:: ফারহানা আশা ::
স্কুল জীবনে খুব বেশি ভালো ছাত্রী ছিলাম না, কিংবা বলা যায় সিরিয়াস ছিলাম না। তবে আমি আর আমার প্যারেন্টস সন্তুষ্ট ছিলো আমার রেজাল্টে।
আমি ক্লাস টেন পর্যন্ত কোন হোম টিউটরের কাছে পড়িনি, প্রয়োজন পড়েনি কিংবা বলা যায় আব্বুর ওতো টাকা ছিলোনা পড়ানোর মতো।
জাস্ট টেস্ট দেয়ার আগে মনে হলো এখন একটু কোচিং এ ভর্তি হওয়া দরকার৷ তো আব্বু তার পরিচিত ছোট ভাইয়ের কোচিং এ ভর্তি করিয়ে দিলো৷ কোচিং এ যে প্রতিষ্ঠাতা স্যার ছিলেন, তিনি ছিলেন আমার দেখা বেষ্ট একজন মানুষ এবং টিচার।
তার ওখানে যারাই পড়তে যেতো কেউ ই ঠিকঠাক টাকা পরিশোধ করতো না কিন্তু তিনি তার পড়া থামায়নি। অদ্ভুত সুন্দর কঠিন মায়া আর শাসনের সংমিশ্রণে পড়াতেন তিনি আমাদের।
আমি যে মেয়ে অংক কে যমের মতো ভয় পেতাম সে পর্যন্ত টেষ্ট পরীক্ষায় অংকে ৮৭ পেয়েছিলাম তার বদৌলতে। আমাদের সময়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে সেরা কঠিন প্রশ্ন হয়েছিলো- আলহামদুলিল্লাহ ভালো মতোই উৎরে গিয়েছিলাম সেই সময়ে।
তিনি আমাকে এতোটাই আদর আর স্নেহ করতো, লাস্ট তিন মাস তিনি আমাকে ফ্রীতে পড়িয়েছেন। আমি কৃতজ্ঞ তার প্রতি আজীবন।
এরপর এলাম কলেজ জীবনে ৷ ভালো কোন কলেজে যাওয়ার স্বপ্ন আমার কখনোই ছিলোনা, তবে ইচ্ছা ছিলো সিটি কলেজে পড়ার। সেটা হয় নি, কিভাবে যেন চান্স পেলাম আরেক ভালোবাসার জায়গায়- আমার দেখা ওয়ান অফ দ্যা সেরা ডিসিপ্লিনড প্রতিষ্ঠান, নূর মোহাম্মদ রাইফেলস পাবলিক কলেজ।
আমার জীবনের মোড় ঘুড়িয়ে দিয়েছে যে প্রতিষ্ঠানটি। শিক্ষাজীবন যে কতোটা উপভোগের হতে পারে তা এখানে না এলে জানতাম ই না। আমার ক্লাস শিক্ষক যিনি ছিলেন, তিনি ছিলেন আমার দেখা দ্বিতীয় সেরা মানুষ কাম শিক্ষক। তিনি আমাদের ব্যাচ করে একাউন্টিং পড়াতেন।
ওই সময়ে এক হাজার টাকা দিয়ে পড়ানো আসলে আমাদের জন্যে অনেক, সো যথারীতি স্যার আমাকে ফ্রীতে পড়াতেন কিন্তু সেটা কেউ ই জানতো না৷ মজার বিষয় হলো, সেই কলেজে যতো গুলি সাবজেক্টের ব্যাচ হতো, স্যার সবাই কে পার্সোনালি বলে দিয়েছিলেন আমার কথা, যার প্রেক্ষিতে আমাকে সবাই ই ফ্রী তে পড়াতো।
আমি ও তাদের নিরাশ করিনি কখনো, আমার ক্লাসে সেরাটা আমি দেয়ার চেষ্টা করেছি আলহামদুলিল্লাহ। আমি কৃতজ্ঞ প্রতিটি শিক্ষকের এই মহানুভবতার কাছে।
একটুর জন্যে জিপিএ ফাইভ পাইনি কিন্তু যা পেয়েছি তাও আমার মতো মেয়ের জন্যে কম ছিলোনা।
যার ফলশ্রুতিতে এখন যেটা দেশের ওয়ান অফ দ্যা বেষ্ট ভার্সিটি থেকেই বার বার ডাক পেয়েছিলাম তাদের ওখানে ভর্তি হওয়ার জন্যে। যেখানে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়া স্বপ্নের মতো আর ব্যয় বহুল সেখানে ১০০% ওয়েভারে পড়েছিলাম শুধু মাত্র আমার মেধার উপর ভিত্তি করে।
এবং সেটাকে প্রতি সেমিষ্টারে ধরেও রাখতে হয়েছিলো ওয়েভার কন্টিনিউ করার জন্যে। যার কারনে প্রথম দুই বছর আলহামদুলিল্লাহ সিজিপিএ কখনোই ৩.৭ এর নিচে নামে নাই।
কিন্তু ধস নামে আব্বুর আকস্মিক মৃত্যুতে, হুট করে আব্বুর চলে যাওয়া আমাকে থামিয়ে দিয়েছিলো, তবে সেটাও ক্ষণিকের জন্যে।
আমি চেষ্টা করে গিয়েছি প্রতিনিয়ত এবং ওই সময়েই ক্লাশের পাশাপাশি চালিয়ে গিয়েছি সেখান কার লাইব্রেরিতে খণ্ডকালীন জব। আমার প্রিয় প্রতিষ্ঠান ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির প্রতিটা টিচারের কাছে ও আমি আজীবন কৃতজ্ঞ। তারাও আমাকে অসম্ভব স্নেহ করেছেন, সাপোর্ট দিয়েছেন।
ইচ্ছা ছিলো পড়া শেষে জব করার, তা আর হয়ে উঠেনি। বিয়ে নামক সুতায় বাঁধা পড়ে যাই। স্বামীর প্রেরণায় এমবিএ তে ভর্তি হয়েও মাঝ রাস্তায় প্রেগু হয়ে যাই। আইয়ানকে পেটে নিয়ে প্রায় ৮ মাস পর্যন্ত ক্লাশ করেছি, ভীষণ কষ্ট হতো সেই সময় বাস জার্নি করতে মিরপুর থেকে ধানমন্ডিতে, তারপরেও করেছি আম্মু আর স্বামীর প্রেরণায়।
তারপর আমার প্রথম সন্তান আইয়ানকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাওয়া এবং প্রায় ১ বছরের গ্যাপে আবার নতুন করে কন্টিনিউ করা, ইটস নট আ কাপ অফ টি। ৮ মাসের বাচ্চাকে ওর নানু কিংবা বাবার কাছে রেখে ক্লাস করতে যাওয়া, ইটস সো টাফ।
আমার যেদিন লাস্ট সেমিষ্টার ফাইনাল, আমার মনে আছে আইয়ানের টাইফয়েড ধরা পড়েছিলো তখন, ওই টুকুন বাচ্চার হাতে ক্যানুলা- আমি কিছুই পড়তে পারিনি, শুধুই কেঁদেছি ৷ ভেবেছিলাম পরীক্ষা দিবোনা, কিন্তু দিয়েছিলাম শুধু মাত্র আমার ছেলেকে বলবো বলে, তোমার মা হেরে যায় নি।
আলহামদুলিল্লাহ সেটাও পাড় করেছিলাম। ধুকতে ধুকতে হলেও কোন টাই কিন্তু হাল ছাড়িনি।
মেয়ে থেকে মা হয়েছি, লড়াই করেছি, নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছি সমাজের প্রতিটি অশুভ স্পর্শ থেকে এবং যথারীতি এখন আমি একজন সফল গৃহিণী এবং মা।
কি হলো এতো এতো ভালো রেজাল্ট আর ত্যাগ দিয়ে? কি হলো এতো এতো উচ্চ সার্টিফিকেট দিয়ে?
অনেক কিছুই হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ, আমি এমন একজন মা হতে পেরেছি যার সন্তানদেরকে সেরাটাই দিতে পারছি, ঘর সংসার সামলে দুই ছেলের পড়ার দায়িত্ব নিতে পেরেছি। সেটাও তো সব মা ই করে? তাহলে এক্সেপসন কিসে?
আচ্ছা, তার আগে ছোট একটা বিষয় শেয়ার করি। গত পরশু আইয়ানের স্কুলে গিয়েছিলাম ওকে পিক করতে। সেখানে তার এক বন্ধুর মা আমাকে জিজ্ঞাস করছিলো, ভাবি আপনি কি আপনার ছেলেকে কোচিং এ দিয়েছেন। আমি বললাম, না।
সে বললো, কি বলেন ভাবী, এতো সময় কই আমাদের, এতো প্যাড়া নিয়ে লাভ আছে, আর আমি ওতো ইংলিশ বুঝি ও না ( এটা তাকে ছোট করার জন্যে লিখছিনা, তার সরল স্বীকারোক্তি মাত্র) তাই এই স্কুলেই ৭০০০/ টাকা দিয়ে কোচিং এ দিয়ে দিয়েছি দুই ছেলেকে।
আমি কিছু বলিনি, শুধু হেসেছি, আমার তো তিন টা বাচ্চা, আমার অবস্থা আরো ও করুণ। কিন্তু আমি যতো কষ্ট ই হোক নিজে পড়াই ওদের৷ এবং ওরা ভর্তি হয়েছে এই জানুয়ারিতে, ইংলিশ মিডিয়ামে যেখানে ভর্তি চলে জুন থেকে সেখানে ওদের ছয় মাস ওরা মিস করেছে।
এবং এই দুই মাসে ওদের যা অর্জন আলহামদুলিল্লাহ তা ঈর্ষণীয়, আমার ছেলে বলে বলছিনা, আলহামদুলিল্লাহ দুজনেই ক্লাসে বেশ ভালো করছে, ভালো মানে অপ্রত্যাশিত ভালো। এই ভালোর পিছনে অবশ্যই একজন শিক্ষিতা মায়ের হাত আছে তাই না?
এবার বলুন- আমার এতো এতো ডিগ্রীর প্রাপ্তি টা কই? আমি জানি অনেক টা পথ বাকী, অনেক কিছু ই এখনো করতে হবে, তবে আমি আশাবাদী। ইনশাআল্লাহ একজন শিক্ষিতা মায়ের সন্তানেরা অন্তত খারাপ মানুষ হবে না, সমাজের বোঝা হবেনা- তফাৎ টা শুধু এটাই।
জব করলে হয়তো আমার আর্নিংটা আরেকটু ভালো হতো কিন্তু এই জব টাই বা কম কিসের যেখানে আমার প্রাপ্তি পুরাটাই আমার কাছে জমা থাকে- তাদের ভালোবাসা, তাদের দুষ্টামী, তাদের সফলতা, তাদের আদর এবং তাদের সম্মান।
এতকিছু লেখার একটাই উদ্দেশ্য- পড়ালেখা করে কি হলো, এখন তো বাসায় বুয়াগিরি করি – এই কথার আড়ালেও লুকিয়ে থাকে আমাদের মতো শিক্ষিতা মায়েদের অনেক অনেক আবেগ, ভালোবাসা আর ত্যাগ। দিনশেষে সন্তানেরা জিতলেই জিতে যায় মা- হোক সেটা কর্মজীবী মা কিংবা গৃহিণী মা।