:: নাগরিক নিউজ ডেস্ক ::
অবশেষে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে গাজা উপত্যকায় জরুরিভিত্তিতে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাশ হলো। সোমবার পাশ হওয়া এ প্রস্তাবটিতে গাজায় যুদ্ধবিরতির পাশাপাশি উপত্যকার নিয়ন্ত্রণকারী গোষ্ঠী হামাসের কব্জায় থাকা জিম্মিদের দ্রুত ও নিঃশর্ত মুক্তির উল্লেখ রয়েছে।
সোমবার প্রস্তাবটি পরিষদের বৈঠকে ভোটের জন্য তোলার পর মোট ১৫ সদস্যের মধ্যে ১৪ দেশ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিলেও যুক্তরাষ্ট্র ভোটদানে বিরত ছিল। তবে প্রস্তাবটির বিপক্ষে কোনো যুক্তি উপস্থাপন করেনি দেশটি।
গাজায় যুদ্ধবিরতি সংক্রান্ত যত প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছে—প্রায় প্রত্যেকটিতেই ভেটো দিয়েছে ইসরাইলের সবচেয়ে পুরনো ও পরীক্ষিত মিত্র যুক্তরাষ্ট্র।
গত বছরের ৭ অক্টোবরের হামলার ৯ দিন পর, ১৬ অক্টোবর প্রথম নিরাপত্তা পরিষদে গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবটি তুলেছিল রাশিয়া, কিন্তু তাতে ভেটো দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। পরে চীন, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং অন্যান্য দেশের উদ্যোগে আরও বেশ কয়েকবার যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব তোলা হয় পরিষদের বৈঠকে কিন্তু প্রতিবারই ভেটো দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্রের আজকের অবস্থান গাজায় হামলা নিয়ে ইসরায়েলের অবস্থানের সঙ্গে ওয়াশিংটনের মতভিন্নতার বিষয়টি স্পষ্ট করেছে। গাজায় প্রাণহানি নিয়ে কিছুদিন ধরে ইসরায়েলের সমালোচনা করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনার জন্য সম্প্রতি ইসরায়েলসহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশ সফর করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন।
এ প্রস্তাব পাশের পর জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, দীর্ঘ অপেক্ষার পর অবশেষে গাজায় জরুরিভিত্তিতে যুদ্ধবিরতি এবং সব জিম্মির নিঃশর্ত মুক্তির প্রস্তাব পাস হলো। প্রস্তাবটি যত শিগগির সম্ভব বাস্তবায়ন করতে হবে। এক্ষেত্রে কোনো প্রকার ব্যত্যয় হলে তা হবে ক্ষমার অযোগ্য।
জাতিসংঘে নিযুক্ত ফরাসি রাষ্ট্রদূত নিকোলাস ডি রিভিয়ের বলেন, ‘গাজা নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের নীরবতা বধিরতার পর্যায়ে চলে গিয়েছে। শেষ পর্যন্ত একটি সমাধান বের করতে নিরাপত্তা পরিষদের জন্য এটাই উপযুক্ত সময়।’
তিনি আরও যোগ করেন, ‘এই সংকট এখনও শেষ হয়নি। এ বিষয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। রমজান শেষ হতে আর দুই সপ্তাহ বাকি, এর মধ্যেই আমাদের একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে।’
নিরাপত্তা পরিষদে ভোটাভুটির পর এক বিবৃতিতে হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, এই প্রস্তাব তাদের নীতিতে কোনো পরিবর্তন আনবে না।
তবে আলজাজিরার কূটনৈতিক সম্পাদক জেমস বেস বলেন, ‘নিরাপত্তা পরিষদে এটি প্রস্তাব উল্লেখযোগ্য অর্জন। প্রায় ছয় মাস পর ভোট…. যা প্রায় সর্বসম্মতভাবে হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র তিনবার তার ক্ষমতা (ভেটো) ব্যবহার করেছে। কিন্তু এবার আর ঠেকাতে পারেনি।’
যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাসের বিষয়ে জাতিসংঘের ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত বারবারা উডওয়ার্ড বলেছেন, তারা এই প্রস্তাবে ইসরায়েলে হামাসের ৭ অক্টোবরের হামলার কোনো প্রকার নিন্দা জানায়নি। যুক্তরাজ্য এই হামলার ‘দ্ব্যর্থহীনভাবে নিন্দা’ জানাচ্ছে।
যদিও তিনি বলেছেন, আমরা অবিলম্বে এই প্রস্তাবের বাস্তবায়ন চাই। কারণ গাজার নিরীহ বেসামরিক ফিলিস্তিনি নাগরিকদের দুর্ভোগ কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না এবং আমাদের সবার চোখের সামনেই একটি চরম মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ‘যুদ্ধ ছাড়া মানবিক বিরতি থেকে দীর্ঘস্থায়ী, টেকসই শান্তির দিকে কীভাবে এগোনো যায়, সেই পথ ও সমাধান আমাদের খুঁজতে হবে। এর জন্য একটি আন্তর্জাতিক সাহায্য প্যাকেজসহ পশ্চিম তীর ও গাজার জন্য একটি নতুন ফিলিস্তিন সরকার গঠন করাও প্রয়োজন।’
ভোটের ফলাফলকে স্বাগত জানিয়েছেন ফিলিস্তিনি নেতারা। তারা এটিকে সঠিক পথে ভালো পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন।
ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত নিরাপত্তা পরিষদে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে আবেগ তাড়িত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, গাজায় হামলা বন্ধ করার জন্য যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব একটি ‘টার্নিং পয়েন্ট’ হওয়া দরকার।
সৌদি আরবের মানসুর বলেন, ‘অবশ্যই এটি একটি টার্নিং পয়েন্ট। এটি যুদ্ধ এবং আমাদের লোকজনের ওপর নৃশসংতা শেষ হওয়ার ইঙ্গিত।’
গত নভেম্বরের শেষ দিকে অবশ্য তিন মধ্যস্থতাকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্র, কাতার ও মিসরের তৎপরতায় ৭ দিনের অস্থায়ী বিরতিতে সম্মত হয়েছিল হামাস এবং ইসরাইলের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভা। সেই বিরতির সময় মোট ১০৮ জন জিম্মিকে ছেড়ে দিয়েছিল হামাস, বিপরীতে দেশের বিভিন্ন কারাগারে বন্দি ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ১৫০ জনকে ছেড়ে দিয়েছিল ইসরাইলও।
হামাসের হাতে এখনও জিম্মি অবস্থায় রয়েছে ১৩২ জন। অন্যদিকে ত্রাণ ও খাদ্যের অভাবে মৃত্যুর মিছিল শুরু হয়েছে গাজায়। চলমান এই পরিস্থিতির মধ্যেই কিছুদিন আগে গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর রাফায় বড় আকারের অভিযান চালানোর ঘোষণা দেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। নেতানিয়াহু এ ঘোষণা দেওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই নিরাপত্তা পরিষদে পাস হলো গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় হামাস। এতে প্রায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত হয়। আহত হয় ৪ হাজারের মতো। হামাস জিম্মি করে ২৪০ থেকে ২৫৩ জনকে। ইসরায়েল ধারণা করছে, এখনও প্রায় ১৩০ জন হামাসের কাছে জিম্মি আছে।
হামাসের হামলার জবাবে ইসরায়েল গাজায় সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ইসরায়েলের হামলায় গাজায় এখন পর্যন্ত ৩২ হাজার ৭০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ১৩ হাজার শিশুও আছে। ৮ হাজার ৬৬৩টি শিশুসহ ৭৪ হাজার ২৯৮ জন আহত হয়েছে।
অন্যদিকে ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় ইসরায়েলে নিহত হয়েছিল ১ হাজার ২০০ জন মানুষ। হামলার সময় ২৪০ জনকে জিম্মি হিসেবে গাজায় ধরেও নিয়ে যায় তারা।
অক্টোবরে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে অচলাবস্থায় ছিল জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ। বারবার যুদ্ধবিরতির আহ্বানে সম্মত হতে ব্যর্থ হয় সংস্থাটি।