:: ক্রীড়া প্রতিবেদক ::
ফেডারেশন কাপের শ্বাসরুদ্ধকর ফাইনালে টাইব্রেকারে আবাহনী লিমিটেডকে হারিয়ে ১৪ বছর পর চ্যাম্পিয়ন মোহামেডান।
কুমিল্লার ভাষা শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়ামে দুই দলের ফেডারেশন কাপ ফুটবলের ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আবাহনী ও মোহামেডান। নির্ধারিত সময়ে খেলা শেষ হয় ৩-৩ সমতায়। ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। সেখানে দুই দলই করে একটি করে গোল। ফলে ৪-৪ সমতায় শেষ হয় আবাহনী-মোহামেডান ফাইনালের অতিরিক্ত সময়।
এর আগে ম্যাচের ১৬ মিনিটে ফয়সাল আহমেদ ফাহিম ও ৪৪ মিনিটে কলিন্দ্রেসের গোলে এগিয়ে বিরতিতে গিয়েছিল আবাহনী। দ্বিতীয়ার্ধের ১১ মিনিটে মোহামেডানের হয়ে স্কোরশিটে নাম তোলেন সোলেমান দিয়াবাতে। ম্যাচের ৬০ মিনিটে তার গোলেই সমতায় ফেরে দলটি। ৬৬ মিনিটে এমেকা গোল করলে ম্যাচ ঝুঁকে পড়ে আবাহনীর দিকে। ম্যাচের ৮৩ মিনিটে আবারও গোল করে নিজের হ্যাটট্রিক পূর্ণ করে দিয়াবাতে ম্যাচ নিয়ে যান অতিরিক্ত সময়ে।
ম্যাচের অতিরিক্ত সময়ে দিয়াবাতের চতুর্থ গোলে ম্যাচে এগিয়ে যায় মোহামেডান। ওই লিড অবশ্য ধরে রাখতে পারেনি সাদা কালো জার্সিধারীরা। রহমতের গোলে শেষবারের মতো সমতায় ফেরায় আবাহনী। দুই দল একটি করে গোল করে আরও মরিয়া হয়ে ওঠে গোলের জন্য। শেষ পর্যন্ত তা আর পারেনি দুই দলের কেউই। তাই খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে। সেখানে পারেনি আবাহনী। ৪-২ ব্যবধানে হেরেছে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মোহামেডানেরে কাছে।
৮ গোলের ম্যাচে গোলের সূচনাটা করেন ফয়সাল আহমেদ ফাহিম। ১৬ মিনিটে এমেকা ওগবাহর থ্রু পাস ধরে বাঁ পায়ের কোনাকুনি শটে জাল খুঁজে নেন ফাহিম। এই গোলের পরই গ্যালারিতে আবাহনী সমর্থকেরা পটকা ফোটাতে শুরু করেন!
আবাহনীকে ম্যাচে দ্বিতীয়বারের মতো এগিয়ে দেন কোস্টারিকান ফরোয়ার্ড দানিয়েল কলিন্দ্রেস। ৪৩ মিনিটে হৃদয়ের লং পাস নিয়ন্ত্রণ নেওয়া কলিনদ্রেসকে আটকাতে পারেননি মোহামেডানের ডিফেন্ডার হাসান মুরাদ। ডান পায়ের দারুণ শটে সুজনকে এবার পরাস্ত করেন কোস্টারিকার ফরোয়ার্ড।
প্রথমার্ধে কোণঠাসা মোহামেডানকে দ্বিতীয়ার্ধে জাগিয়ে তোলেন সুলেমান দিয়াবাতে। বিরতি থেকে ফিরে দ্বিতীয় মিনিট থেকেই আক্রমণে মোহামেডান। বলতে গেলে ম্যাচে এটাই তাদের প্রথম সুযোগ। উজবেক মিডফিল্ডার মুজাফফরজন মুজাফফরভের ফ্রিকিক মানবদেয়ালে প্রতিহত হলে ফাঁকায় বল পেয়েছিলেন সুলেমান দিয়াবাতে। মোহামেডান অধিনায়কের শট কর্নারের বিনিময়ে ফেরান আবাহনীর এক খেলোয়াড়। ৫২ মিনিটে আবারও সুযোগ মোহামেডানের। এবার ইমানুয়েল সানডের শট চলে যায় পোস্টের বাইরে দিয়ে।
তবে আক্রমণাত্মক ফুটবলে মাত্র চার মিনিটের ব্যবধানে জোড়া গোলে মোহামেডানকে সমতায় ফেরান সুলেমান দিয়াবাতে। ৫৬ মিনিটে বক্স বরাবর কামরুল ইসলামের শটে বল বিপদমুক্ত করতে ব্যর্থ হন রহমত মিয়া। ফাঁকায় বল পান দিয়াবাতে। তাঁর প্লেসিং শট আবাহনী গোলরক্ষক শহীদুল আলম সোহেলকে ফাঁকি দিয়ে জড়ায় জালে।
প্রথম গোলের চার মিনিট পর আবারও সুলেমান জাদু। ৬০ মিনিটে বক্সের বাইরে থেকে মুজাফফরভের শট ফিস্ট করে ফেরান আবাহনী গোলরক্ষক সোহেল। তাঁর ফিস্টে বক্সের বাঁ প্রান্তে বল পান জাফর ইকবাল। জাফরের শট থেকে লাফিয়ে হেডে বল জালে জড়িয়ে মোহামেডান সমর্থকদের উল্লাসে ভাসান মালিয়ান ফরোয়ার্ড।
সমতা ফিরতেই জমে ওঠে ম্যাচ। পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে আবাহনীর আক্রমণও। ৬৫ মিনিটে এমেকা ওগবাহর হেডে বল ফেরে ক্রসবারে লেগে। পরের মিনিটেই গোল করে সেই আক্ষেপ মেটান আবাহনীর নাইজেরিয়ান ফরোয়ার্ড। ফয়সাল আহমেদ ফাহিমের শট ঝাঁপিয়ে ফিস্ট করেছিলেন মোহামেডান গোলরক্ষক সুজন হোসেন। সুযোগের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলেন ওগবাহ। সুজনের গ্লাভসে লেগে ফিরে আসা বলে আলতো টোকায় বল জড়ান জালে।
মোহামেডানকে আবারও সমতায় ফেরানোর সুযোগ পেয়েছিলেন সুলেমান দিয়াবাতে। সুযোগ ছিল হ্যাটট্রিকেরও। ৭৫ মিনিটে জাফর ক্রস থেকে সুলেমানের হেড সাইডবার দিয়ে চলে যায় বাইরে।
কিন্তু ৮৩ মিনিটে সুলেমানকে আর আটকাতে পারেনি আবাহনী। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের রক্ষণ ভেঙে ঠিকই তুলে নিয়েছেন হ্যাটট্রিক। খেলায় ফেরান প্রাণ। কামরুল ইসলামের কর্নার থেকে সুলেমানের হেড দাঁড়িয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না আবাহনী গোলরক্ষকের।
নির্ধারিত ৯০ মিনিটের অন্তিম সময়ে ম্যাচটা প্রায় জিতেই নিয়েছিল আবাহনী। কিন্তু অধিনায়ক রাফায়েল অগুস্তোর শট আটকে দেন বদলি নামা ডিফেন্ডার রাজীব হোসেন। খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে।
অতিরিক্ত সময়ের প্রথম আক্রমণটা মোহামেডানের। ৯২ মিনিটে ইমানুয়েল সানডের শট ঠেকিয়ে দেন আবাহনী গোলরক্ষক। অবদান কম নয় মোহামেডান গোলরক্ষক সুজন হোসেনেরও। মাত্র এক মিনিটে দুটি দারুণ সেভে দলকে রক্ষা করেন মোহামেডান গোলরক্ষক। ৯৫ মিনিটে রাফায়েল অগুস্তোর শট কর্নারের বিনিময়ে ফেরান সুজন। দানিয়েল কলিন্দ্রেসে কর্নার থেকে বদলি ডিফেন্ডার আসাদুজ্জামান বাবলুর হেডও একইভাবে ঠেকিয়ে দেন সুজন।
অতিরিক্ত সময়ের যোগ করা সময়ে বড় ভুল করে বসেন আবাহনী গোলরক্ষক সোহেল। বল পায়ে ছুটতে থাকা সুলেমান দিয়াবাতেকে ফেলে দেন আবাহনী গোলরক্ষক, পেনাল্টির বাঁশি বাজান রেফারি আলমগীর সরকার। স্পট কিকে নিজেই শট নিয়ে প্রথমবারের মতো মোহামেডানকে এগিয়ে দেন মালিয়ান ফরোয়ার্ড।
ম্যাচ শেষ হওয়ার চার মিনিট আগে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা খায় মোহামেডান। পুরো ম্যাচে দুর্দান্ত খেলতে থাকা গোলরক্ষক সুজন চোট নিয়ে মাঠ ছাড়েন কাঁদতে কাঁদতে। সুজনের বদলি হিসেবে মাঠে নামেন আহসান হাবিব।
মোহামেডানের দুর্বলতাকে দারুণভাবে কাজে লাগিয়ে মাত্র তিন মিনিট আগে অসাধারণ এক গোলে আবাহনীকে ম্যাচে ফেরান রহমত মিয়া। ১১৭ মিনিটে বক্সের বাইরে থেকে রহমত মিয়ার বুলেট গতির শট ঝাঁপিয়েও ঠেকাতে পারেননি বদলি গোলরক্ষক আহসান। শিরোপার নিষ্পত্তির জন্য খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে।
টাইব্রেকারে প্রথম শটে মোহামেডানকে এগিয়ে দেন সুলেমান দিয়াবাতে। আবাহনীর হয়ে প্রথম শট নিতে আসেন রাফায়েল অগুস্তো, কিন্তু নষ্ট করেন শট। মোহামেডানের হয়ে একমাত্র শটটি নষ্ট করেন শাহরিয়ার ইমন। আবাহনীর হয়ে দ্বিতীয় শটটি নষ্ট করেন দানিয়েল কলিন্দ্রেস। শেষ শটে কামরুল ইসলাম বল জালে জড়ালে দীর্ঘ অপেক্ষার পর শিরোপার উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠেন মোহামেডানের সমর্থকেরা।
এর আগে ২০১৫ সালে সর্বশেষ অতিরিক্ত সময়ে গড়িয়েছিল ফেডারেশন কাপের ফাইনাল। সেবার শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব ও শেখ রাসেলের ম্যাচ গড়িয়েছিল টাইব্রেকারে। এর আগে ফেডারেশন কাপের লড়াই টাইব্রেকারে নিয়েছিল আবাহনী ও মোহামেডান। ২০০৯ সালে টাইব্রেকারে আবাহনীকে হারিয়ে ফেডারেশন কাপের শিরোপা জিতেছিল মোহামেডান। সাদা কালো জার্সিধারীরা সর্বশেষ শিরোপা জিতেছিল ২০১১ সালে। সুপার কাপের ফাইনালে আবাহনীকে হারিয়ে শিরোপা জেতে তারা।
এই শিরোপায় ৯ বছরের দীর্ঘ শিরোপা খরাও কেটেছে সাদা-কালো শিবিরের। ২০১৪ সালের স্বাধীনতা কাপের পর এই প্রথম শিরোপা জিতল মোহামেডান। দলকে জিতিয়ে ইতিহাস গড়েছেন মালিয়ান ফরোয়ার্ড সুলেমান দিয়াবাতে। ফাইনালে একাই চার গোল করে শিরোপা থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছে আবাহনীকে। ফেডারেশন কাপের ৪৩ বছরের ইতিহাসে ফাইনালে এটিই প্রথম হ্যাটট্রিক।