:: এরশাদ নাবিল খান ::
৪৫ বছর আগে এক ঐতিহাসিক প্রয়োজনে ও অনিবার্য বাস্তবতায় সেনাবাহিনী থেকে রাজনীতিতে আসা জিয়াউর রহমান মহান আল্লাহর প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সামাজিক ন্যায়বিচারকে মূল নীতিমালা করে এবং ১৯ দফা কর্মসূচিকে প্রাধান্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। সেই থেকে বিএনপি জনপ্রিয় ও গণমানুষের একটি রাজনৈতিক দল।
নেতাকর্মী-সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ীদের শ্রম, মেধা, ঘাম আর ভালোবাসায় দলটি আজ পূর্ণতা লাভ করেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে বিএনপির নেতৃত্বে পাঁচ বার সরকার গঠিত হয়েছে। তাছাড়া বিএনপি বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে, সব রাজনৈতিক দলকে রাজনীতি করার অধিকার দিয়েছে; সেই সুযোগে বাংলাদেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগও রাজনীতি করার অধিকার পেয়েছে। বিএনপি বাংলাদেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দিয়েছে। বন্ধ সংবাদপত্র খুলে দিয়েছে। বিএনপির হাত ধরেই বাংলাদেশের গণমাধ্যম বিকশিত হয়েছে। বিএনপি বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে। পক্ষপাতহীন ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রতিষ্ঠা করেছে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। মূলত নেতৃত্বই রাজনৈতিক দলের চালিকা শক্তি হিসেবে বিবেচিত।
আধুনিক বাংলাদেশের ইতিহাসে বিএনপি এক অসাধারণ ভূমিকা পালনকারী রাজনৈতিক দল ও এক অনন্য নেতৃত্ব। সময় যেমন বিএনপিকে সহায়তা করেছে, ঠিক তেমনি সময়কেও বিএনপি দেশের কাজে লাগিয়েছে। আমাদের জাতীয় ইতিহাসের কিছু ক্রান্তি সময় বিএনপিকে পার করতে হয়েছে এবং বিএনপি সেটি করেছেও সফলতার সহিত। যুগোপযোগী অর্থনীতি ও স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ, রাজনীতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধের স্বীকৃতি, ভুখন্ড কেন্দ্রিক জাতীয় পরিচয় ও জাতীয়তাবাদের দর্শন সমুন্নতকরণের মাধ্যমে বিএনপি রাজনীতিতে একটি শক্ত প্লাটফর্ম সৃষ্টিতে সক্ষম হয়, যা আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে এনেছে গুণগত পরিবর্তন। বিএনপির রাজনীতির মূল স্পিরিট ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’। নৃতাত্ত্বিক ও আদর্শিক চেতনা মিশ্র স্বতন্ত্ররূপ ও পরিচয় রাষ্ট্রীয়ভাবে বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে জিয়া প্রবর্তন করেন ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’।
এটি বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ইতিহাসবোধ, অনুভূতি ও বিশ্বাসকেও নাড়া দিয়েছে এবং প্রতিনিয়ত দিচ্ছে। তাই বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের’ পক্ষে অটল-অবিচল রয়েছে। ধর্ম, ভাষা,ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও অর্থনীতি ইত্যাদির সমন্বয়ে জাতীয়তাবাদ। ভূখণ্ড কেন্দ্রিকতাই হয়ে থাকে এর প্রধানতম প্রেরণা ও শক্তি। বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিস্টানসহ নানা ধর্মের মানুষ বাস করে। এখানে ভাষারও বৈচিত্র্য আছে। বাংলা, চাকমা, মারমা, উর্দুসহ অনেকগুলো ভাষা ও নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের জাতি-গোষ্ঠীর মানুষ এরা সবাই বাংলাদেশ ভূখন্ডে বসবাস করে। সেই অর্থে এরা সবাই বাংলাদেশী। এখানেই সবার জাতীয় পরিচয় ও জাতীয় স্বার্থ নিহিত আছে। এর মাধ্যমে আমাদের জাতিসত্তার একটা সুস্পষ্ট কাঠামো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যা ঐতিহাসিকভাবে আমরা ধারণ করে আসছি। এর জন্য বলা যায়, বিএনপির জন্ম হয়েছে ঐতিহাসিক প্রয়োজনে।
বাংলাদেশকে নিয়ে জিয়ার সুস্পষ্ট ভিশন ও পরিকল্পনা ছিল। এ লক্ষ্যে তিনটি খাতকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন তিনি। আর এ তিনটি খাত হলো কৃষি, জনশক্তি ও তৈরি পোশাক শিল্প। জনশক্তি কাজে লাগাতে ও শিল্প বিকাশে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার উদ্যোগ নেন জিয়া। তার রাষ্ট্রনায়কোচিত পররাষ্ট্রনীতি এবংপরিকল্পনা ও ভিশন অনুযায়ী অর্থনীতির উৎস বলে খ্যাত মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপ-আমেরিকার সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসা -বাণিজ্যের দ্বার উন্মুক্ত হয়। শুরু হয় মধ্যপ্রাচ্যে জনশক্তি প্রেরণ ও ইউরোপ-আমেরিকায় তৈরি পোশাক রফতানি। এর ধারাবাহিকতায় আজ বাংলাদেশের অর্থনীতির হৃৎপিন্ড হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে তৈরি পোশাক শিল্প ও জনশক্তি রফতানি। এই দুটি খাতের কারণেই বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রেকর্ড বৃদ্ধি পেয়েছে এবং পাচ্ছে। ইউরোপ-আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত না করলে, এটি সম্ভব হতো না। কেননা বাংলাদেশের রফতানির আয়ের ৯০ শতাংশই আসে আমেরিকা ও ইউরোপ থেকে।
১৯৭৭ সালে সৌদি আরবে জনশক্তি রফতানির মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্ব শ্রমবাজারে প্রবেশ করে। এরপর একে একে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ এবং ইউরোপ-আমেরিকায় বাংলাদেশের জনশক্তির বাজার সম্প্রসারণ হতে থাকে। বর্তমানে এ খাতটি বাংলাদেশের অর্থনীতির হৃৎপিন্ড। প্রায় ১ কোটির মতো বাংলাদেশী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কর্মরত। এখানেও একটি সুস্পষ্ট পরিকল্পনা ও ভিশন কাজ করেছে। ভিশন ছাড়া কোনোভাবেই এটি এতদূর যেতে পারত না। এখানেও বিএনপির কৃতিত্ব ষোলআনা। বিএনপি ক্ষমতায় না থাকলে বাংলাদেশের শ্রমবাজারে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। বন্ধ হয়ে যায় মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিক প্রেরণ। বর্তমানেও তাই হচ্ছে। বাংলাদেশের শ্রমবাজার আজ সঙ্কুচিত। মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিক প্রেরণ প্রায় বন্ধ।
স্বনির্ভর দেশ গড়তে এবং মানুষের জীবনে অর্থনৈতিক মুক্তি আনতে জিয়া ঘোষণা করেন ‘১৯-দফা কর্মসূচি’। এটি বিএনপির রাজনীতির অন্যতম স্তম্ভ। জিয়া বিএনপির মাধ্যমে এই কর্মসূচিকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন মাঠে-ঘাটে ও পথে-প্রান্তরে। আমাদের কৃষিভিত্তিক সভ্যতা ও অর্থনীতির নিজস্ব রূপ ফুটে উঠেছে জিয়ার ১৯-দফা কর্মসূচি’র মাধ্যমে। তিনি গ্রামের পর গ্রাম, মাইলের পর মাইল হেঁটেছেন। নিজের হাতে কোদাল তুলে নিয়েছেন, খনন করেছেন খাল; তার দুই হাতের ছোঁয়ায় ফসলে ফসলে মাঠ ভরপুর হয়ে উঠেছিল, ঘটেছিল কৃষি বিপ্লব। তলাবিহীন ঝুড়ির উপাধি পাওয়া দেশ পরিণত হয়েছিল ফুল-ফল ও ফসলে ভরপুর এক দেশে। মানুষ পরিণত হয়েছিল কর্মমুখী মানুষে; গ্রামে গ্রামে সৃষ্টি হয়েছিল সামাজিক নেতৃত্ব। স্বনির্ভর গ্রাম ও স্বনির্ভর দেশ গড়তে জিয়ার ‘১৯-দফা কর্মসূচি’ বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে অনিবার্য দিকনির্দেশনা হয়ে আছে এবং থাকবে।
জিয়াউর রহমান বিএনপির জন্য রেখে গেছেন এক স্বর্ণোজ্জ্বল ইতিহাস। তার আদর্শ, সততা, কর্মোদ্যোগ ও চিন্তা-চেতনা মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে আমাদের জাতীয় জীবনে। জাতিকে বড় করার সব গুণ জিয়ার মধ্যে ছিল। তিনি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন বড় কিছু করতে। তার চিন্তা ছিল সুদূরপ্রসারী। জিয়ার আদর্শ ও দিক-দর্শন বিএনপির নেতাকর্মীদের হাতে-কলমে শিক্ষা দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, বিএনপি শুধু একটি রাজনৈতিক দল নয়, এটি রাজনৈতিক শিক্ষালয়ও, রাষ্ট্রকে জানতে হলে, চিনতে হলে এবং ভালোবাসতে হলে; বিএনপির রাজনীতির গভীরে যেতে হবে। শুধু ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য জিয়া এই দলের জন্ম দেননি, এর আলোকে জাতি গঠন, ত্যাগী, কর্মঠ ও দক্ষ মানুষ তৈরি এবং মানুষকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করাও বিএনপির অন্যতম লক্ষ্য। পৃথিবীতে একসময় শিল্পে যারা এগিয়ে ছিল, তারাই আজ বিশ্ব শাসন করছে; বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তিতে যারা এগিয়ে থাকবে আগামীতে তারাই বিশ্ব শাসন করবে। তথ্যপ্রযুক্তিতে যারা পিছিয়ে থাকবে, কোথাও তাদের শ্রেষ্ঠত্ব থাকবে না। রাজনীতি ও অর্থনীতির মূল স্রোত থেকে তারা অবধারিতভাবে ছিটকে পড়বে। কাজেই বিএনপিকে গণমাধ্যমে প্রাধান্য
বিস্তার করতে হবে। চৌকস সংগঠকদের গণমাধ্যমে কাজ করার সুযোগ করে দিতে হবে। এজন্য বিএনপির প্রেস উইংকে করতে হবে যুগোপযোগী ও শক্তিশালী। দেশ গড়তে সফল হলেও নিজ দলের প্রতি বিএনপি থেকেছে বরাবরই উদাসীন। বিএনপিকে একটি প্রফেশনাল রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে তোলার যথেষ্ট সময় ও সুযোগ পেয়েও বিএনপি তা কাজে লাগাতে সমর্থ হয়নি।
এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সংগ্রামী ইমেজ সাংগঠনিকভাবে কাজে লাগিয়ে বিএনপিকে শক্তিশালী রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে তোলা যেত। কিন্তু ওই সময়ের রাজপথে নেতৃত্ব দেয়া লড়াকু সৈনিকদের সুযোগ পেয়েও বিএনপি কাজে লাগাতে পারেনি। এসব সংগঠকরা রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। বিএনপি পারত তাদেরকে দল ও দেশের কাজে
লাগাতে, একজন যোগ্য ও জনপ্রিয় রাজনীতিক ও সংগঠক হিসেবে গড়ে তুলতে। একজন পত্রিকার সম্পাদক, নিউজ এডিটর, রিপোর্টার, লেখক, বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিসেবী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও ব্যবসায়ী হিসেবে গড়ে তুলতে। কিন্তু বিএনপি প্রায় ১৫ বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকেও কি সেটি করতে পেরেছে?
বিএনপি পেরেছে কিছু মন্ত্রী-এমপি ও সুবিধাবাদী লোক বানাতে যারা বিএনপির জন্য কিছুই করেনি এবং করার ক্ষমতাও রাখে না। তাই বিএনপি আজ অসহায়, রাষ্ট্রের কোথাও বিএনপির কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই; যতটা আছে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের। কাজেই বিএনপি অনেককেই অনেক কিছু দিয়েছে কিন্তু বিএনপিকে কে কী দিল সে প্রশ্ন আজ বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে। বিএনপি ও জিয়া যেন এক ও অভিন্ন সত্তা। জনপ্রিয়তার সঙ্গে সঙ্গে উৎকৃষ্ট সৃষ্টিশীলতার সংমিশ্রণ জিয়ার প্রধানতম কৃতিত্ব।
ইতিহাস জিয়া ও বিএনপিকে যেভাবে কাছে টেনে নিয়েছে, ব্যক্তির অস্তিত্ব অতিক্রমী জিয়াও তেমনিভাবে সৃষ্টি করেছেন ইতিহাস। দারিদ্র্য, রাজনৈতিক সঙ্কট, আর্থসামাজিক ঝড় পেরিয়ে জিয়া যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছেন সেটা বিশ্ব জয়ের চেয়ে কম রোমাঞ্চকর নয়। দর্শন চিন্তা, সাংগঠনিক চিন্তা, রাজনৈতিক চিন্তা, কৃষি, শিল্প, সাহিত্য-সাংস্কৃতির মাধ্যমে জিয়া জানিয়ে গেছেন তার বহুমাত্রিক প্রতিভা ও কৃতিত্বের জগৎ সম্পর্কে। তাই জিয়ার জন্ম দেয়া বিএনপি স্থান করে নিয়েছে ইতিহাসের সোনালি পাতায়। তবে আজ এ পর্যায়ে এসে প্রতীয়মান হচ্ছে, জিয়ার আদর্শে উজ্জীবিত তৃণমূলের নেতাকর্মীরাই বিএনপির প্রাণশক্তি। তাদের উদ্যম, সাহস, একাগ্রতা ও দলের প্রতি আনুগত্যই বিএনপিকে রাজনৈতিক দল হিসেবে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। তৃণমূলের নেতাকর্মীরা নজিরবিহীন দমন-পীড়ন ও জুলুম-নির্যাতন ও হামলা-মামলা সহ্য করেও দলের হাল ধরে রেখেছে। কার্যত দীর্ঘ সময় ধরে তারা প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করছেন, যা বর্ণনাতীত। অধিকার আদায়ের লড়াই করতে গিয়ে অনেকেই জীবন দিয়েছেন, পঙ্গু হয়েছেন; হারিয়েছেন জীবন ধারণের সম্বলটুকুও, আবার অনেকে হুলিয়া মাথায় নিয়ে পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ফেরারি জীবনযাপন করছেন। তাদের প্রতি বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সাহায্য ও সহযোগিতার হাত প্রসারিত করা একান্ত প্রয়োজন। মামলা পরিচালনা ও চিকিৎসা খরচসহ যারা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছেন, তাদের আর্থিক সহায়তা করার ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে তাদের শক্তি ও সাহস বৃদ্ধি পায়; আগামী দিনের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে যাতে তারা মনোবল ধরে রাখতে পারে।
শুভ জন্মদিন, আমার প্রথম প্রেম; প্রিয় বিএনপি।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক