:: নাগরিক নিউজ ডেস্ক ::
আগাম বিজয় ভাষণ দিয়ে হারের পথে নওয়াজ শরিফ। পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী কারাবন্দী ইমরান খান নির্বাচন কমিশন ঘোষিত ২২০ আসনের প্রাথমিক ফলাফলে এগিয়ে রয়েছেন। দ্বিতীয় স্থানে আছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের দল। তারপরই রয়েছে বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারির দল।
প্রাথমিক ফলাফলে দেখা যায়, ২২০ আসনের মধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৯০টি আসনে জয় পেয়েছেন। যার অধিকাংশই ইমরান-সমর্থিত প্রার্থী। দ্বিতীয় স্থানে থাকা নওয়াজের দল পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) পেয়েছে ৬২ আসন, আর তৃতীয় স্থানে থাকা বিলাওয়ালের পাকিস্তান পিপলস পার্টি পেয়েছে ৫০টি আসন। এ ছাড়া মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট (এমকিউএম) ১১টি এবং ইসতিকাম-ই-পাকিস্তান পার্টি (আইপিপি), জমিয়ত ওলেমা-ই-ইসলাম পাকিস্তান (জেইউআই-পি) ও পিএমএল দুটি করে আসনে ফল পেয়েছে। একটি আসনে জিতেছে পাখতুনখাওয়া ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি পাকিস্তান (পিএনএপিএফ)।
স্বতন্ত্র প্রার্থীদের তুলনায় পরিষ্কার ব্যবধানে পিছিয়ে থাকলেও সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং পিএমএল-এন নেতা নওয়াজ শরিফ বলেছেন, সাধারণ নির্বাচনে তাঁর দল ‘একক-বৃহত্তর দল’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তবে সরকার গঠনের জন্য দলটি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না স্বীকার করে বিলাওয়াল ভুট্টোর পিপিপিসহ মাওলানা ফজলুর রহমান ও মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্টের খালিদ মকবুল সিদ্দিকীকে জোট সরকার গঠনের প্রস্তাব দেন।
বাংলাদেশ সময় শুক্রবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে লাহোরে সমর্থকদের উদ্দেশে এক ভাষণে নওয়াজ বলেন, ‘আমরা সব দল এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ম্যান্ডেটকে সম্মান করি।’
এ সময় ‘ঐক্য সরকার’ গঠনের ইঙ্গিত দিয়ে নওয়াজ বলেন, ‘সব দলের দায়িত্ব একসঙ্গে সরকার গঠন করা এবং পাকিস্তানকে বর্তমান সংকট থেকে বের করে আনা। আমরা যদি সবাই একসঙ্গে কাজ করি তবেই পাকিস্তান এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসবে।’
পাকিস্তানে কোনো দল একক সরকার গঠন করতে চাইলে ১৩৪টি আসনে জিততে হবে। তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নাও পেতে পারে দলগুলো। এবার জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে ২৬৬ আসনে ভোট হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নির্বাচনের আগে দুর্বৃত্তের গুলিতে এক প্রার্থী নিহত হওয়ায় একটি আসনে ভোট স্থগিত করা হয়।
পিটিআই প্রতিষ্ঠাতা ইমরান কারাবন্দী এবং প্রার্থী হতে না পারলেও দলটি অবশ্য সব সময় নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে আশা না ছাড়ার কথা জানিয়েছে।
পিটিআই নেতাদের কেউ কেউ কারাবন্দী অবস্থায় ভোটের প্রচার চালিয়েছেন। আদালতে দোষী সাব্যস্ত না হওয়ায় কারাগারে থেকেও তাঁরা নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। অন্যরা পুলিশের চোখ এড়িয়ে আত্মগোপনে থেকে নির্বাচনী প্রচার চালিয়েছেন।
পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলের খাইবার পাখতুনখাওয়ার প্রাদেশিক সরকারের একজন মন্ত্রী ছিলেন আসিফ খান। নিজের নির্বাচনী প্রচারের অংশ হিসেবে তিন মিটার দৈর্ঘ্যের একটি পর্দায় ভিডিও সম্প্রচারের মাধ্যমে দলের সমর্থক ও ভোটারদের সামনে হাজির হয়েছিলেন তিনি। শহরে শহরে তাঁর এই ভিডিও বক্তব্য দেখানো হয়।
আসিফ খান বলেছেন, গত মে মাস থেকে তিনি আত্মগোপনে আছেন। সে কারণে ভোটারদের কাছে তাঁর বার্তা পৌঁছানোর একমাত্র মাধ্যম ছিল এটা। কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, আসিফ খানের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে। অন্যদিকে এই সরকারের অধীন ন্যায়বিচার পাবেন না বলে মনে করেন এই পিটিআই নেতা।
নিজের নির্বাচনী প্রচার নিয়ে ভোটের আগে আসিফ খান বলেন, ‘এটা সম্পূর্ণ ভিন্ন অভিজ্ঞতা। সমাবেশে নয়, মঞ্চে নয়, জনতার মধ্যেও নয়। তবে আমরা এটা সামলে নেওয়ার চেষ্টা করছি।’
তরুণ ভোটাররাই পিটিআইয়ের সবচেয়ে বড় শক্তি বলে উল্লেখ করেছিলেন আসিফ খান। তিনি বলেছিলেন, ‘তাঁরা (তরুণেরা) ডিজিটাল মিডিয়া, মুঠোফোন ব্যবহার করছেন। সে কারণে আমরা মনে করছি, এসবের মাধ্যমে তাঁদের সঙ্গে আমাদের বেশি সম্পৃক্ত হওয়া উচিত। আমরা এখন শুধু এটাই করতে পারি। ডিজিটাল মাধ্যমে প্রচারণা চালাতে পারি।’
পাকিস্তানে এরই মধ্যে জোট সরকার গঠন নিয়ে শুরু হয়েছে আলোচনা। তবে পিটিআইর প্রভাবশালী নেতা ব্যারিস্টার গহর আলি খান দাবি করেছেন, পিটিআই জাতীয় পরিষদে ১৫০ আসনে জয়ের কাছাকাছি রয়েছে। তাই কেন্দ্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার গঠন করবেন তারা। ব্যারিস্টার গহর জিও নিউজকে বলেন, ‘আমরা পিপিপি বা পিএমএল-এনের সঙ্গে (জোট সরকার গঠনের জন্য) যোগাযোগ করছি না।’
তিনি বলেন, পিটিআই পাঞ্জাবেও সরকার গঠন করবে। এ ছাড়া খাইবার পাখতুনখোয়ায় পিটিআই স্পষ্ট ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছে এবং সেখানেও সরকার গঠন করবে। পিটিআই সংসদে থাকবে এবং তার ভূমিকা পালন করবে।’ হর্স ট্রেডিংয়ের আশঙ্কার মধ্যে পিটিআইর স্বতন্ত্র প্রার্থীরা দলীয় নির্দেশের বিরুদ্ধে কোনো দলে যোগ দেবেন না বলে জানান গহর।
পিএমএল-এনের সিনিয়র নেতা ইসহাক দার দাবি করেছেন, বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থীরা তাঁর দলের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। নওয়াজ শরিফ ‘বিজয় ভাষণ’ দিতে চলেছেন বলে তাঁর দল দাবি করেছে।
ইসলামাবাদের রাজনৈতিক বিশ্লেষক রফিউল্লাহ বলছেন, স্বতন্ত্ররা তাদের মনমতো দলে যোগ দেওয়ার জন্য সময় পাবেন তিন দিন। যেহেতু পিটিআই কার্যকর কোনো রাজনৈতিক দল নয়, দলটির নেতা ইমরান খান জেলে আছেন, সে কারণে দলটির অনুসারীদের অন্য একটি রাজনৈতিক দলেই যোগ দিতে হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পিপিপি এবং পিএমএল-এন– দু’দলই তাদের দলে স্বতন্ত্রদের যোগ দেওয়ার জন্য আকৃষ্ট করার চেষ্টা চালাচ্ছে।
রফিউল্লাহ বলেন, এ পরিস্থিতিতে স্বতন্ত্রদের জন্য দুটো বিকল্প সামনে আছে। এক. বিলাওয়ালের পিপিপির সঙ্গে জোট গড়া এবং আরেকটি ছোট পার্টি গড়া। আর দুই. এই স্বতন্ত্রদের পিটিআইতে যোগ দেওয়ানো হতে পারে।
২০২২ সালের এপ্রিলে সেনা সমর্থিত অনাস্থা ভোটে ইমরানকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। তার পর তিনি একটি হত্যা প্রচেষ্টা থেকে বেঁচে গেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে ১৮০টিরও বেশি মামলা দেওয়া হয়েছে। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে তিনটি মামলায় তাঁকে ৩১ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির সরকার ও পাবলিক পলিসির সহযোগী অধ্যাপক মায়া টিউডর বলেন, পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর নিরঙ্কুশ সমর্থন ছাড়া কেউ শাসন করতে পারে না। তবে এবার যা আলাদা, তা হলো সামরিক বাহিনী প্রকাশ্যে পিটিআইকে টার্গেট করছে। কারণ তৃণমূলে তাদের সমর্থন রয়েছে এবং তারা প্রযুক্তি সচেতন।
উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান টাইম ম্যাগাজিনকে বলেছেন, এটা খুব স্পষ্ট যে, সামরিক বাহিনী নার্ভাস ছিল এবং তার পরে ফলাফলে পিটিআইর প্রত্যাশা ছাড়িয়ে যাওয়া (তাদের জন্য) একেবারেই এক বড় ধাক্কা।
তিনি বলেন, ‘সেনাবাহিনী চায় পরবর্তী সরকার অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের দিকে মনোনিবেশ করুক এবং স্পষ্টভাবে আশা করে, এটি ইমরান খানকে আরও কয়েক বছরের জন্য জেলে রেখে দিতে। তবে তাদের চ্যালেঞ্জ কেবল বাড়তে চলেছে। কারণ পিটিআইর ঘাঁটি আরও সংক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে।’
পোলিং গ্রুপ গ্যালাপ পাকিস্তানের নির্বাহী পরিচালক বিলাল গিলানি বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেছেন, পিটিআই সরকার গঠন করতে না পারলেও এ নির্বাচনে দেখা যাচ্ছে তাদের রাজনৈতিক কূটকৌশলেরও সীমাবদ্ধতা আছে। দেখা যাচ্ছে, সামরিক বাহিনীও সব সময় পথ খুঁজে পায় না– এটাই আশার কথা।
দেশটির সিনিয়র সাংবাদিক হামিদ মীর জিও নিউজে এক নিবন্ধে লিখেছেন, ইমরানকে জেলে পুরে নির্বাচনে অযোগ্য এবং দোষী সাব্যস্ত করা হলেও রাজনীতি থেকে তাঁকে বাদ দেওয়া যায়নি। এর আগে নওয়াজ শরিফ আদালতে দোষী সাব্যস্ত ও অযোগ্য হওয়ার পর ফিরতে পারলে ইমরান খান কেন নয়? নওয়াজ শরিফ উচ্চ আদালত থেকে মুক্তি পেতে পারলে ইমরান খান কেন নয়?