:: মিফতাউল জান্নাত ::
আমি ডাক্তার আহাদের স্ত্রী মিফতাউল জান্নাত বলছি। ডা: আহাদ আমার স্বামীর নাম। হ্যা, তিনি একজন ডাক্তার। সে কোন সরকারি ডাক্তার না; হয়নি এখনো। বেসরকারি হাসপাতালে মানুষকে চিকিৎসা দেয়। চাইলেই সে করোনার মত অবস্থায় মানবসেবা কার্যক্রম স্থগিত রাখতে পারতো। কিন্তু সে রাখনি। কারণ তার নিজের বিবেকের কাছে দায়বদ্ধতা। দেশের এই ভয়াবহ অবস্থার কথা ভেবে আরও অনেক আগেই আমি তাকে ডিউটি করতে বারণ করেছিলাম; বলেছিলাম লাগবেনা তোমার এখন হাসপাতাল যাওয়া, তোমার এইটা ফিক্সড জব না,চাইলেই পরে অন্য হাসপাতালে জয়েন করতে পারবে। আমি মানা করেছিলাম, করবোইতো! আমার স্বামী সবার জন্য ডাক্তার হলেও সে আমার দুই সন্তানের পিতা; আমার শ্বশুর শাশুড়ির একমাত্র ছেলে, দুইজন বোনের ভাই। সে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি; ওর কিছু হলে আমার কি হবে? আমার সন্তানদের কি হবে, বাবা-মা ওর বোনদের কি হবে? এদেশের মানুষ কি ডাক্তারদের মানুষ মনে করে? ওরা তো ডাক্তারকে কসাই বলে! ওর কিছু হলে ওরা তো বিন্দুমাত্র কষ্ট পাবেনা, উল্টো হাসি তামাশা করবে। তাদের জন্য ও কেন মরতে যাবে? না, আমার কথা শোনেনি সে।
জানতাম শুনবেনা। উল্টো আমাকে বিবেক সম্পর্কিত অনেকগুলো লেকচার দিয়ে সে ২ দিনের জন্য হাসপাতালে গেল। সেখানে গিয়েই সে সর্দি-কাশি-জ্বরের কবলে পড়লো এবং সেখান থেকেই বললো, সে বাসায় এসে কারো সাথে দেখা করবেনা, স্পৃহা- স্পন্দনকে (তাঁর দুই সন্তান) যেন ওর কাছে থেকে দূরে রাখা হয়। সে আলাদা রুমে থাকবে কিছুদিন। আমি চিন্তায় পরে গেলাম। মেয়েকে খুব বোঝালাম, বাবাই আসলে যেন বাবাই এর কাছে না যায়, মেয়ে বুঝতে চাইলোনা, অনেক বুঝিয়ে রাজি করালাম। ওর বাবাই বাসায় আসলো, আলাদাও থাকলো, আমাদের কারো আশেপাশে আসতোনা, মেয়েটা আমার দূর থেকে দরজা দিয়ে ওর বাবাইকে দেখতো, কাছে যাইতে চাইতো, বাবার সামনে হেসে এসে আমার কাছে এসে চোখ আড়াল করে কান্না করতো, আমি শুধু রুমে গিয়ে খাবার, পানি দিয়ে আসতাম, তাও ওর কাছে গিয়ে না। একটা ছোট টেবিল রাখা ছিল, সেখানে। অনেক কষ্ট হত। ছোট ছেলেতো কিছু বোঝেনা, কিন্তু মেয়ে আমার ভীষণ কষ্ট পেতো। বাবাই ওর সামনে আছে কিন্তু বাবাইর কাছে যাইতে পারছেনা, বাবাই ওরে আদর করতে পারছেনা, ওর ছোট্ট মনে কত কিছু চলত, আমাকে কত কত প্রশ্ন করতো,তখনি তো দোয়াটা শিখে নিয়েছিল। আর আমি? আমি আমার স্বামীকে কিছুক্ষণ পর পর লেবু মধু আর কালিজিরা দিয়ে গরম পানি দিতাম, নামাজে বসে অনেক কান্নাকাটি করতাম। এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর ও সিওর হলো ওর জ্বর সর্দি নরমাল ফ্লু ছিল। এরপর রুম শিফট করে আমাদের রুমে আসলো। তখন আমার মেয়ের খুশি দেখে কে! বাবাইকে পেয়ে যেন চাঁদ হাতে পেল সে। আমার স্বামী চাইলেই এরপরে ডিউটিতে যাওয়া বন্ধ করতে পারতো। কিন্তু নাহ! সে যাবেই। তাইতো সুস্থ হওয়ার ২-৩ দিন পর আবার চলে গেল হাসপাতালে।
আজ ১১ দিন হলো সে হাসপাতালে মানুষের চিকিৎসা দিচ্ছে। ১৬ তারিখে ওর বাসায় আসার কথা। এই ১১টা দিনের প্রতিদিন আমার মেয়েকে আমার উত্তর দিতে হয়েছে, তার বাবাই বাসায় আসছেনা কেন? কবে তার বাবাই বাসায় আসবে? অথচ আমার স্বামী আজকে আমাকে কল করে বলেছে বাসায় আসবেনা। আসলেও সেল্ফ কোয়ারেন্টাইনে থাকবে আগের মতো; আমার বাচ্চাকাচ্চাদের থেকে দূরে, বাবা-মার কাছে থেকে দূরে। কারণ, সে যেহেতু হাসপাতাল থেকে আসবে, তার ইনফেক্টেড হওয়ার চান্স বেশী এবং ওর থেকে আমাদের ইনফেক্টেড হওয়া এড়াতে সে বাসায় আসতে রাজী না। এই হচ্ছে ডাক্তারদের অবস্থা!
শুধু আমার স্বামী না, আমার স্বামীর মত আরো যারা ডাক্তার আছেন, সব ফ্যামিলিরই একই অবস্থা! এইসব ডাক্তারদের অনেকেরই বউ, বাচ্চা, বাবা, মা নিয়ে সুন্দর পরিবার। কিন্তু তারা এই সবকিছু ফেলেই মানুষের সেবা দিয়ে যাচ্ছে, প্রতিদিন প্রতিনিয়ত। হয়তো ২-১ জন সেবা দিতে পারছেনা, ব্যতিক্রম সব পেশাতেই থাকে। তাই বলে ঢালাও করে যখন বলা হয় ডাক্তার রা রোগী দেখছেন না, পালিয়ে যাচ্ছেন, ডাক্তারদের জন্য যখন মানুষ মৃত্যু কামনা করে,কসাই বলে, তখন আমার সত্যি খুব ঘেন্না হয় ঐ সব মানুষ নামের পশুদের প্রতি, মন থেকে না চাইতেও বদ দোয়া চলে আসে তাদের জন্য! আর আমার স্বামীকে খুব করে চিৎকার করে শোনাতে মন চায়, কাদের সেবা দিতে যাও তুমি? কাদের জন্য নিজের বিবেকের কাছে অপরাধী সাজতে বলো আমায়? এরা তো হাসপাতাল থেকে সেবা নিয়ে গিয়ে বলবে শালার ডাক্তার কসাই। দুরে থেকে দেখলো শুধু, কোলে নিয়ে দেখলোনা, এরা ডিউটি করছেনা ঠিকমত, সেবা দিচ্ছেনা ভালোভাবে! আমি যে আমার স্বামীকে মানা করি হাসপাতালে যেতে, এজন্য আমার সত্যি খারাপ লাগেনা, বিন্দুমাত্র বিবেকেও বাধেনা। কেন বাঁধেনা একটু পর বলছি।
আমার স্বামী বলে সে এখন একটা যুদ্ধে আছে, এগেইন্সট আননোন, আর সে নাকি এইটার ফ্রন্টলাইন যোদ্ধা! ফ্রন্টলাইন যোদ্ধা? মাই ফুট! কিসের যোদ্ধা মনে কর তুমি নিজেকে? ঢাল নাই তলোয়ার নাই, নিজেরে যোদ্ধা মনে করো? তোমার পারসোনাল প্রটেক্টিভ ইক্যুপমেন্ট (পিপিই) কোথায়? স্বাস্থ্যমন্ত্রী তো বলেই দিয়েছেন, সরকারি ডাক্তারদের ব্যবস্থা উনারা করবেন, বেসরকারি ডাক্তারদের দায়িত্ব সরকার নেবেন না। তো? তুমি জানোনা? এক সেট পিপিই একবারই পরা যায়? একসেট পিপিইর দাম প্রায় ২০০০ টাকা। তুমি প্রতিদিন নিজের টাকায় পিপিই কিনে পরা এফোর্ড করো? করো না? তাহলে কেন যাবে? কিসের মিশন? সুইসাইডাল মিশন না এটা? অথচ এদেশের বোকা পাবলিক বলবে পিপিই কিনতে কয় টাকা লাগে? ডাক্তাররা চেম্বার করে ভিসিট নেয় ৫০০/৭০০/১০০০/১২০০ টাকা! পিপিই নিজেরাই কিনে পরবে। আরে গাধা পাবলিক, নিজের সুরক্ষার জন্য তো বাজারের সব খালি করছো, নিজের সর্দি হলে দৌড় মারো প্রফেসরদের কাছে। তোমাদেরতো আবার সাধারণ এমবিবিএসে চিকিৎসা হয়না! উনারা জানে নাকি কিছু?
প্রফেসর তো তার লেভেল অনুযায়ী ফি নেবেনই, অথচ এই সো-কল্ড ফ্রন্টলাইন যোদ্ধা যারা, এদেরতো ম্যাক্সিমাম নরমাল এমবিবিএস ডাক্তার, এরাই তো রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে এবং এদের ম্যাক্সিমামের স্যালারি সর্বোচ্চ ৩০০০০-৩৫০০০ টাকা। এই টাকায় তারা তাদের সংসার চালাবে নাকি পিপিই কিনে পরে রোগীর সেবা দেবে? যেখানে উন্নত দেশগুলাতে হাই প্রোটেক্টিভ পিপিই পরে সেবা দেয়ার পরেও অনেকগুলা ডাক্তার ইনফেক্টেড হয়ে মারা গেসে, সেখানে আমার হাজবেন্ড নরমাল ওটি ড্রেস পরে রোগীর সেবা দিতে গেলে আমি একশোবার মানা করবো, আমার জন্য মানা করবো, আমার বাচ্চাদের জন্য মানা করবো, আমার স্বামীর যদি সুরক্ষা নিশ্চিত থাকতো আমি কখনোই মানা করতাম না! যেখানে এত অনিশ্চয়তা সেখানে আমি আমার স্বামীকে কিভাবে পাঠাবো? মরার জন্য? ঢাল তলোয়ার থাকলে না হয় মন কে সান্ত্বনা দিতে পারতাম, সব ঠিক থাকার পরেও সে চলে গেল, এইটা আল্লাহর ইচ্ছাই ছিল। কিন্তু জেনে বুঝে ঠান্ডা মাথায় তার সুরক্ষা ছাড়া আমি কেন তাকে মরতে পাঠাবো? আমি তো সবসময় না-ই করবো, যদিও সে আমার কথা শুনবেনা, আমি জানি। সে সেবা করতে যাবে ঐসব পশুদের যারা তাকে কসই বলবে, যারা দিনশেষে আর্গুমেন্টে লিপ্ত থাকবে এই বলে যে, ডাক্তারদের সংসার চলে ঔষধ কোম্পানির টাকায় অথবা ডাক্তারদের সন্তানরা বিদেশ পড়ালেখা করে কোম্পানির টাকায়। অথচ দিনশেষে এরাই পরিচিত ডাক্তারদের ইনবক্সে নক দেয় অথবা মোবাইলে কল দেয় নিজের থেকে শুরু করে আত্নীয় স্বজনসহ সবার অসুখের প্রেসক্রিপশন নেয়ার জন্য। মন থেকে সত্যি সত্যি ঘৃনা এইসব ডাবল স্ট্যান্ডার্ড মানুষদের জন্য।
লেখিকাঃ বেসরকারি একটি মেডিকেল কলেজের জরুরি মেডিকেল অফিসার মুহাম্মদ এ আহাদের স্ত্রী
দারুন লিখেছেন।