:: নাগরিক নিউজ ডেস্ক ::
পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে সক্রিয় রাজনীতিতে ৫ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তোশাখানা মামলায় ৩ বছরের কারাদণ্ডের রায়ের সঙ্গেই তাকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিষিদ্ধের ঘোষণা দিয়েছেন ইসলামাবাদের একটি আদালত।
শনিবার তোশাখানা মামলায় ইমরান খানকে ৩ বছরের কারাদণ্ড ও ১ লাখ রুপি জরিমানা করা হয়। অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ (এডিএসজে) হুমায়ুন দিলাওয়ার এ রায় দেন। কারাদণ্ডের রায়ের পরপরই গ্রেফতার হয়েছেন ইমরান খান।
রাষ্ট্রীয় কোষাগার তোশাখানার মালামাল অবৈধভাবে আত্মসাৎ ও তথ্য গোপন করার অভিযোগে ইমরানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে দেশটির নির্বাচন কমিশন। গত ১০ মে এ মামলায় তাকে অভিযুক্ত করা হয়।
মামলার রায় দেওয়ার সময় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ (এডিএসআই) হুমায়ুন দিলাওয়ার বলেন, ইমরান খান ইচ্ছাকৃতভাবে তোশাখানার উপহার নিয়ে নির্বাচন কমিশনকে মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন। দুর্নীতির জন্য দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় তাকে নির্বাচনী আইনের ১৭৪ ধারার অধীনে ৩ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
বিচারক দিলাওয়ার নির্দেশনা দেন, রায়টি কার্যকরে একটি কপি যেন ইসলামাবাদ পুলিশ প্রধানের কাছে পাঠানো হয়। যেন তারা রায় কার্যকর করতে পারেন।
এদিন দুপুরে আদালতের রায় ঘোষণার পরপরই লাহোরের জামান পার্কের বাসভবন থেকে তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) চেয়ারম্যানকে গ্রেফতার করে পাঞ্জাব পুলিশ। শনিবার টুইটবার্তায় পিটিআই জানায়, ‘ইমরান খানকে গ্রেফতার করে কোট লাখপত জেলে নেওয়া করা হচ্ছে।’
আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এ মামলায় দণ্ডিত হওয়ায় নভেম্বরের শুরুতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনে ইমরান খানের অংশ নেওয়ার সম্ভাবনা শেষ হয়ে যেতে পারে।
পাকিস্তানে তোষাখানা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭৪ সালে। এটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণাধীন একটি বিভাগ। সরকার ও অন্যান্য রাজ্যপ্রধান এবং বিদেশি বিশিষ্ট ব্যক্তিরা শাসক, সংসদ সদস্য, আমলা ও কর্মকর্তাদের যেসব উপহারসামগ্রী দেন, সেগুলো সংরক্ষণের দায়িত্বে থাকা একটি দপ্তর এটি।
তোষাখানার নিয়ম অনুসারে, প্রযোজ্য ব্যক্তিদের দেওয়া উপহার এবং অন্যান্য উপকরণ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে নিয়মিত রিপোর্ট করতে হয়।
২০১৮ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে পিটিআই সরকার ইমরানকে দেওয়া উপহারের বিবরণ প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক ছিল। যুক্তি ছিল, এটি আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে হুমকির মুখে ফেলবে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী তাঁর জবাবের সপক্ষে যুক্তি দেখিয়ে বলেন, তিনি রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ২১ দশমিক ৫৬ মিলিয়ন রুপি দিয়ে উপহারগুলো সংগ্রহ করেছিলেন, তা বিক্রি করে প্রায় ৫৮ মিলিয়ন রুপি পাওয়া গেছে। উপহারগুলোর মধ্যে রয়েছে—একটি গ্রাফ হাতঘড়ি, এক জোড়া কাফ লিংক, একটি দামি কলম এবং একটি আংটি—এসব মিলিয়ে একটি সেট; অন্য তিনটি উপহারের মধ্যে রয়েছে চারটি রোলেক্স ঘড়ি।
গ্রেফতারের আগে যে বার্তা দিলেন ইমরান খান
গ্রেফতারের আগে নিজ টুইটার এ্যাকাউন্টে জাতির উদ্দেশে একটি ভিডিও বার্তা দিয়েছেন তিনি। ১ মিনিট ৫৭ সেকেন্ডের ওই বার্তায় ইমরান খান দেশবাসীকে তাদের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হওয়ার আহ্বান জানান।
ইমরান খান বলেন, প্রিয় দেশবাসী, যতক্ষণে এই বার্তা আপনারা দেখবেন ততোক্ষণে ওরা আমাকে গ্রেপ্তার করে ফেলবে এবং আমি জেলে থাকবো। আপনাদের কাছে আমার একটিই অনুরোধ, আপনারা বাড়িয়ে চুপ করে বসে থাকবেন না। আমি যে সংগ্রাম করছি সেটা আমার মুক্তির জন্য করছি না, এটা আমাদের দেশের জন্য করছি, আপনাদের সন্তানদের জন্য করছি।
ইমরান খান আরও বলেন, আপনারা যদি নিজেদের অধিকারের জন্য প্রতিবাদ না করেন তবে আপনাকে দাসত্ব বরণ করতে হবে। আর দাসের কোনো জীবন হয় না।
পিটিআই চেয়ারম্যান বলেন, এই লড়াই ন্যায়ের জন্য, আপনাদের অধিকার ও স্বাধীনতার জন্য। মনে রাখবেন, স্বাধীনতা কখনোই প্লেটে করে দেওয়া হয় না।
তিনি আরও বলেন, ভোট দিয়ে নিজের শাসক নির্বাচন করতে পারা মানুষের সবচেয়ে বড় মৌলিক অধিকার। যতক্ষণ পর্যন্ত আপনাদের এই অধিকার আদায় না হচ্ছে ততক্ষণ লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।
জেলে যাওয়া পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রীরা
তালিকা করলে সেটির প্রথমেই আসবে বাঙালি রাজনীতিবিদ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নাম। পাকিস্তানের পঞ্চম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী এ প্রখ্যাত ব্যক্তি গ্রেফতার হন ১৯৬২ সালে। তাকে রাষ্ট্রবিরোধী অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয় সে সময়। মূলত তিনি তৎকালীন সামরিক শাসক আইয়ুব খানকে সমর্থন জানাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন।
কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়েছিল পাকিস্তানের নবম প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টোকেও। রাজনৈতিক বিরোধীকে হত্যার ষড়যন্ত্রের দায়ে তাকে গ্রেফতার করা হয় ১৯৭৪ সালে। তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় এবং ১৯৭৯ সালের চার এপ্রিল তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
১৯৮৮ থেকে ১৯৯০ এবং ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত দুইবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন বেনজির ভুট্টো। তিনি দেশটির একমাত্র নারী প্রধানমন্ত্রী। তাকেও বেশ কয়েকবার গ্রেফতার করা হয়েছিল। প্রথমবার গ্রেফতার করা হয় ১৯৮৫ সালে এবং গৃহবন্দী রাখা হয় ৯০ দিন।
১৯৮৬ সালের আগস্টে করাচির এক সমাবেশে তৎকালীন পাকিস্তানি সামরিক স্বৈরশাসক জিয়াউল হকের সমালোচনা করে ফের গ্রেফতার হন তিনি। ১৯৯৯ সালের এপ্রিলে দুর্নীতির অভিযোগে বেনজির ভুট্টোকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়, জরিমানাও করা হয় ৫০ লাখ পাউন্ডের বেশি। সে সময় অবশ্য গ্রেফতার হতে হয়নি তাকে। স্বেচ্ছা নির্বাসনে ছিলেন বেনজির ভুট্টো।
নওয়াজ শরিফ গ্রেফতার হন ১৯৯৯ সালে জেনারেল পারভেজ মোশাররফ দায়িত্ব নেওয়ার পর এবং পরবর্তীতে তাকে ১০ বছরের জন্য নির্বাসিত করা হয়। ২০১৮ সালের জুলাইয়ে তাকে তার মেয়ে মরিয়াম নওয়াজের সঙ্গে দুর্নীতি মামলায় ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ওই একই বছরের ডিসেম্বরে আল-আজিজয়া স্টিল মিলস দুর্নীতি মামলায় সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয় তাকে। ২০১৯ সালে তিনি চিকিৎসার জন্য লন্ডন যান। পরে আর পাকিস্তানে ফিরে আসেননি।
২০১৯ সালের জুলাইয়ে দুর্নীতি মামলায় গ্রেফতার হন শহিদ খোকন আব্বাসি। পরে জামিনে ছাড়া পান তিনি। ইমরান খান ২০২৩ সালের ৯ মে আরেক দুর্নীতি মামলায় গ্রেফতার হয়েছিলেন। কয়েক দিন পর সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপে মুক্তি মেলে তার। ফের গ্রেফতার হন ৫ আগস্ট।
ইমরান খানের দণ্ড এবং গ্রেফতার নিয়ে প্রখ্যাত সাংবাদিক এবং জিও নিউজের উপস্থাপক হামিদ মির সামাজিক মাধ্যম এক্স-এ (সাবেক টুইটার) বলেন, কারাদণ্ড পাওয়া প্রথম সাংবাদিক নন তিনি এবং হয়তো শেষ জনও নন।
টুইট বার্তায় তিনি লিখেছেন, ‘প্রথমে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, এরপর জুলফিকার আলি ভুট্টো, তারপর বেনজির ভুট্টো, পরে নওয়াজ শরিফ এবং এখন ইমরান খান। প্রধানমন্ত্রী এবং রাজনীতিবিদরা সবসময় শাস্তি পান।’
তিনি আরও উল্লেখ করেন, পাকিস্তানের ইতিহাসে কোনো প্রধানমন্ত্রী পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেনি।
অন্যদিকে, নির্বাচিত সরকার উৎখাতের জন্য চার সামরিক স্বৈরশাসক আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান, জিয়াউল হক এবং পারভেজ মোশাররফ – কারোরই বিচারের সম্মুখীন হতে হয়নি।