:: নাগরিক প্রতিবেদন ::
চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে শূন্য থেকে ১৫ বছর বয়সী ১০৬ শিশুর মৃত্যু হয়েছে, যা এ পর্যন্ত মোট মৃত্যুর ১২ শতাংশ। এর মধ্যে শূন্য থেকে ৫ বছর বয়সী শিশুই ৩৪ জন।
আলোচ্য সময়ে রোগটি আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে ৩৫ হাজার ২৫৮ শিশু, যা মোট আক্রান্তের ১৯ শতাংশ। এর মধ্যে শূন্য থেকে ৫ বছর বয়সী আছে ১০ হাজার ৮১৬ জন।
শিশুদের ডেঙ্গু চিকিৎসা কোথায় হয়, সে সম্পর্কে দেশের বেশির ভাগ মানুষের ধারণা নেই। ফলে শিশু অসুস্থ হলে নিয়ে যাওয়া হয় বেসরকারি হাসপাতালে। সেখানে বড়দের মতো করে ফ্লুইড দিয়ে শিশুদের রেফার করা হয় পিআইসিইউতে।
রাজধানীর মাঝারি মানের হাসপাতালগুলোতে একটি শিশুকে দুই দিন পিআইসিইউতে রাখলে বিল আসে ৮০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা। অনেকের পক্ষেই এই ব্যয় করা অসম্ভব। আবার অনেক সময় প্রয়োজন না পড়লেও ব্যবসায়িক মনোভাব থেকেই শিশু রোগীকে পিআইসিইউতে পাঠানো হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ডাক্তার জানিয়েছেন, শিশুদের ডেঙ্গু চিকিৎসায় নানা সমস্যা রয়েছে। প্রথমত, দেশে শিশু বিশেষজ্ঞের অভাব। দ্বিতীয়ত, বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোর বাণিজ্যিক মনোভাব। অনেক সময় আক্রান্ত শিশু যতটা সিভিয়ার নয়, হাসপাতালগুলো তার চেয়ে বেশি প্যানিক সৃষ্টি করে বাবা-মার মনে আতঙ্ক ধরিয়ে দেয় এবং শিশুকে পিআইসিইউতে নিতে বাধ্য করে। এ ছাড়া ডেঙ্গু চিকিৎসায় যে গাইডলাইন প্রণয়ন করা হয়েছে, সেখানে শিশুদের বিষয়ে প্রয়োজনীয় গুরুত্ব প্রদান করা হয়নি। কারণ, গাইডলাইন প্রণেতাদের মধ্যে কোনো শিশু বিশেষজ্ঞ ছিলেন না।
ডেঙ্গু চিকিৎসার গাইডলাইনে শিশুদের বিষয়টি গুরুত্ব পায়নি বলে দাবি করেছেন আরেক বিশেষজ্ঞ। সহকারী অধ্যাপক পদমর্যাদার ওই চিকিৎসক বলেন, গাইডলাইন যাঁরা করেছেন, তাঁরা শুধুই ফ্লুইড নিয়ে কথা বলেছেন। এবার শিশুদের মূল সমস্যাই দেখা যাচ্ছে পেট ফুলে যাওয়া আর লুজ মোশন। এসব পরিস্থিতিতে কী করণীয়, তা নিয়ে আলোকপাত নেই গাইডলাইনে। তিনি বলেন, অনেক শিশু হাসপাতালে যাচ্ছে নাক দিয়ে রক্ত পড়ার লক্ষণ নিয়ে। কর্তব্যরত চিকিৎসকেরা তাদের ক্ষেত্রে প্রথমেই প্লাটিলেট দিয়ে দিচ্ছে বা ব্লাড দিচ্ছে। সেটার পরিমাণ কত, তার সঠিক নির্দেশনা গাইডলাইনে নেই। তাই শিশুদের চিকিৎসার ভালোমন্দ নিরীক্ষা না করেই পিআইসিইউতে রেফার করা হচ্ছে। যেসব হাসপাতালে পিআইসিইউ নেই, সেখানে বাচ্চাদের স্যালাইনও দেওয়া হয় না।
ডেঙ্গুর কারণে ছোট–বড় সবারই রক্তচাপ কমে যায়। বড়দের রক্তচাপ নিয়ে মানুষ যত মাথা ঘামায়, শিশুদের ক্ষেত্রে বিষয়টি ততটা গুরুত্ব পায় না। অনভ্যস্ততার কারণে শিশুদের রক্তচাপ অনেকে ঠিকভাবে মাপতে পারেন না।
অন্য বিষয়টি—শরীরের তরল ব্যবস্থাপনা বা ফ্লুইড ম্যানেজমেন্টের সমস্যা। শিশুদের শরীরে ফ্লুইড ব্যবস্থাপনায় খুব সতর্ক থাকতে হয় এবং সারাক্ষণ তা নজরে রাখতে হয়। ফ্লুইড কিছু কম বা বেশি হলে বড়রা ক্ষতি যতটা মানিয়ে নিতে পারেন, শিশুরা তা পারে না।
করণীয় বিষয়ে একজন শিশুরোগবিশেষজ্ঞ বলেন, শিশুদের ফ্লুইড ব্যবস্থাপনার বিষয়ে চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণের প্রয়োজন আছে। দ্বিতীয়ত, শিশুদের উপযোগী ‘ব্লাডপ্রেশার কাপ’ যেন সব জায়গায় পাওয়া যায়, সরকারকে তার ব্যবস্থা করতে হবে।
এবারের ডেঙ্গুতে শিশু মৃত্যুর বড় কারণ হলো দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হওয়া। এর আগে, হয়তো এই শিশুরা ডেঙ্গুর অন্যকোনো স্ট্রেইন দিয়ে আক্রান্ত হয়েছিল; এবার ভিন্ন ভেরিয়েন্টে আক্রান্ত হয়েছে, যার ফলে সিভিয়ারিটি বেড়েছে।”
এ বছর ডেঙ্গুর লক্ষণ বদলও শিশু মৃত্যুর অন্যতম কারণ উল্লেখ করে ডা. মাহবুব মুতানাব্বি বলেন, “আগে জ্বর ৩-৫ দিন থাকতো, এরপর জ্বর চলে গিয়ে শকে চলে যেত রোগী। জ্বর চলে যাওয়া এবং আবার জ্বর-এটাই ছিল শকে যাওয়ার লক্ষণ। কিন্তু এখন ১-২ দিনের জ্বরে রোগী শকে চলে যাচ্ছে, রোগীর ব্রেন অ্যাটাক হচ্ছে, খিচুনি হচ্ছে। হঠাৎ রোগীর অবস্থার অবনতি হচ্ছে, আইসিইউতে নিয়েও বাঁচানো যাচ্ছেনা।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ডেঙ্গুতে এখন পর্যন্ত ০-৫ বছর বয়সী ৩৪ জন, ৬-১০ বছর বয়সী ৪৪ জন, ১১-১৫ বছর বয়সী ২৪ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। ডেঙ্গুতে দেশে মোট মৃত্যুর ১২ শতাংশই শিশু।
ডেঙ্গু নিয়ে প্রচারণ-প্রচারণা না চালানো, চিকিৎসাসহ সবকিছুতে গুরুত্ব না দেওয়ায় অনেকেই ডেঙ্গু নিয়ে সচেতন নয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
ডা. মাহবুব মুতানাব্বী বলেন, “যতদিন ডেঙ্গুর প্রকোপ না কমে, ততোদিন শিশুর জ্বর হলেই ডেঙ্গু টেস্ট করতে হবে। জ্বরের সাথে কাশি, বমি, পেট ব্যাথা যেকোনো লক্ষণ থাকুক না কেনো চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। অনেক অভিভাবক অসচেতনার কারণেও রোগীকে হাসপাতালে আনতে দেরি করে; কিন্তু বাচ্চা যখন শকে চলে যায়, তখন আর কিছু করার থাকেনা।”
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক (ইন্টারনাল মেডিসিন) ডা. ফজলে রাব্বি চৌধুরী, “বড়দের মত বাচ্চারা ওরার্নিং সাইন (গুরুতর লক্ষণ) প্রকাশ করতে পারেনা। শিশুদের ক্ষেত্রে সিভিয়ার ডেঙ্গু যেটাতে ফ্লুইড লিক হয়, ব্লিডিং হয় বা শকে চলে যায় তা ম্যানেজ করা খুবই জটিল।”।
“তাই ডেঙ্গু হলে বাচ্চা প্লেফুল (হাস্যোজ্জ্বল) আছে কিনা, পানি শূন্যতা দেখা দিয়েছে কিনা, প্রস্রাব বন্ধ হয়ে গেছে কিনা– এসব বিষয় অভিভাবকদের লক্ষ্য রাখতে হবে, কোনো গুরুতর লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত হাসপাতালে যেতে হবে,” যোগ করেন তিনি।
শিশু হাসপাতালের পরিচালক ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ডেঙ্গুসহ যে কোনো রোগে শিশুরা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ থাকে। শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। বিশেষ করে এক বছরের কম বয়সি শিশুদের ডেঙ্গু হলেই পরিস্থিতি ভয়ংকর হতে পারে। ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের পালমোনারি হেমারেজ বেশি হয়। সঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু করতে না পারলে মাল্টি-অর্গান ফেইলিউর হয়ে শিশু মারা যেতে পারে। এছাড়া তাদের ফ্লুইড ম্যানেজমেন্টের ক্ষেত্রে নরমাল স্যালাইন দেওয়া যায় না। তিন মাসের নিচের বাচ্চাদের বেবি স্যালাইন লাগে। শিশুদের ফ্লুইড প্রয়োগের হিসাব একটু কঠিন। রোগের ধরন বুঝে সঠিক মাত্রায় ফ্লুইড দিতে না পারলে, ওভার ডোজ পড়লে পরিস্থিতি মারাত্মক হতে পারে।
বিএসএমএমইউ উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ডেঙ্গুজ্বরের গুরুত্বপূর্ণ সময় যখন রোগীর জ্বর ছেড়ে যায়। জ্বর ছাড়ার পরবর্তী ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টা ডেঙ্গু রোগীর ক্রিটিক্যাল সময়। এটি ডেঙ্গুজ্বরের গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এ সময় রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। ডেঙ্গুজ্বরের বিপজ্জনক উপসর্গ হলো- অনবরত বমি হওয়া, রক্তক্ষরণ হওয়া, তীব্র দুর্বলতা অনুভব করা, তীব্র পেটব্যথা, ফুসফুসে পানি জমা, তীব্র শ্বাসকষ্ট হওয়া। এবার শিশুদের ক্ষেত্রে ডেঙ্গুর জটিলতা বেশি দেখা যাচ্ছে। তাই ডেঙ্গু চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা শুধু যে মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসকরা করবে এমন নয়। বিভিন্ন বিভাগের চিকিৎসকদের এতে সম্পৃৃক্ত হতে হবে।
চলতি বছরে ডেঙ্গুর প্রকোপ নভেম্বর মাস পর্যন্ত থাকবে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, এবার অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত বর্ষা মৌসুম দীর্ঘায়িত হবে। নভেম্বরেও বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া থেমে থেমে বৃষ্টি আর এরপর টানা রোদে সবচেয়ে বেশি জন্মায় এডিস মশা। এমন পরিস্থিতি এডিস মশার বংশ বিস্তারের জন্য সবচেয়ে উপযোগী বলে মনে করেন কীটতত্ত্ববিদেরা। ডেঙ্গু এখন আর বর্ষাকালেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। গত ২ থেকে ৩ বছর ধরে এর প্রকোপ দীর্ঘ হচ্ছে। এবারও বছরের শুরু থেকেই ছিল ডেঙ্গু রোগী। আগস্টে শনাক্ত ও প্রাণহানি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, জুন-জুলাইয়ে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টি হলেও আগস্টে প্রায় ৩৬ ভাগ বেশি হয়েছে। সাধারণত বর্ষা মৌসুম শেষ হয় অক্টোবরের মাঝামাঝি, এবার কিছুটা দেরির সম্ভাবনা রয়েছে।