:: নাগরিক নিউজ ডেস্ক ::
বাসাবাড়িতে এলপিজি সিলিন্ডারের ব্যবহার বেড়েই চলছে। ব্যবহার বৃদ্ধির পাশাপাশি গ্যাস সিলিন্ডার থেকে দুর্ঘটনার পরিমাণও বাড়ছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতি বছর গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘণ্টায় প্রাণ হারাচ্ছে অসংখ্য মানুষ।
সম্ভাব্য বিপদ এড়াতে সাবধানতার সঙ্গে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারের বিকল্প নেই। তবে অধিকাংশ ব্যবহারকারীর এসব বিষয়ে পর্যাপ্ত ধারণা থাকে না। এ কারণে তারা গ্যাস সিলিন্ডারের সাধারণ ও ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়গুলো এড়িয়ে যান৷
গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে বাঁচতে কিছু বিষয় মেনে চলা অত্যন্ত জরুরি। আসুন জেনে নেই, কী কী কারণে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হতে পারে এবং তা থেকে রক্ষা পেতে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের কারণ
ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় সিলিন্ডার স্থাপন
একটি সাধারণ ভুল হলো গ্যাস সিলিন্ডার অনুপযুক্ত জায়গায় রাখা। গ্যাস সিলিন্ডার সূর্যের আলোতে, প্রচণ্ড তাপে বা দাহ্য পদার্থের কাছাকাছি স্থানে রাখলে সিলিন্ডারের ক্ষতি বা বিস্ফোরণের ঝুঁকি বাড়তে পারে।
গ্যাস সিলিন্ডার সবসময় দাহ্য পদার্থ থেকে নিরাপদ দূরত্বে এবং শিশুদের নাগালের বাইরে রাখতে হবে। এর পাশাপাশি খোলামেলা, শীতল এবং শুষ্ক জায়গায় গ্যাস সিলিন্ডার স্থাপন করতে হবে। এ ছাড়া সিলিন্ডারটিকে সবসময় সোজা রাখতে হবে।
সিলিন্ডারের অপর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণ
অনিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ গ্যাস সিলিন্ডারকে বিপজ্জনক পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। এজন্য নিয়মিত ভালভ ও সংযোগস্থলে সাবান পানির দ্রবণ প্রয়োগ করে গ্যাসের লিক পরীক্ষা করতে হবে। এ সময় বুদবুদের সন্ধান পাওয়া গেলে কিংবা লিকেজ সনাক্ত করা হলে অবিলম্বে সহায়তার জন্য কোনো অভিজ্ঞ কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।
এ ছাড়াও সিলিন্ডারটি নিয়মিত মুছে রাখতে হবে, যাতে কখনও মরিচা না ধরে।
ভুল সংযোগ
চুলা বা অন্যান্য যন্ত্রপাতির সঙ্গে গ্যাস সিলিন্ডারের সংযোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সংযোগে কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে যে কোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এজন্য সংযোগগুলো ঠিকভাবে হয়ে কি না এবং কোথাও লিকেজ আছে কি না নিশ্চিত করতে হবে।
অস্থায়ী সংযোগ বা সরঞ্জাম পরিবর্তন এড়িয়ে চলতে হবে। কেননা, এর ফলে গ্যাস লিকেজ বা বিস্ফোরণ হতে পারে। এ ছাড়া ব্যবহৃত চুলার কোথাও কোনো লিকেজ আছে কি না, তাও নিশ্চিত করতে হবে।
এ ছাড়া সিলিন্ডার পরিবহনের পর চুলার সঙ্গে সংযোগ দেওয়ার আগে প্রায় এক ঘণ্টা গ্যাসের বিশ্রাম নিশ্চিত করতে হবে।
বায়ুচলাচল উপেক্ষা করা
গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করার সময় অপর্যাপ্ত বায়ুচলাচল স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। গ্যাসের যন্ত্রগুলো অক্সিজেন গ্রহণ করে। একইসঙ্গে কার্বন মনোক্সাইড উৎপন্ন করে, যা আবদ্ধ স্থানের জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে।
এজন্য রান্নাঘরে, বিশেষ করে বাসাবাড়িতে কিংবা ছোট কক্ষে বাতাস চলাচল নিশ্চিত করার জন্য সব সময় জানালা খুলে বা এক্সজস্ট ফ্যান ব্যবহার করে সঠিকভাবে বায়ু চলাচল নিশ্চিত করতে হবে।
সচেতনতার অভাব
গ্যাস সিলিন্ডারের সুরক্ষা সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব একটি সাধারণ ভুল, যা অধিকাংশ পরিবার করে। এজন্য গ্যাস সিলিন্ডারের সঙ্গে সম্পর্কিত সম্ভাব্য ঝুঁকি এবং কীভাবে সেগুলো নিরাপদে পরিচালনা করা যায় সে সম্পর্কে শিশুসহ পরিবারের সকল সদস্যকে শিক্ষিত করা গুরুত্বপূর্ণ৷
পরিবারের সকল সদস্যকে শেখাতে হবে, কীভাবে গ্যাসের লিক সনাক্ত করতে হয় এবং জরুরি পরিস্থিতিতে গ্যাস সংযোগ বন্ধ করতে হয়। তা হলেই সম্ভব্য ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব।
গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে নিরাপদে থাকতে করণীয়
বাংলাদেশের এলপিজি বিধিমালা, সিলিন্ডার বিধিমালা এবং বিস্ফোরণ অধিদফতরের পক্ষ থেকে আরও কিছু সতর্কতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সেগুলো হল:
- এলপিজি সিলিন্ডার খাড়াভাবে দাঁড় করিয়ে রাখতে হবে। উপুড় বা কাত করে রাখা যাবে না। এমনভাবে রাখতে হবে যেন আশেপাশে কোন কিছুর সাথে ধাক্কা না লাগে।
- সিলিন্ডার কোন পাটাতনের ওপরে নয় বরং মাটিতে সমতল পৃষ্ঠে রাখতে হবে এবং চুলা, সিলিন্ডার থেকে কমপক্ষে ছয় ইঞ্চি উপরে রাখতে হবে।
- সিলিন্ডার কোনভাবেই চুলার/আগুনের খুব কাছাকাছি রাখা যাবে না। সিলিন্ডারটি লম্বা পাইপের সাহায্যে চুলা থেকে অন্তত তিন ফুট দূরে স্থাপন করতে হবে।
- সিলিন্ডার রান্নাঘরের চুলার নিচে, ক্যাবিনেটের ভেতরে কিংবা বদ্ধ অবস্থায় নয় বরং খোলামেলা জায়গায় এবং সমান ভূমিতে রাখতে হবে। যেখানে পর্যাপ্ত বাতাস চলাচল করে। তবে সরাসরি সূর্যের নিচে রাখা যাবে না। ছায়া যুক্ত শুষ্ক পরিচ্ছন্ন স্থানে রাখতে হবে।
- সিলিন্ডার যেখানে থাকবে সেখানকার একটি জানালা সব সময় খোলা রাখার চেষ্টা করতে হবে। না হলে ঘরের ওপরে ও নিচে পর্যাপ্ত ভেন্টিলেটরের ব্যবস্থা করতে হবে।
- গ্যাস সিলিন্ডার পরিবর্তনের সময় অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যেন চুলা চালু না থাকে।
- আগুন, বিদ্যুৎ এবং তাপের যেকোনো রকম উৎস সেইসঙ্গে দাহ্য, প্রজ্বলিত বা বিস্ফোরক পদার্থ এবং ভিন্ন কোন গ্যাসের সিলিন্ডার থেকে এই এলপিজি সিলিন্ডার দূরে রাখতে হবে।
- যেখানে সিলিন্ডার রাখা হচ্ছে তার আশেপাশে আগুন জ্বালানো, ধূমপান করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
- সিলিন্ডারের ওপরে ভারী বোঝা রাখা যাবে না।
- রান্না শুরু করার আধাঘণ্টা আগে রান্নাঘরের দরজা-জানালা খুলে দিন। রান্না শেষে চুলার নব ও এলপিজি সিলিন্ডারের রেগুলেটর সুইচ অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।
- অনেকদিনের বদ্ধ ঘরে প্রবেশের পর সবার আগে দরজা জানালা খুলে দিতে হবে। যদি ঘরের ভেতরে গ্যাসের গন্ধ পাওয়া যায় তাহলে জানালা দরজা খুলে দিয়ে সাথে সাথে ডিলারদের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। এই সময়ের মধ্যে ম্যাচের কাঠি জ্বালানো, ইলেকট্রিক সুইচ, সিলিন্ডারের রেগুলেটর কিংবা মোবাইল ফোন অন বা অফ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। অনেকে সিলিন্ডারে লিকেজ খোঁজার সময় মোমবাতি কিংবা ম্যাচের কাঠি ব্যবহার করেন। সেটা কোন অবস্থাতেই করা যাবে না।
- অতিরিক্ত গ্যাস বের করার জন্য এলপিজি সিলিন্ডারে চাপ দেয়া, ঝাঁকানো কিংবা সিলিন্ডার গরম করা থেকে বিরত থাকতে হবে। এতে তরল এলপিজি দ্রুত গ্যাসে রূপান্তরিত হয়ে অস্বাভাবিক চাপ বেড়ে বিস্ফোরিত হতে পারে।
- এলপিজি পূর্ণ সিলিন্ডার কোন দুই চাকার যান যেমন সাইকেল মোটর সাইকেলে কিংবা ভারসাম্য কম, এমন বাহনে পরিবহন করা যাবে না।
আরও যা করণীয়
- এছাড়া বছরে অন্তত একবার গ্যাস সিলিন্ডারটি এবং এর সাথে ব্যবহার হওয়া নানা রকম সামগ্রীর নিয়মিত ডিস্ট্রিবিউটর বা সরবরাহকারী দিয়ে সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা পরীক্ষা করিয়ে নিতে হবে।
- সিলিন্ডারের ভালভ, গ্যাসের পাইপ বা ফিটিংস দুর্বল হলে কিংবা সিলিন্ডারে ছিদ্র থাকলে সেটা সাথে সাথে বদলে ফেলতে হবে। একে মেরামত, ঝালাই করে ব্যবহার করা যাবে না। তেল বা পিচ্ছিল পদার্থ ব্যবহার করে নাড়াচাড়া করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
- এরপরও যেকোনো ধরণের জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাসা, বিশেষ করে রান্নাঘরের মধ্যে নিরাপত্তামূলক বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি, যেমন- গ্যাস ডিটেক্টর এবং ফায়ার এক্সটিঙ্গুইশার কিংবা হাতের কাছে কম্বলের মতো মোটা কাপড় রাখা যেতে পারে।