:: নাগরিক প্রতিবেদন ::
দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ট্রান্সকম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম লতিফুর রহমানের মেয়ে শাযরেহ হকের মামলায় পাঁচ কর্মকর্তার জামিন বাতিল করেছেন আদালত।
রোববার ঢাকা মহানগর হাকিম তিন মামলায় আদেশে তাদের জামিন বাতিল করেন। মঙ্গলবার আসামিদের আইনজীবী জামিরুল ইসলাম বিষয়টি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।
জামিন বাতিল হওয়া পাঁচ কর্মকর্তা হলেন- ট্রান্সকম গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক মো. ফখরুজ্জামান ভুঁইয়া, পরিচালক কামরুল হাসান, পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন, সহকারী কোম্পানি সচিব মোহাম্মদ মোসাদ্দেক ও ব্যবস্থাপক আবু ইউসুফ মো. সিদ্দিক।
সম্পত্তি আত্মসাৎ-সংক্রান্ত তিন মামলায় গত ২২ ফেব্রুয়ারি এই ৫ জনকে গ্রেফতার করে পিবিআই। পরদিন তাদের ভিন্ন ভিন্ন মামলায় রিমান্ড আবেদন নাকচ করে শর্তসাপেক্ষে জামিন দেন আদালত। শর্তে বলা হয়, ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রত্যেকের পাসপোর্ট আদালতে দাখিল করতে হবে।
রোববার পাসপোর্ট দাখিল না করায় আদালত প্রত্যেকের জামিন বাতিল করেন এবং গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন।
এর আগে সম্পত্তি-সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে তিনটি মামলা করা হয়। মামলাগুলো করেন মরহুম লতিফুর রহমানের মেয়ে শাযরেহ হক। মামলাগুলোয় অবৈধভাবে ট্রান্সকম গ্রুপের শেয়ার স্থানান্তর, লতিফুর রহমানের টাকা বেআইনিভাবে এক হিসাব থেকে অন্য হিসাবে স্থানান্তর করে আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে।
এ বিষয়ে অ্যাডভোকেট জামিরুল ইসলাম বলেন, “২৫ ফেব্রুয়ারি পাসপোর্ট দাখিল করার জন্য গেলেও একটু দেরি হওয়ার কারণে আদালত পাসপোর্ট জমা নেননি।”
কোম্পানির শেয়ার ও সম্পদ নিয়ে দ্বন্দ্বে গত ২২ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর গুলশান থানায় ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান, সিইওসহ আটজনের নামে পৃথক তিনটি মামলা করেন মরহুম লতিফুর রহমানের ছোট মেয়ে শাযরেহ হক। মামলায় শাযরেহ হকের মা শাহনাজ রহমান, বড় বোন সিমিন রহমানসহ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের নাম উল্লেখ করা হয়।
মামলার নথিতে শাযরেহ লিখেছেন, তার বাবা বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট ও এফডিআরে প্রায় ১০০ কোটি টাকা রেখে মারা যান। ওই অর্থের মনোনীত ব্যক্তি (নমিনি) ছিলেন তার মা শাহনাজ রহমান।
শাযরেহ অভিযোগ করেছেন, ২০২০ সালের ১ জুলাই লতিফুর রহমান মারা যাওয়ার পর ওই টাকা তার উত্তরাধিকারীদের (ওয়ারিশ) মধ্যে বণ্টন করে দেওয়ার কথা ছিল।
কিন্তু তার বাবার মৃত্যুর পর তার বড় বোন (সিমিন) সব টাকা নিজের ও তার মায়ের অ্যাকাউন্টে সরিয়ে ফেলেন বলে মামলার এজাহারে দাবি করেছেন শাযরেহ।
শাযরেহ আরও দাবি করেছেন, ২০২০ সালের ৩ আগস্ট তার বড় বোন ট্রান্সকম ইলেকট্রনিক্সের ১৮ শতাংশ শেয়ার উক্ত প্রায় ১০০ কোটি টাকা থেকে ৬০ কোটি টাকা দিয়ে কিনে নেওয়ার বাহানায় নিজের নামে হস্তান্তর করেন।
শাযরেহ দাবি করেছেন, তার বোন ও মা পরস্পরের যোগসাজশে লতিফুরের অন্যান্য উত্তরাধিকারীদের বঞ্চিত করে এই কাজ করেছেন।
আরেক মামলায় শাযরেহ দাবি করেছেন, তার বোন ট্রান্সকমের আরও চার কর্মকর্তার সহযোগিতায় জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে তিনটি ফর্ম ১১৭ (হস্তান্তর দলিল) তৈরি করে রেজিস্ট্রার অভ জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মসে (আরজেএসসি) জমা দিয়ে বেআইনিভাবে ট্রান্সকমের বেশিরভাগ শেয়ারের মালিকানা নিয়ে নেন।
মামলার এজাহারে আরও বলা হয়েছে, বাদীকে জানানো হয়েছিল যে তার পিতা তাকে ৪ হাজার ২৭০টি শেয়ার, তার ভাই আরশাদ ওয়ালিউর রহমানকে ৪ হাজার ২৭০টি শেয়ার এবং তার বোনকে ১৪ হাজার ১৬০টি শেয়ার হস্তান্তর করেছেন।
কিন্তু বাদী কখনোই হস্তান্তর দলিলে (ফর্ম ১১৭) স্বাক্ষর করেননি বলে দাবি করেছেন। তার বাবাও জীবিতাবস্থায় কখনও হস্তান্তর দলিলে স্বাক্ষর করেননি বলে দাবি করেছেন বাদী শাযরেহ হক। আসামিরা এসব নথি জালিয়াতির মাধ্যমে তৈরি করেছেন বলে অভিযোগ করেছেন তিনি।
আরেকটি মামলায় শাযরেহ দাবি করেছেন, তার মা ও বোন ট্রান্সকমের অন্য তিন কর্মকর্তার সহযোগিতায় তার (শাযরেহ) এবং তার ভাই আরশাদ ওয়ালিউর রহমানের স্বাক্ষর জাল করে ডিড অভ সেটেলমেন্ট (মীমাংসার দলিল) তৈরি করেছেন।
শাযরেহ দাবি করেছেন, পরে ওই ডিড অভ সেটেলমেন্ট ব্যবহার করে সিমিন ও শাহনাজ ট্রান্সকম গ্রুপের শেয়ার নিজেদের নামে হস্তগত করাসহ গ্রুপের চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং সিইওর পদ নিজেদের নামে করে নিয়েছেন।
শাযরেহ দাবি করেছেন, তিনি কখনও তার পরিবারের কোনো সদস্যের সঙ্গে ডিড অভ সেটেলমেন্ট করেননি।
তিনটি মামলার মধ্যে বাংলাদেশ দণ্ডবিধি, ১৮৬০-এর নিম্নলিখিত ধারাগুলো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে: ৪০৬, ৪১৯, ৪২০, ৪৬৭, ৪৬৮, ৪৭০ ও ৪৭১।
৪০৬ নং ধারাটি বিশ্বাসের ফৌজদারি লঙ্ঘন; এ অপরাধের শাস্তি তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড, জরিমানা অথবা উভয়ই। শাযরেহ হক তার মা ও বোন দুজনকেই এ অভিযোগে অভিযুক্ত কছেরেন।
তিনি তাদের উভয়ের বিরুদ্ধে প্রতারণা (৪১৯); মূল্যবান জামানত, উইল ইত্যাদি জালিয়াতির জন্য জাল সীলমোহর তৈরি (৪৬৭); প্রতারণার উদ্দেশ্যে জালিয়াতি (৪৬৮), জাল দলিল (৪৭০) এবং জাল দলিলকে খাঁটি দলিলরূপে ব্যবহার (৪৭১) ব্যবহার করার জন্য অভিযুক্ত করেছেন।
উল্লেখ্য, দেশের অন্যতম বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত ট্রান্সকম গ্রুপ। গ্রুপটির অধীনে পরিচালিত কোম্পানিগুলোর মধ্যে এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস, ট্রান্সকম বেভারেজেস, ট্রান্সকম ডিস্ট্রিবিউশন, ট্রান্সকম কনজিউমার প্রোডাক্টস, ট্রান্সকম ফুডস, ট্রান্সকম ইলেকট্রনিকস, ট্রান্সক্রাফট, মিডিয়াস্টার (প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, বিজ্ঞানচিন্তা, কিশোর আলো) অন্যতম।