:: লাবিবা বুশরা নিশি ::
সারা বিশ্ব যখন করোনা জ্বরে আক্রান্ত, ডয়েচল্যান্ডে যেন ভিন্ন এক চিত্র! যদিও প্রতিদিনই করোনা রোগীর সংখ্যাটা সমানুপাতিক হারে এখানে বেড়েই চলছে, কিন্তু জার্মানদের দেখে বোঝার উপায় নেই সারা বিশ্বে করোনা কি পরিমান ভীতির জন্ম দিয়েছে মানুষের মাঝে! উল্টো তাদের কাছে বিষয়টা মজার কিছুতে পরিণত হয়েছে! এইতো সেদিন কাজ শেষে ট্রেনে করে বাসায় ফিরছি কোথাও এক ফুটবল ম্যাচ শেষে হাজার হাজার মানুষ একসাথে ট্রেনে উঠলো (ঠিক আমাদের দেশের লোকাল ট্রেনের মতো) আর একসাথে গান গাওয়া শুরু করলো “ক ক করোনা, আইন টটে, সোয়াই টটে, নখ আইনে টটে, করোনায়ায়ায়া” যার বাংলা অর্থ দাড়ায় একজন মারা গেলো, দুইজন মারা গেলো আরো একজন মারা গেলো, করোনা! ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না মারা যাওয়া বিষয় টা কি কারো কাছে মজার মনে হতে পারে! উল্টো এত মানুষ দেখে স্কার্ফ দিয়ে মুখ ঢেকে বসে থাকায় আমাকে রীতিমত অপদস্ত হতে হলো! তার উপরে এশিয়ান চেহারা হলে তো আর কথাই নেই!
পুরো জার্মানিতে যত করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী তার অর্ধেকটা একাই নর্থ রাইন ভেস্টফালেন এ। আর এই স্টেটেই আমার বাস। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় ঘরে বসে খবর পড়ায় করোনা নিয়ে আপনার মাথায় যেমন চিত্র হাজির হবে ঘরের বাইরের চিত্র সম্পূর্ণই ভিন্ন! শুধু প্যানিক বায়িং ছাড়া জার্মান রা আর কোনো সতকর্তামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে বলে আপাত দৃষ্টিতে মনে হয়নি আমার। পাব্লিক ট্রেনে বাসে ঠিক আগের মতোই ভিড়, পার্টি, ফুটবল, অনেক মানুষের জড়ো হউয়া কিছুই বন্ধ নেই। এই সেদিন ই তো পুরো জার্মানি জুড়ে কার্নিভাল চলছিল আর এই কার্নিভালেই এক আক্রান্ত দম্পতির উপস্থিতিতে NRW তে আজ আক্রান্তের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে। অবশ্য কেউ তাতে খুব একটা বিকারগ্রস্থ বলে মনে হচ্ছেনা উল্টো মাস্ক পরে ঘুরলেন তো আপনি মরলেন (যদিও আমি নিজেও মাস্ক পরিনা বা রিকমেন্ড করছিনা, কিন্তু কেউ যদি তা পড়ে ঘুরতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে/সেইফ ফিল করে তাতে কোনো সমস্যাও দেখছিনা)। বরঞ্চ আমি কাওকে হাঁচি, কাশি দেওয়ার সময় ও মুখ ঢাকতে দেখিনি! তাদের বিশ্বাস এই রোগ সর্দি কাশি থেকেও সাধারণ। সর্দি কাশিতেও এর থেকে বেশি মানুষ মারা যায়। ধরে নিলাম তাই, কিন্তু তাই বলে ইচ্ছা করে অন্য আরেকজনকে রোগ চাপিয়ে দেয়ার মাঝেও আমি কোনো বাহাদুরি দেখিনা। এখানকার প্রাদেশিক সরকার থেকেও রোগব্যাপ্তী রোধে কোনো ধরনের অর্থপূর্ণ কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি এখন পর্যন্ত । যদিও অন্যান্য স্টেট গুলো ইতিমধ্যেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই অঙ্গরাজ্যের উপর জার্মানির অর্থনৈতিক নির্ভরতাও হতে পারে এমন সিদ্ধান্ত না নেওয়ার পেছনের কারণ!
সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেলো, ৭৬ শতাংশ জার্মানরা মত দিয়েছেন তারা এই রোগ নিয়ে মোটেই ভাবছেন না, উল্টো গ্রীস সীমান্তের অভিবাসীদের নিয়ে তারা নিজেদের মাঝে দ্বিভক্ত! তারা বিশ্বাস করেন জার্মান স্বাস্থ্য ব্যাবস্থা অনেক ভালো, কিছুই করতে পারবেনা তাদের এই ভাইরাস, যেখানে সারা বিশ্ব এই সমস্যায় ভরাডুবিতে। উল্টো ট্রাম্প ইউরোপিয়ান দের জন্য বর্ডার ক্লোজ করে দেয়ায় তারা ভেকেশন নিয়ে দ্বিধায় পরে গিয়েছেন। কোথাও এক নিউজের কমেন্ট সেকশনে দেখলাম, ভেকেশন ছাড়া কিভাবে তাদের জীবন চলবে তারা বুঝে উঠতে পারছেন না। ঠিক এইটুকুই তারা এই ভাইরাস নিয়ে শংকিত!
সবশেষে এটাই বলতে চাই, জার্মানদের আত্মবিশ্বাস দেখে আমিও একটু সাহস নেয়ার চেষ্টা করছি ইদানীং কিন্তু অতিরিক্ত কোনোকিছুই হয়তো ভালো নয়। এখনো কিছু হয়নি কিছু হয়নি বলে, তারা যদি ইতালির মতো অবস্থায় যাওয়ার পর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে চায়, তখন হয়তো অনেক বেশিই দেরী হয়ে যাবে। আশা করি এর আগেই মানুষজন আরো সতর্ক হবে আর এই করোনার উপরে মানুষের সচেতনতা আর উন্নত স্বাস্থ্য ব্যাবস্থার জয় হবে।
ডুইসবুর্গ, জার্মানি থেকে