:: এবিএম মুসা ::
রাষ্ট্রপতি জিয়ার সান্নিধ্যে একটি সন্ধ্যা নিয়ে এই লেখাটি। যখন ‘দিনকাল’ থেকে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের উপর একটি প্রতিবেদন লেখার অনুরোধ এল তখন তাৎক্ষণিক ‘হ্যাঁ ‘ বলে দিলাম। তারপরই ভাবলাম, হ্যাঁ বলেছি এখন লিখব কী ? বেশ কিছুদিন আগে আমাদের রাজনীতিতে নতুন রক্ত সঞ্চালনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে লেখায় জিয়া-তনয় তারেক রহমানের একটুখানি প্রশংসা করেছিলাম। তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান বা দলীয় কর্মকাণ্ডের প্রতি সমর্থন জানাইনি। শুধু লিখেছিলাম, তারেকের সঙ্গে ঘটনাচক্রে দেখা হয়েছিল। প্রথম দর্শনে তাঁকে আমার নম্র ও ভদ্র বলে মনে হয়েছে। তারপর যায় কোথায় ? ‘আলী-আলী করে সমগোত্রীয় দু’চার জন আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। সরাসরি একজন প্রশ্ন করে বললেন – “মূসা-ভাই, … একী বল্লেন।” তাঁদের বক্তব্য ছাপা হওয়ার পরও পাল্টা বক্তব্য দিইনি। আমার কারো ব্যক্তিগত আচরণের প্রশংসা করার অধিকার আছে। সেজন্য কোন কৈফিয়ত দেয়া প্রয়োজন মনে করিনি । তাঁরা তারেকের অন্য কোন আচরণের সঙ্গে পরিচিত কিনা জানিনা তবে আমার যা মনে হয়েছে তাই বলেছি ।
পুরনো কথাটি উথ্যাপনের কারণ হল এখন যদি আমি ব্যক্তি জিয়া সম্পর্কে আমার একই ধরনের ধারণা বা অনুভূতির কথা প্রকাশ করি, একইভাবে কেউ কেউ হই-হই করে উঠবেন। তাঁরা বুঝতে চাইবেন না একজন রাজনীতিবিদ বা দলীয় নেতা, খলনায়ক বা একনায়ক, রাষ্ট্রপতি বা সরকার প্রধানের কর্ম ও দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে যে পরিচিতি তার বাইরেও একটি অজানা, ভিন্ন ও অন্তর্নিহিত সত্তা থাকতে পারে। আমি রাষ্ট্রপতি জিয়ার সেই ভিন্ন পরিচয় ও সত্তার একটুখানি পরিচয় পেয়েছিলাম ক্ষণিকের ব্যক্তিগত সান্নিধ্যে। তিনি ক্ষমতায় কীভাবে এলেন, কীভাবে দেশ শাসন করেছেন অথবা তার রাজনৈতিক মতবাদ নিয়ে বিতর্ক নয়। ব্যক্তি জিয়া সম্পর্কে ধারণাটি একান্ত ব্যক্তিগত একটি অভিজ্ঞতা থেকে বর্ণনা করছি।
আমি তখন নিউ নেশন পত্রিকার উপদেষ্টা সম্পাদক। বন্ধু এস এম আলী, ডেইলী স্টারের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক, ম্যানিলায় প্রেস ফাউন্ডেশন অব এশিয়ার পরিচালক। আলী আর আমি একই সময়ে পঞ্চাশ সনে অবজার্ভারে সাংবাদিকতা শুরু করেছিলাম। সেই কারণে সম্পর্ক ছিল অতি নিবিড়। আলী জানাল, পরিবেশ কর্মসূচি (ইউনেপ) তাদের দক্ষিণ এশীয় দফতর ব্যাংককে আঞ্চলিক প্রচার অধিকর্তা নিয়োগ করবে। আমার এ পদে যাওয়ার আগ্রহ থাকলে যেন তক্ষুনি আবেদন করি। যথারীতি আবেদন করলাম, আমার সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতার বিবরণ জেনেই জাতিসংঘের পরিবেশ সংস্থাটি আমাকে সরাসরি নিয়োগ দিল। কোন সাক্ষাৎকার, এমনকি পূর্ব আলোচনাও করল না। পরে জেনেছিলাম সিংহলী, ভারতীয় ও ফিলিপেনো তিনজন জাদরেল সাংবাদিকও এই পদের প্রার্থী ছিলেন। কিন্তু নাইরোবিতে অবস্থিত ইউনাইটেড নেশনস এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম আমাকেই তাদের চেয়ে অধিকতর উপযুক্ত মনে করেছিল। এই দীর্ঘ বিরণটি দিলাম কারণ আওয়ামী শাসনামলে আমার শুভার্থীরা সংশ্লিষ্ট মহলে প্রচার করেছিল আমাকে নাকি জিয়াউর রহমানই চাকরি দিয়েছিলেন। বুদ্ধুর দল জানেনা, জাতিসংঘে তদবিরে চাকরি হয়না। এই প্রসঙ্গে আরো একটি কথা জানানো দরকার তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে আমি জানতামনা, তাঁর সঙ্গে তখনো পরিচয় হয়নি।
প্রসঙ্গত বা অপ্রাসঙ্গিকভাবে অন্য কথায় এসে গেলাম। আসলে কথাগুলো বলার সুযোগ ও উপলক্ষ পেয়েই বলে ফেললাম। আড়াই বছর ব্যাংককে চাকরি করা কালে কিছু ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সমস্যার মোকাবিলা করতে হয়েছে। যেহেতু ব্যাংককে থাই মাধ্যম ব্যতীত লেখাপড়ার সুযোগ নেই সেহেতু কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়েদের ঢাকায় রেখে যেতে হয়েছে। আমার স্ত্রী দু’তিনবার ঢাকা ব্যাংকক করেন। এ অবস্থায় লোভনীয় অতি উচ্চহারের, তখনকার দিনেই মাসে প্রায় লাখ টাকা বেতনের চাকরির মেয়াদ শেষের পর চুক্তি নবায়ন করলাম না। আশী সালের শেষ নাগাদ দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নিলাম। এমনি সময়ে দেখা হলো রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সঙ্গে।
সময়টি সম্ভবত ‘৮০ সালের অক্টোবর। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রীয় সফরে সিঙ্গাপুর যাচ্ছেন, ব্যাংককে ঘন্টাখানেকের যাত্রাবিরতি। তাঁর স্বল্পকালীন অবস্থানের সময়ে ব্যাংককের বাঙালীরা তাঁকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য বিমান বন্দরে গেলেন। আমরা মুষ্টিমেয় কয়েকজন বাঙালী আমি, জাতিসংঘে কর্মরত ড. রহমত উল্লাহ, বাংলাদেশে সচিব ছিলেন তখন এসকাপে কৃষি বিভাগের প্রধান, অবসর গ্রহনের পর সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান সুলতান উজ্জামান খান, আহমদ ফরিদ, শিপিংয়ের ক্যাপ্টেন কিউ বি এম রহমান সবাই ভিআইপি লাউঞ্জে রাষ্ট্রপতির সাথে চা খেলাম, নানা বিষয়ে গল্প করলাম। বিমানের পরবর্তী যাত্রার সময় ঘোষণা হতেই সবাই বিদায় নিলেন। রাষ্ট্রপতির প্রেস উপদেষ্টা আমার অপর এক ঘনিষ্ট বন্ধু বর্তমানে প্রয়াত দাউদ খান মজলিশের সঙ্গে গল্প করছিলাম। সবাই চলে যাওয়ার পর দাউদ বলল, ‘চল তোকে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই।’
দাউদের সঙ্গে লাউঞ্জের ভিতরের কক্ষে ঢুকেছি, এমন সময়ে ঘোষণা হলো যান্ত্রিক ত্রুটির জন্য বিমানের যাত্রা বিলম্বিত হবে। জিয়াউর রহমানের সামনে দাঁড়াতেই দাউদ হড়বড় করে আমার সম্পর্কে একগাদা কথা তাঁকে জানিয়ে দিল। রাষ্ট্রপতি তাঁর কালো চশমাটি একটুখানি নাকের নীচের দিকে ঠেলে দিয়ে খোলা চোখে কৌতুহলী দৃষ্টিতে সরাসরি তাকালেন। তারপর বল্লেন – ‘বসুন, আলাপ করি।’ তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘বিদেশে কি করছেন? দেশে ফিরে আসেন। দেশের কাজে আপনাদের দরকার।’ আমি বিনীতভাবে উত্তর দিলাম ,”তাই করব ভাবছি। এখানকার চাকরির মেয়াদ শেষ।’ জিয়া বললেন, ‘দেশে ফিরেই আমার সঙ্গে দেখা করবেন।’ কিছুক্ষণ পর রাষ্ট্রপতির যাওয়ার সময় হল, আমিও বিদায় নিয়ে চলে এলাম।
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ঢাকা এলাম। সাংসারিক ঝামেলায় জড়িয়ে পড়লাম। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করার কথা ভাবছিলাম, পরে মনে হল – কি লাভ। তাছাড়া তিনিও আর আমার গায়ে যে একটি রাজনৈতিক গন্ধ আছে তাতো জানেন না। তদুপরি ব্যাংকক বিমানবন্দরে দেখা হওয়ার সামান্য ঘটনাটি তাঁর মনে থাকার কথা নয়। দ্বিতীয় ধারণাটি যে ভুল দু’দিন পরে টের পেলাম। একদিন সকালে প্রেসক্লাবে আড্ডা দিচ্ছি, হঠাৎ শুনতে পেলাম ‘জিয়াউর রহমান এসেছেন।’ কোথাও যেন যাচ্ছিলেন হঠাৎ প্রেসক্লাবে ঢুকে পড়েছেন। সবাই আমরা ব্যস্ত হয়ে প্রধান ফটকে গিয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা করে লাউঞ্জে বসালাম। তিনি বসেই জিজ্ঞেস করলেন ‘বিল্ডিং কতদূর’ ? তখন প্রেসক্লাবের নতুন দালানের কাজ চলছে। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সকল নির্মান ব্যয় মেটানোর ব্যবস্থা করেছেন। তাঁর এই পদক্ষেপেরও ইতিহাস ছিল। ক্লাবের দালানের জন্য আগা খান একটি বৃহৎ অঙ্ক দান করেছিলেন। কিভাবে যেন খবরটি রাষ্ট্রপতির কানে গেলে তিনি রেগে গেলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল আমাদের দেশের সামান্য একটি দালানের জন্য কেন বিদেশীদের কাছ থেকে টাকা নেয়া হবে। সরকারিভাবে দালান তৈরি করে দেয়ার ব্যবস্থা করলেন। পরে এক সময়ে ক্লাবের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন।
জিয়া সাহেবের পাশেই একটুখানি দূরে বসেছিলাম। চারদিকে চোখ ঘুরাতেই আমার উপর দৃষ্টি পড়ল। বলে উঠলেন, ‘আরে, আপনি কবে ফিরেছেন?’ বললাম, ‘হপ্তা দুয়েক আগে এসেছি।’ তিনি রাগত স্বরে বল্লেন , ‘দু’সপ্তাহ, আর আপনি আমার সঙ্গে দেখা করলেন না? আপনাকে না বলেছিলাম ফিরেই আমার কাছে আসবেন? কালকেই আমার সঙ্গে দেখা করবেন। দাউদ সাহেব উনাকে নিয়ে আসবেন।’ পরে গাড়িতে ওঠার সময় আবার বল্লেন, ‘কালকেই আসবেন।’ পরদিন দাউদের টেলিফোন পেলাম, সন্ধ্যায় মাগরিবের পর রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আমার এ্যাপয়েন্টমেন্ট, নির্দিষ্ট এই বৈঠকের জন্য কাঁটায়-কাঁটায় ছয়টায় হাজির হতে হবে।
সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে হাজির হলাম। সরাসরি দাউদের কামরায় যেতেই সে আমাকে নিয়ে রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব জেনারেল সাদেক আহমদ চৌধুরীর কামরায় নিয়ে বসাল। আমাকে দাউদ জানাল, ‘রাষ্ট্রপতি কয়েকজন মন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করছেন, তোকে এখানে অপেক্ষা করতে বলেছেন।’ আধঘন্টা পর জিয়া এলেন জেনারেল সাদেকের কামরায়। আমার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বল্লেন, ‘ও, আপনি মূসা সাহেব। আমি ভেবেছিলাম পাকিস্তান থেকে জেনারেল মূসা এসেছেন।’ আমি একটু অবাক হলাম তাঁর পরিহাসে। শুনেছিলাম জিয়া অত্যন্ত কাঠখোট্টা ধরনের লোক। ব্যবহারেও রূঢ় এমন একটা ধারনাই পেয়েছিলাম।
জিয়া বল্লেন, ‘চলুন ভিতরে যাই। আপনারা বসবেন, আমি গোসল করে আসব, তারপর একসঙ্গে খাব।’ জেনারেল সাদেকের কামরা থেকে বেরিয়ে রাষ্ট্রপতি জিয়া সামনে পিছনে দাউদ ও আমি বঙ্গভবনের ভিতরের চৌহদ্দির দিকে হাঁটা দিলাম। এই সময়ে আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন কর্নেল (অব:) আকবর, তিনি তখন জ্বালানিমন্ত্রী।হাঁটতে হাঁটতে জিয়া জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কী? আচমকা প্রশ্নে থতমত খেয়ে আমতা আমতা করে বল্লাম, ‘আমি কি মানে?’ জিয়া পিছন ফিরে হেসে বললেন, ‘আপনি কি কম্যূনিষ্ট, সোস্যালিষ্ট, লিবারেল ডেমোক্রেট না অন্য কিছু?’ প্রশ্নের ধরনে বিষয়টি একটুখানি আঁচ করতে পারলাম। হেসে বল্লাম, ‘আমি ডেমোক্রেসিতে বিশ্বাস করি।’ আবার প্রশ্ন, ‘অপনি নাকি আওয়ামী লীগার?’ বুঝলাম রাষ্ট্রপতি ইতোমধ্যে অনেক খবর নিয়েছেন। আমি জবাব দিলাম, ‘আমি মুজিব লীগার।’ জিয়া থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন, ফিরে তাকিয়ে বল্লেন, ‘তার মানে?’ আমি ব্যাখ্যা করার ঢংয়ে ছোটখাট বক্তব্য দিলাম যার অর্থ – বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি আমার আনুগত্য ও বিশ্বাসের কারণেই আমি আওয়ামী লীগার হয়েছিলাম। তিনি অন্য কোন লীগ করলে আমিও তাই করতাম। জিয়াউর রহমান এবার দাউদ ও আকবরের দিকে তাকিয়ে বল্লেন, ‘আমাদের মতই মনে হচ্ছে, কী বলেন?’ জিয়ার এই কথা নিয়ে পরে অনেক ভেবেছি ও নানাভাবে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি কিন্তু সন্তোষজনক কোন সিদ্ধান্ত পৌঁছতে পারিনি বলে সেই ভাবনা গুলো উল্লেখ করলামনা।
একটু পরে জিয়া গোসল করে এলেন। আমরা চারজন খেতে বসলাম। খাবারের পরিমাণ ও রকম দেখে একটুখানি দুশ্চিন্তাও দেখা দিল। বুঝলাম জিয়া অত্যন্ত স্বল্পাহারী, আমার ভাগ্যেও অর্ধাহার। তিনি এক কাপ স্যুপ, দু’তিন চামচ ভাত, দু’টুকরা মুরগির গোস্ত, এক চামচ সব্জি নিলেন। তাঁর দেখাদেখি আকবর, দাউদ ও আমিও তাই নিলাম। জিয়া চেয়ে দেখলেন, কিছু বল্লেন না, তবে মনে হল একটুখানি মুচকি হাসলেন। খেতে খেতে কথা হল। আমার দিকে চেয়ে বল্লেন, ‘আপনাকে কোথায় দেয়া যায় বলুনতো?’ দাউদ, আপনিই বলুন, ‘ দাউদ একাধারে তথ্য বিষয়ক কয়েকটি পদ খালি থাকার কথা জানাল। জিয়া আমাকেই আবার প্রশ্ন করলেন, ‘বলুন, আপনি কোনটিতে ইন্টেরেস্টেড।’ আমি জবাবে যা বলেছিলাম সে কথা এখন না বলাই ভাল। কারণ আমি যে পদটির কথা বলেছিলামে তিনি সেখানে আমাকে নিয়োগ দিতে তৎকালীন তথ্য মন্ত্রী শামসুল হুদা চৌধুরীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। পরে মন্ত্রীই অন্য তদবিরের কারণে আমাকে প্রেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালকের পদে নিয়োগের প্রস্তাব দেন। সে আরো মজাদার কাহিনী। রাষ্ট্রপতি জিয়ার প্রশাসনিক কার্যপদ্ধতির ভিন্ন এক চিত্র যা নিয়ে পরে আলোচনা করব। এখন আবার তাঁর কৌতুক ও পরিহাস প্রবণতার আরেকটি ছোট্ট কথা বলে নিই। জিয়া আমাকে ছেড়ে এবার আকবরকে নিয়ে পড়লেন। তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আকবর, তোমার তেল আর গ্যাসের খবর কী?’ আকবর জবাব দিলেন, ‘স্যার বাংলাদেশ তেল আর গ্যাসের উপর ভাসছে, যেখানেই ড্রিলিং করা হবে সেখানেই তেল না হয় গ্যাস পাওয়া যাবে।’ জিয়া আৎকে উঠে বল্লেন, ‘সর্বনাশ, তার মানে যেখানেই ম্যাচের কাঠি জ্বালাব সেখানেই আগুন জ্বলে উঠবে। এতো সাংঘাতিক কথা।’
কৌতুকটি করার পরপরই অবশ্য তিনি আকবরের সঙ্গে কতিপয় জরুরি দরকারি কথা বলে নিলেন। আমি আর দাউদ তখন নিজেদের মাঝে নিচুস্বরে রাষ্ট্রপতির আমাকে নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়টি আলাপ করছিলাম। আহারপর্ব পনের মিনিটে শেষ। বিদায় নিয়ে চলে আসার আগে রাষ্ট্রপতি আবার বল্লেন, ‘হুদা সাহেবের সঙ্গে সব কথাবার্তা শেষ করে আবার দেখা করবেন।’ আমি সম্মতিসূচক ঘার নেড়ে স্বল্পকালীন সাক্ষাতের স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে বেরিয়ে এলাম।
জিয়ার সান্নিধ্যের সন্ধ্যাটির বর্ণনা এখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু তাঁর চরিত্রের অন্য দিকটি এই ঘটনাটির সাথে সম্পৃক্ত বলে উদ্ধৃত করতে হচ্ছে। রাষ্ট্রপতি বলে খালাস, কিন্তু তথ্য মন্ত্রনালয় থেকে আমাকে আর কিছু জানানো হয়না। আমিও গায়ে পড়ে এ নিয়ে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করিনি। সপ্তাহ খানেক পরে ওকাবের (বাংলাদেশে বিদেশী সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিদের প্রতিষ্ঠান) বোধ হয় আতিকুল আলমের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করলেন। আমি ঢাকায় বিবিসি ও লন্ডন টাইমস প্রতিনিধি ছিলাম। ফিরে এসে সানডে টাইমস ও লন্ডন টাইমসের হয়ে আবার কাজ শুরু করেছি। এই সুবাদে ওকাবের সদস্য-প্রতিনিধিদের সঙ্গে আরেকটি সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা হল। প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে রাষ্ট্রপতি এবারো আমার দিকে নজর দিলেন। জিজ্ঞাস করলেন , ‘শেষ পর্যন্ত হুদা আপনাকে কোথায় দিল?’ আমি জানালাম, ‘কোথাও না।’ তিনি কী বুঝলেন কে জানে, বল্লেন, ‘আমার সঙ্গে কথা বলে যাবেন।’
প্রতিনিধি দল চলে গেলেন, আমি আর দাউদ কামরায় বসে রইলাম। রাষ্ট্রপতি টেলিফোনে তথ্যমন্ত্রীকে চাইলেন। সংযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হোয়াট হ্যাভ ইউ ডান এ্যাবাউট মিঃ মূসা’ উত্তরে কী জানলেন আমি জানিনা, তবে মুখ খানি কঠোর করে কিছুক্ষণ শুনলেন, তারপর ‘আচ্ছা’ বলে টেলিফোন রেখে দিলেন। আমাকে বল্লেন, ‘একটু সমস্যা দেখা দিয়েছে, ঠিক করে দেব।’ আমাকে যাওয়ার অনুমতি দিলেন, দাউদকে থেকে যেতে বল্লেন।
সমস্যাটি কি পরে দাউদের মুখে শুনেছিলাম। সমাধানটি রাষ্ট্রপতি কীভাবে করেছিলেন তাও জেনেছি। আমার প্রেস ইনস্টিটিউটে নিয়োগের ব্যাপারে সামরিক ও বেসমরিক গোয়েন্দা সংস্থা থেকে আপত্তি এসেছিল। আমাকে বিদায় দিয়েই টেলিফোন করলেন ডিএফআই প্রধান জেনারেল মহব্বত জান চৌধুরীকে। জেনারেল চৌধুরী রাষ্ট্রপতিকে জানালেন, ‘মূসা সাহেব আওয়ামীপন্থী, সুতরাং তাঁকে সরকারি কোন পদে নিয়োগ দেয়া যাবেনা।’ রাষ্ট্রপতি গম্ভীর মুখে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘ তা আমি জানি। তিনি প্রেস ইনস্টিটিউটের ডিজি হওয়ার উপযুক্ত কিনা, সাংবাদিকদের শেখানোর বিদ্যা আছে কিনা, সেটা বলুন।’ তারপর নাকি বলেছেন, ‘তাকে রাষ্ট্রপতি ক্লিয়ারেন্স দেওয়ার পরে আপনাদের রিপোর্ট ইজ ইউজলেস’। এই কথাবার্তার বিষয়বস্তু পরবর্তীতে মহব্বত জান চৌধুরীর ছোটভাই সরওয়ার জান চৌধুরীও আমাকে জানিয়েছিলেন। দু’দিন পরে হুদা ভাইয়ের ফোন পেলাম, ‘মূসা, তুই কোথায়? এদিকে বঙ্গভবনের টেলিফোনে আমার প্রাণ অতিষ্ঠ।’ যথা সময়ে ডিজি পিআইবি পদে যোগ দিলাম।
অতঃপর জিয়া চরিত্রের কোন বিশেষ দিক নিয়ে বিশ্লেষণের প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। তবে আমার ব্যক্তিগত কাহিনীটি থেকে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের রাষ্ট্র পরিচালনায় যে প্রশাসনিক দক্ষতার কথা বলা হয় তার ভিত্তি সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যেতে পারে। অন্তত আমার ক্ষেত্রে বোঝা গেছে তাঁর প্রশাসনে দলীয়করণ, রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনায় ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ এবং রাজনৈতিক সংকীর্নতার কোন স্থান ছিল না। প্রশাসনিক বা নীতিটি অনুসরন না করার কারণেই পরবর্তীতে কেউ কেউ রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন॥