:: মুজতবা খন্দকার ::
কর্নেল গুলজার উদ্দিন আহমেদ। আমরা যাকে গুলজার ভাই ভাই বলে ডাকতাম। সজ্জন মানুষ। তখনও তিনি কর্নেল হননি। তার আগে থেকেই আমার সাথে পরিচয়। সময় পেলে টিএসসিতে আড্ডা দিতে আসতেন। আমরা তখন সদ্য ক্যাম্পাস ছেড়েছি। চোখে অনেক কিছু করার স্বপ্ন। গুলজার ভাই,বলতেন যা করছো, ওটাই ভালো করে করো। তখন আমি দৈনিক বাংলার ক্যাম্পাস রিপোর্টার। বলতেন,লেগে থাকলে তুমিও পেশায় নাম করতে পারবে। সময় পেলেই ছুটে আসতেন ক্যাম্পাসে। বয়সে উনার অনেক ছোট্ট। কিন্তু প্রশ্রয় দিতেন, সেটা ছিলো স্নেহভরা প্রশ্রয়। তখন বাংলা সিনেমার ক্রান্তিকাল চলছে, অশ্লীল ছবিতে সয়লাব সিনেমা হল। তিনি সিনেমা কলুষমুক্ত মিশনে নামলেন। সফলও হলেন। মনে পড়ে, সিলেটে শায়খ আবদুর রহমান, বাংলা ভাইদের বিরুদ্ধে ‘অপারেশন সুর্যদীঘল বাড়ি’র কদিন আগে একদিন দেখা হলো আমাদের বললেন, অনেক বড় অপারেশন আছে সামনে। গুলজার ভাই তখন র্যাবের ইন্টেলিজেন্ট উইং এ। আমি বললাম, কি সেই অপারেশন। বললেন,দুদিন পর জানতে পারবে। বেশী কৌতুহল ভালোনা! আমি বললাম,আপনি জানেন আমি রিপোর্টার। উনি মুচকি হেসে বললেন, এই জন্য তোমাকে লাইক করি। কৌতুহল কখনো মরতে দেবেনা!
র্যাবের সাফল্যের পর, গুলজার ভাই, বিডিআরের সেক্টর কমান্ডার পদে প্রমোশন পেয়ে সিলেটে পোষ্টিং পান।
একদিন, গুলজার ভাই, আমাকে ফোন করে বললেন, তুমি কোথায়? আমি বললাম কেন,অফিসে। গুলজার ভাই বললেন,অফিস থেকে কোথাও যেওনা। আমি তোমার অফিসে আসছি। গুলজার ভাই এলেন, পরনে পাঞ্জাবি। গাড়িতে নামলেন। বসলাম পাশের চায়ের দোকারে। একটা সিগারেট ধরালেন,আমাকেও দিলেন। উদাস ভংগীতে কিছুক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমাদের সাথে আর দেখা হবেনা। আমি আর র্যাবে থাকছিনা। আমার বদলী হয়েছে, বিডিআরে। সিলেটে পোষ্টিং। ঢাকা এলে কিম্বা তোমরা সিলেট গেলে হয়তো দেখা হবে। কিন্তু আগের মত, গুলজার ভাই কোথায়? বলে ফোন করলে আর আগের মত গুলজার ভাইকে পাবেনা। মৃদু হাসি দিয়ে কথাগুলো বললেন। আরো কিছুক্ষণ কথা বলে চলে গেলেন। কিন্তু আমার বিষন্ন হলো। বার বার মনে পড়তে লাগলো.. আর দেখা হবেনা… সত্যিই গুলজার ভাইয়ের সাথে সেই শেষ দেখা।
পচিশ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় শহীদ হলেন, দেশের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর কর্নেল গুলজার। নর্দমায় মিললো তার মরদেহ।
আমার জীবনটা হঠাৎ এলোমেলো হয়ে গেলো। কদিন আমি যেন ছিলাম অপ্রকৃতিস্থ! স্বজন হারানোর বেদনায় যেন নীল হয়ে যাচ্ছিলাম।
বারবার গুলজার ভাইয়ের কথা মনে পড়ছিলো… পিলখানা বিদ্রোহের একযুগ হবার প্রাক্কালে আজও কি জানতে পারলাম গুলজার ভাইসহ সেনাবাহিনীর ৫৭ জন অফিসারের নির্মম মৃত্যুর পেছনে কি ছিলো,কারা ছিলো। আমাদের বিডিআর জওয়ানদের ডালভাত কর্মসূচীর কথা বলা হয়। কিন্ত এটা তো কোনো কারন নয়, উপসর্গ হতে পারে,রোগ নয়। স্বাধীনতা যুদ্ধেও আমাদের এত অফিসার প্রান দেয়নি। অথচ নিরস্ত্র অফিসারদের নৃসংস, নির্মমভাবে হত্যা করলো,এদেশেরই সন্তানরা,যাদের পরিচয় জওয়ান। কেন জানি আমার বিশ্বাস হয়না। মন আমার অন্য কথা বলে। মনে পড়ে সেনা সদরে অফিসারদের প্রধানমন্ত্রীর সেই দরবারের কথা। সতীর্থদের হত্যা যারা চেয়ে চেয়ে দেখেছেন কিছুই করতে দেয়া হয়নি, তাদের ক্ষোভের কথা।
হয়তো একদিন সব সত্য জানা যাবে। সব কিছু প্রকাশ্যে আসবে। একদিন সেই সময়ের সেনাপ্রধান মঈন উদ্দিন আহমেদ। বিবেকের দংশনে সব সত্য প্রকাশ করবেন।
কিন্তু আমি অতদিন অপেক্ষার প্রহর গুনতে চাইনা। আমি চাই, গুলজার ভাইসহ ৫৭ জন সেনাকর্মকর্তার হত্যাকারী এবং তাদের মদদদাতাদের হত্যার সমুচিৎ শাস্তি। না হলে গুলজার ভাইয়ের আত্মা শান্তি পাবেনা।
কেবল আমি, অপরাধবোধে ভূগি। গুলজার ভাই,তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধি করে দেয়, আমি আর ঘুমোতে পারিনা.. আমাদের তুমি ক্ষমা করোনা। অভিসম্পাত করো.. এটাই আমাদের পাওনা.. আমরা অযোগ্য.. অভাগা,ভীরু, একশিয়া!
লেখক: এনটিভির বার্তা সম্পাদক