সবচেয়ে রোগা পাতলা ছিলেন ।
বাবা আর দাদী বাড়ির সবার মুখে শোনা, দাদী সবসময় বলত, আমার এই ছেলের বউটা যে কেমন হবে? আমার ছেলেটাকে আদর করবে তো? দাদী দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলেও আল্লাহ তার ছেলের জন্য উপযুক্ত বউ পাঠিয়ে দিলেন,যাতে জান্নতুল ফেরদৌসে বসে দাদী তার ছেলের সুখ দেখতে পায়। তার রোগা,শুকনা, ঠ্যাংগা ছেলেটা সুখের সাগরে আছে। এ সুখ ছেলে-মেয়ে হিসেবে আমরা তাকে দিতে কতটুকু পেরেছি এ হিসাব শুন্য হলেও মার বেলায় তা কানায় কানায় পরিপূর্ণ।তাদের ভালোবাসা দেখে বড় হয়েছি বলেই হয়ত খারাপ কিছু এখনও ভাবতে মনে বাঁধে।
এখন বুঝি কত ঝড় গিয়েছিল আমাদের ওপর। কিন্তু এত ঝড়েও কখনও নুয়ে পড়িনি আমরা শুধুমাত্র বাবার সাহসের কারণে। সাথে ছিল শত বিপদেও হায় হুতাশ থেকে বিরত থাকা আমার অবিচল মা, স্বল্পভাষী মা।
আমার বাবা মো.আব্দুল ওয়াদুদ পি.কে. একজন অডিটর ছিলেন। সরকারী চাকরি যা ছিল হিসাব মহা নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ে। বাবা তার চাকরী জীবনের সবটাই অতিবাহিত করেছেন একজন সৎ মানুষ হিসেবে। এই সুনামের জন্য তার অবসর জীবনে সমাদরের শেষ নেই। মজার ব্যাপার হল, তার চাকরী জীবনের শুরু যেখান থেকে, চাকরী জীবনের শেষও একই জায়গা থেকে। উপজেলা হিসাব নিয়ন্ত্রক এর কার্যালয়, শিবগঞ্জ,বগুড়া। আমার মেঝ বড় আব্বা (যার মাধ্যমে বাবা মার বিয়ে হয়েছিল) ক্যান্সারে মারা যান। আমি তাকে দেখতে গেলে তার কাছে কিছুক্ষণ থাকার সুযোগ হয়েছিল।তখন তিনি মারা যাওয়ার পর বড়আম্মা একা হয়ে যাবে এ নিয়ে চিন্তা করত, তখন আমি বললাম,আপনি চিন্তা করবেন না বড়আব্বা আপনার দুইছেলে আছে,মেয়ে আছে,আপনার মেয়ের জামাই এত ভাল,ভাইয়ার মত মানুষ হয় না, আপনি চিন্তা করবেন,এত জমিজমা,শহরে এত বড় বাড়ি।কি নাই আপনার, বড় আম্মা ভাল থাকবেন। আপনি চিন্তা করবেন না। আমাদের কিছু নাই,তারপরেও আমি বাবা এত চিন্তা করি না।উনি বলল তোমার আর তোমার বাবার যা আছে তা আর কারও নাই। সততা,গুন। একজন মৃত্যু পথ যাত্রী মানুষ, যাকে এত সম্মান করি তার মুখ থেকে এ কথা শুনে আমার জন্য না হলেও বাবার জন্য গর্বে চোখে পানি চলে এসেছিল।তার ঐ কথা আমি কোনদিন ভুলবনা,এ কথা আমার বাবার জীবনে আর্শীবাদ হয়ে থাকুক। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত পিতৃতুল্য বড় ভাই এর কথা তার জীবনে শান্তি বয়ে আনুক। আমার বাবা তার সারাটা জীবন অন্যায় এর সাথে আপোষহীন ছিলেন।তার চাকরী জীবনে তার সততার পুরষ্কার ছিল তার সহকর্মীদের ভালোবাসা আর ব্যক্তিগত জীবনে পরিবার নিয়ে ভালো থাকা।বাবা বলে সৎ ভাবে বাচাঁর কারনে আজ তিনি তার “বোনাস লাইফ” পেয়েছেন। ২০০৮ সালে যখন বাবাকে ইন্ডিয়া নিয়ে যাওয়া হল, তখনও তাঁর ক্যান্সার ধরা পরেনি,তাঁর ধারনার উপর ভিত্তি করে ইন্ডিয়া নিয়ে যাওয়ার পর তাঁর ধারনা সত্যি হল,তার ক্যান্সার ধরা পরল গলায়,হারনিকেল ক্যান্সার। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বানিজ্য অনুষদে বিবিএ ২য় বর্ষে পড়ি।আমার ছোট ভাই আর মা নিয়ে আমরা তখন মাঝ দড়িয়ায়, সেই অবস্থায় ডাক্তার যখন তাকে বলল আপনার ক্যান্সার, তখন সে বলল আমার ভালো হওয়ার জন্য, বাচাঁর জন্য যা করা লাগে আপনারা তাড়াতাড়ি শুরু করে দেন,আমার বাচ্চা দুইটা ছেলে মেয়ে আছে। ডাক্তার রোগীর কি মনোবল বাড়াবে রোগীই ডাক্তার এর মনোবল বাড়াচ্ছে!
আমার বাবা একজন ভালো বাবা হওয়ার আগে একজন ভাল স্বামী! ভাল বাবা হওয়ার জন্য সন্তানের ভরনপোষন করার আগে যেটা জরুরী সেটা হল ভাল মানুষ হওয়া, ভালো স্বামী হওয়া।
তিনি সত্যিই ফিরে এলেন, জয় করলেন,এখন পর্যন্ত ভালো আছেন,বহাল তবিয়তে আছেন। তিনি শত বিপদেও ভেঙ্গে পড়েননি, আমি দেখিনি তাঁকে,তাঁকে দেখিনি মাথা নোয়াতে কারও কাছে,না বিপদের কাছে,না অসুখের কাছে,এসবই তাঁর অসীম মনোবলের কারনে।বাবা বলে এ মনোবল নাকি তাঁর সৎ জীবন যাপনের জন্য তার ভিতরে তৈরী হয়েছে।দুনিয়াতে অনেকেই আছেন যাদের মনোবল অসীম,আমি তাদের চোখে দেখিনি কিন্তু বাবাকে দেখেছি। ইন্ডিয়া থেকে ফিরে এসে তার কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি দেওয়ার পর যখন কিছুটা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেন তখন বাবা ঠিক করলেন সে দেশ দেখতে বের হবে। তার বন্ধু,সহকর্মীদের সাথে। অথচ তখনও তিনি ঠিকমত ভাত তুলে খেতে পারেন না,কোন কিছু ধরতে পারেন না,হাতটা সবসময় কাঁপে,তাঁর হাড় জিরজিরে শরীর,ঝাল কিছুই সে খেতে পারে না,পাখির মত খাওয়া দাওয়া করেন। এগুলো হল ক্যানসারের পার্শপ্রতিক্রিয়া। কিন্তু তাঁর মনোবলের অভাব নেই। তিনি অসুস্থ শরীর নিয়ে চট্টগ্রাম, বান্দরবন,সিলেট, কক্সবাজার,সেন্টমার্টিন ঘুরে আসলেন। এই অবস্থাতে তাঁর সহকর্মীরা তাকে নিয়ে একবারও ঘুরতে যেতে অস্বীকার বা বিরক্তি প্রকাশ করেনি। এগুলোতো তাঁর প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। বাবাকে যখন রেডিওথেরাপী দেওয়া হত তারপর বাবা তার জুতার লেস বাধতে পারতেন না। বাবা মাথা নিচু করতে পারতেন না। আমি লেস বেধেঁ দিতাম। বাবা রাস্তা পার হতে পারতেন না, কারন তার সবকিছুই কাঁপত তখন। আমি রাস্তা পার করতাম বাবার হাত ধরে,বাবার সাথে ওই সময় ও রাগ করেছি কারণ বাবা নাকি আমার মামীকে বলেছিল কোথায় আমার বাচ্চা মেয়েটাকে আমি রাস্তা পার করব! আমার বাচ্চা মেয়েটাই আমাকে রাস্তা পার করছে। ওই বয়সি আমি বাবা ইন্ডিয়া থেকে আসার পর সব একা সামলেছি। এখন বুঝি কত ঝড় গিয়েছিল আমাদের ওপর। কিন্তু এত ঝড়েও কখনও নুয়ে পড়িনি আমরা শুধুমাত্র বাবার সাহসের কারণে। সাথে ছিল শত বিপদেও হায়হুতাশ থেকে বিরত থাকা আমার অবিচল মা, স্বল্পভাষী মা।
আমার বাবার জীবনে অর্জন বলে কিছু নাই। সুযোগ না পেয়ে সৎ হওয়া আর অফুরন্ত সুযোগ পেয়ে সৎ হওয়া যে এক জিনিষ নয় তা বাবার কাছ থেকে শিখেছি। আমার বাবা সততার অনুশীলন করতেন, করেন এখনও।
এবার আসি আমার বাবা মার বিয়ের কথায়।আমার দাদী বাড়ি আর নানি বাড়ি বগুড়ার দুইপ্রান্তে। আমার নানি বাড়ি বগুড়া জেলার বোহাইল গ্রামে।সবাই বলত তোমার বাবা মার এত দূরে বিয়ে হল কিভাবে?আমার বড়আব্বা আর নানা একসাথে একই কলেজের প্রফেসর ছিলেন ।তার বন্ধু ছিল। সেই সুবাদে নানী বাড়ির গ্রামে এক মেয়ে দেখতে এসে সেই মেয়ে কোন কারনে না দেখতে পারায়, আমার মাকে দেখেই তাদের পছন্দ হয়ে যায়। তারপরই বিয়ে। ভাগ্যিস বিয়ে টা হয়েছিল তা না হলে এত ভাল বাবা কোথায় পেতাম! বাবা যখন বিয়ে করে তখন তিনি মাত্র ৫০০ টাকা বেতন পেতেন।সরকারী চাকরীতে সেই সময় এর চেয়ে বেশি বেতন আশা করা স্বপ্নাতীত। এই নিয়ে তাদের সংসারের শুরু। কষ্টে গড়া তাদের সংসার। কিছু ছিল না, ছিল খালি সাহস,অসীম সাহস। আমরা দুই ভাই বোন।আমরা দুই ভাই বোন এর জন্মই নানী বাড়িতে। মা বলে তোমার নারী পুঁতে রাখছি তোমার নানী বাড়িতে,এজন্য মনে হয় তোমার নানী বাড়ীর জন্য তোমার এত মায়া,এত ভালোবাসা! আমি বলি এটা হয়ত একটা কারন আরেকটা আছে সেটা হল তোমার মা (৭ বছর বয়সে আমার নানী মারা যায়)যেই মাটিতে শুয়ে আছে ওই মাটিতে আমার নারী পোঁতা আছে এজন্য মনে হয় এত ভালবাসি তোমার মায়ের বাড়ী। আর জন্মদিন যদি ভালোবাসি,তাইলে যেই বাড়িতে জন্ম নিলাম ওই বাড়ী ভালোবাসব না। মা তাকায় থাকে, বলে তুমি কি ভাল করে কথা বল। এরকম করেও এই জিনিষ নিয়ে চিন্তা কর! এসব কথা বলার সময় মা আমার জন্মের সময় এর গল্প কোনদিন করতে ভোলে না। সে তো অনেক ভালোবাসার গল্প,অনেক আদরের গল্প। সে যে এক ভালো বাবার গল্প,ভালো স্বামীর গল্প। মা বলে যেদিন তুমি হবে ওই দিন বিকালে তোমার বাবা ঢাকা থেকে আসল(আমার বাবা তখন ঢাকা এজিবিতে অডিটর ছিলেন) রাতে যখন আমাকে ডেলিভারির জন্য ঘরে ঢুকানো হল,দাইমা আসল,মুরুব্বীরা সব বাহিরে বসে আছে,অপেক্ষারত সবগুলো মানুষ। কারন তাদের ভাই বোন আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে প্রথম কোন বাচ্চা হচ্ছে নানী বাড়িতে। এর মধ্যে বাবা উঠান এর মাঝখানে দাড়াঁয় বার বার চোখ মুছতে লাগল,এটা মার নানার মুখে শোনা। বলে নাতী জামাই তুমি মন শক্ত কর,তুমি কাঁদলে আমার নাতীন তো হাসব! কাইন্দ না; তোমার বউয়ের কিছুই হবে না। জামাই বস,ওরে কেউ পানি দাও,চেঁয়ার দাও। আমার বাবা মাঝ রাত পযর্ন্ত উঠানের মাঝখানে দাঁড়ানো কখন আমার মাকে দেখতে পাবে,যদি কিছু হয়ে যায়। সব মামারা,খালারা তখন কি হবে, কি হচ্ছে সব বাদ দিয়ে বাবাকে বলছে দুলাভাই আপা ভাল আছে।
যখন আমি হলাম তখন দাইমা বলল বাচ্চা প্রথম কে কোলে নিবে,বাবা বাহিরে তখন দাড়ানো,আমি নিব বলেছিলেন তিনি। মার নানা বলেছিলেন, দাও ওরেই দাও। ওর জানটা ঠান্ডা হোক। মা বলে যখন দেখলাম, সদ্য নাড়ী কাটা রক্ত টাও ঠিকমত মোছা হয় নাই, এরকম তোমাকে তোমার বাবার কোলে তুলে দেওয়া হল,তোমাকে কোলে নিয়ে তোমার বাবা কাদছিলেন, একবার আমাকে দেখে,একবার তোমাকে। তখন মনে হল এটা মাঝরাত না এটা সকালের আলো! মা বলে তুমি হওয়াতে আমার কষ্ট হয়নাই,তোমার বাবার কারনে, কারন আমি শরীরে কষ্ট পাইলেও সেই কষ্টের ভাগ তোমার বাবা আমার থেকে বেশী নিয়েছিল মনে। সত্যিই কোন বাবাকে সত্যিকারের বাবা হতে হলে আগে সত্যিকারের স্বামী হতে হয়। মার প্রতি ভালোবাসাই বাবাকে আরও বেশি ভালোবাসতে আগ্রহী করে তোলে। মার মুখ থেকে এই গল্প বারবার শুনতে ভালোলাগে, আর এই গল্প যখন বারবার করে তখন তার মুখ থেকে যে আলো বের হয় তা অমূল্য। তখন মনে হয় বাবার মেয়ে হয়ে জন্ম নেয়া স্বার্থক। মায়ের মাতৃত্ব পূর্ন হয়েছে বাবার ভালোবাসায় আমাকে দিয়ে। হুমায়ূন আহমেদ স্যার বলে গেছেন পৃথিবীতে খারাপ স্বামী থাকলেও একজন খারাপ বাবা পাওয়া যাবে না। কিন্তু সেই বাবাকে আমি কিভাবে ভালবাসবো যে আমাকে দুনিয়াতে আনল তাকে ভালোবাসে না,তাঁকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান টা দিল না! আমার বাবা একজন ভালো বাবা হওয়ার আগে একজন ভাল স্বামী! ভাল বাবা হওয়ার জন্য সন্তানের ভরনপোষন করার আগে যেটা জরুরী সেটা হল ভাল মানুষ হওয়া, ভালো স্বামী হওয়া।
আমার বাবার জীবনে অর্জন বলে কিছু নাই। সুযোগ না পেয়ে সৎ হওয়া আর অফুরন্ত সুযোগ পেয়ে সৎ হওয়া যে এক জিনিষ নয় তা বাবার কাছ থেকে শিখেছি।আমার বাবা সততার অনুশীলন করতেন, করেন এখনও।
পুনশ্চঃ আমার সব জন্মদিন আমার বাবার কমন ডায়লগ আছে,সেটা হল আজ কি কোন ইমপ্রুভ ডায়েট এর ব্যবস্থা করেছ? কারণ ২০০৭ থেকে বাড়ির বাহিরে। এইবারও সে একই ডায়লগ দিতে ভোলে নি! হা হা হা!!!