:: নাগরিক প্রতিবেদন ::
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, দেশে নির্বাচন সাজানো ও আত্মঘাতীমূলক প্রতিযোগিতা হচ্ছে। নির্বাচনের নামে কিছু একটা হবে, যার মাধ্যমে ক্ষমতা নির্ধারিত হবে এবং সেটি পাকাপোক্ত হবে। মানুষের ভোটের অধিকার নিশ্চিত হচ্ছে না।
‘অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন ও ন্যায্যতার লক্ষ্যে নাগরিক এজেন্ডা’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা উঠে আসে। এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম শনিবার সকালে রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে এই সংবাদ সম্মেলনে করে। এতে সভাপতিত্ব করেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।
নির্বাচন নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এটি প্রতিযোগিতাপূর্ণ হচ্ছে; তবে তা সাজানো ও অনেকটা আত্মঘাতীমূলক প্রতিযোগিতা। স্বেচ্ছায় হোক বা হুমকি ও জোরপূর্বক ভোটার নিয়ে আসা হোক; ভোটার অংশগ্রহণমূলক বলা যাবে। সাংবিধানিকভাবেও শুদ্ধ বলা যাবে, তাই আইনগতভাবে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। তবে এটি আসলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে না।
সংবাদ সম্মেলনে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ও পরবর্তী অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসা ছিল বেশি। মূলত চারটি বিষয়ে প্রশ্ন করেছেন তাঁরা। এগুলো হচ্ছে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অধিকারের বিষয়টি নির্বাচনী ইশতেহারে কতটা এসেছে, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সংজ্ঞা, বৈষম্যের সঙ্গে গণতান্ত্রিক জবাবদিহির সম্পর্ক ও নির্বাচনের পর পরিস্থিতি কী হতে পারে?
নাগরিক প্ল্যাটফর্মের কোর গ্রুপ সদস্য ইফতেখারুজ্জামান বলেন, নির্বাচনে সম্ভাব্য সব দল বা প্রার্থীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়নি, এটা তো পরিষ্কার। তার জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষেত্র তৈরি করা হয়নি। এতে মানুষের ভোটের অধিকার নিশ্চিত হচ্ছে না। এসব পরিপ্রেক্ষিতে একটা ঝুঁকি তৈরি হয়। যাঁরা এমন একচ্ছত্র ভুবন তৈরি করছেন, তাঁরাও জানেন, এতে অগণতান্ত্রিক শক্তির বিকাশ ঘটে। এটা কেউ চায় না। এটা সব নাগরিকের জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ। তাই দায়ও সবার নিতে হবে।
মিডিয়া ব্রিফিংয়ে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, নির্বাচনের নামে যেটা হচ্ছে, সেটাকে কী নামে অভিহিত করি, সত্যিই জানি না। প্রতিযোগিতাপূর্ণ হচ্ছে, যদিও সাজানো। পরিষ্কারভাবে সাজানো। এটা অস্বীকার করছে না কর্তৃপক্ষ। সাজানো এবং অনেকটা আত্মঘাতীমূলক প্রতিযোগিতা হচ্ছে। কাজেই নির্বাচন হিসেবে দাবি করার যৌক্তিকতা থাকে। একইভাবে ভোটারের অংশগ্রহণ হবে।
তিনি বলেন, সে অংশগ্রহণ বলপূর্বক হোক, স্বেচ্ছায় হোক, সামাজিক নিরাপত্তার বলয় থেকে বের করে দেওয়া হবে সে হুমকির মাধ্যমে হোক, মানুষ ভোট দিতে না গেলে নজরদারির আওতায় পড়বো, সেই ভয়েই হোক। ভোটারের অংশগ্রহণ হবে কিছুটা।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এতে স্টেকহোল্ডারসহ অনেকেই নাখোশ হবেন। কিছু কিছু প্রতিবাদ করবেন কয়েকদিন। তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে। ন্যায্যতার পথে যাত্রা আরও দীর্ঘ হবে।
তিনি বলেন, এসবের ফলে একচ্ছত্র ভুবন তৈরি হচ্ছে। এর প্রেক্ষিতে আমাদের সবাইকে মেনে নিতে হয় বাংলাদেশ ও নরওয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। নরওয়েতে একটা শিশু জন্মের পর থেকে তার মৌলিক অধিকার পায়। তার সিস্টেম সেটা নিশ্চিত করে। আর আমার দেশে মৌলিক অধিকার চিৎকার করে চাইতে হয়।
তিনি বলেন, সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। তার মাধ্যমে আমলাতন্ত্রের পাথরটা যথাসম্ভব ঠেলে নিয়ে যেতে হবে। আরেকটি যে সম্ভাবনা বা ঝুঁকি, এই প্রেক্ষিতে যারা একচ্ছত্র ভুবন তৈরি করছেন তাদের ভোলা উচিৎ নয়, আমি মনে করি তারা জানেন এই প্রেক্ষিতে অগণতান্ত্রিক শক্তির বিকাশ হয়। সেই সুযোগটি একচ্ছত্র ভুবন যারা তৈরি করছেন তারাই তৈরি করেছেন। আমরা সেটি চাই না। কেন না এটি সবার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
নির্বাচন কমিশনে (ইসি) জমা দেওয়া হলফনামা থেকে প্রার্থীর আয় ও সম্পদ সম্পর্কে জানার একটি বড় সুযোগ তৈরি করেছে বলে উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, দেশবাসী জানতে পারছে, তুলনা করার সুযোগ পাচ্ছে। বাস্তবে যদি ক্ষমতা যথাযথ প্রয়োগে ইসির সৎ সাহস থাকত, তাহলে তথ্য গোপন করার অভিযোগে অনেকের প্রার্থিতা বাতিল হতো। তা তো হচ্ছে না। তবে দুদক চাইলে স্বপ্রণোদিত হয়ে সম্পদের উৎস তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে পারে।
নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ও সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এটাকে নির্বাচন বলা যাবে না। এটি মূলত একটি বিশেষ নির্বাচনী তৎপরতা। ১৯৮৮ ও ১৯৯৬ (১৫ ফেব্রুয়ারি) সালেও এমন নির্বাচনে দেখা গেছে। নির্বাচনের ফলাফল টিকিয়ে রাখা কঠিন। প্রথাগত রাজনীতি দুর্বল হলে সামাজিক শক্তির দায় বাড়ে। তাই নাগরিকের দায় বেড়ে গেল, নিশ্চুপ থাকার সময় এটা না। নিজেদের সমস্যা নিজেদের সমাধান করতে হবে। আটলান্টিকের ওপার থেকে এসে কেউ সমাধান করে দেবে, এটা ভাবা উচিত না।
দেবপ্রিয় আরও বলেন, আয় বৃদ্ধির সঙ্গে নির্বাচিত হওয়ার নিবিড় সম্পর্ক আছে। যে যতবার নির্বাচন করছে, তার আয় গাণিতিক হারে তত বাড়ছে। বহুত্ববাদহীন নির্বাচনের বড় কুফল এটি। এখন এনবিআর এটি যাচাই করে দেখতে পারে। যে হারে সম্পদ বেড়েছে, সেই হারে কর দিয়েছেন কি না প্রার্থীরা। যদিও দেখা যাবে সবাই মুরগির খামারি ও মাছচাষি হয়ে গেছেন। তিনি আরও বলেন, অর্থনীতি যে সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র তা কীভাবে মোকাবিলা করবে? তাই এখানে নাগরিকের দায়িত্ব বেশি।
সংখ্যালঘুদের অধিকার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা সংখ্যালঘুদের অধিকার আদায়ে ব্যর্থ হয়েছি। আমরা যারা সংখ্যাগুরু আছি, ধর্মীয় মাপকাঠিতে সংখ্যালঘুদের অধিকারে গুরুত্ব দিইনি। আধিবাসী আন্দোলন, সংখ্যালঘু আন্দোলনসহ এ জাতীয় আন্দোলনগুলোকে আমরা সকলের জাতীয় আন্দোলনে রূপ দিতে পারিনি। আর এ কারণে আমাদের অনেক মূল্য দিতে হয়েছে, এমনকি বর্তমানেও দিতে হচ্ছে।
এ সময় বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমরা এখন সমান্তরাল বাস্তবতায় অবস্থান করছি। আমাদের অনেক অর্জন আছে, যেগুলোর জন্য আমরা নিজেদের গৌরবান্বিত মনে করি। তবে এসব অর্জনের পেছনেও আমাদের কিছু ব্যর্থতাও রয়েছে। আমাদের সমাজে এখনও যথেষ্ট পরিমাণ বৈষম্য আছে। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বণ্টনের ক্ষেত্রে ন্যায্যতায় সমস্যা আছে। বিডিএসের খানা জরিপেও বৈষম্যের বিষয়টি উঠে এসেছে।
তিনি বলেন, নির্বাচন যেহেতু সামনে আছে, জনপ্রতিনিধিদর কাছে এ বিষয়গুলো আমরা নিয়ে যাব। এর মধ্য দিয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর চ্যালেঞ্জগুলো সমাধানে দৃষ্টিপাত করেছি। ১১টি বিশেষজ্ঞ টিম করেছি। ১৩০ জনের মতো সদস্য আছে, প্রতি টিমে ১০/১৫ জনের মতো সদস্য ছিলেন।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, নাগরিক সমাজের সুপারিশ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন, সেখানে একটা ঘাটতি আছে।
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সালমা আলী বলেন, আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে নজরদারি ও জবাবদিহি থাকতে হবে। না হলে আইন থাকবে, বাস্তবায়ন হবে না।
সংবাদ সম্মেলনে জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা, জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্য এবং নীরব জনগোষ্ঠীর কণ্ঠকে শক্তিশালী করা; এ তিনটি বিষয়ের ওপর আলাদা নিবন্ধ উপস্থাপন করে সুপারিশ তুলে ধরা হয়। এগুলো তুলে ধরেন এম বি আকতার, ফারহান হোসেন ও আসিফ মোহাম্মদ। এতে বলা হয়, ২০২১ সালে দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে সহিংসতার কথা সবার জানা। এরপর দুই বছর কিন্তু পূজায় কোনো ঘটনা ঘটেনি। তার মানে সরকারের সদিচ্ছা থাকলে সম্ভব। আবার শান্তি চুক্তির মাধ্যমে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অধিকার নিশ্চিত করার যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, তা আজও পূরণ হয়নি চুক্তি বাস্তবায়ন না করায়।
মিডিয়া ব্রিফিংয়ে জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা, জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্য এবং ‘নীরব জনগোষ্ঠী’র কণ্ঠ শক্তিশালী করা বিষয়ে প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়।
প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন নাগরিক উদ্যোগ-এর প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন, উন্নয়ন কর্মী ও জেন্ডার বিশ্লেষক এম বি আখতার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আসিফ মোহাম্মদ শাহান।
মিডিয়া ব্রিফিংয়ের প্রেক্ষিত ও তাৎপর্য উপস্থাপন করেন সিপিডির ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সিপিডির ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান।
সংবাদ সম্মেলনে আরও বক্তব্য দেন নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন, এশিয়া ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কাজী ফয়সাল বিন সিরাজ প্রমুখ।