:: নাগরিক প্রতিবেদক ::
আন্তর্জাতিক শিশু পর্নোগ্রাফির হোতা টিআইএম ফখরুজ্জামান টিপু কিবরিয়া ও তার সহযোগী কামরুল ইসলাম সাগরকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তাদের কাছ থেকে এক ভুক্তভোগী শিশু ও পর্নোগ্রাফিক কনটেন্ট উদ্ধার করা হয়েছে।
পুলিশ সূত্র বলছে, টিপু কিবরিয়ার ব্যবহৃত ক্যামেরা, পিসি ও ক্লাউড স্টোরেজ থেকে প্রাথমিকভাবে প্রায় ২৫০০ শিশু পর্নোগ্রাফির উদ্দেশ্যে তোলা স্থির চিত্র ও প্রায় ১০০০ ভিডিও কনটেন্টের সন্ধান পাওয়া গেছে। তার ডেস্কটপে অসংখ্য ছিন্নমূল ছেলে পথশিশুদের প্রচুর অশ্লীল ছবি ও ভিডিও পাওয়া গিয়েছে।
অস্ট্রেলিয়া ফেডারেল পুলিশের নজরে থাকা টিপু কিবরিয়ার শিশু পর্নোগ্রাফি তৈরি ও পাচারের তথ্য জানিয়ে বাংলাদেশ পুলিশের কাছে চিঠি দেয়। সেই চিঠির সূত্র ধরে ঢাকা মহানগর পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) এই শিশুসাহিত্যিককে গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর খিলগাঁও এলাকা থেকে গ্রেফতার করে।
সিটিটিসির অতিরিক্ত উপকমিশনার (পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) আহমেদুল ইসলাম নাগরিক নিউজকে জানিয়েছেন, অস্ট্রেলিয়া পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে টিপু কিবরিয়াকে তারা গ্রেফতার করেছেন। তিনি শিশুসাহিত্যিক হয়ে শিশুদের ব্যবহার করে পর্নোগ্রাফি তৈরি ও পাচারের মতো ভয়ংকর কাজ করে আসছিলেন। মূলত টিপু শিশু পর্নোগ্রাফির আন্তর্জাতিক চক্রের একজন সদস্য।
এই কর্মকর্তা জানান, প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী গ্রেপ্তার টিপু কিবরিয়া ফের শিশুদের ব্যবহার করে পর্নোগ্রাফি তৈরি করছিলেন। এসব পর্নোগ্রাফি অস্ট্রেলিয়া, ইতালিসহ বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক পর্নোগ্রাফি চক্রের কাছে পাচার করা হচ্ছিল। এ বিষয়ে তাকে বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
বুধবার (২৪ এপ্রিল) দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ও সিটিটিসি প্রধান মো. আসাদুজ্জামান। বলেন, ঢাকা শহরের গুলিস্তান, রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানের ও দেশের বিভিন্ন স্থানের ছিন্নমূল পথশিশুদের পর্নোগ্রাফির কাজে অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে যুক্ত করতেন টিপু কিবরিয়া। সামান্য অর্থের প্রলোভনে বাসায় নিয়ে গিয়ে অশ্লীল ও গোপনাঙ্গের ছবি ও ভিডিও সংগ্রহ করে আন্তর্জাতিক যে ক্লায়েন্ট আছে, তাদের কাছে পাঠিয়ে দিতেন। বিদেশি ক্লায়েন্টদের চাহিদা মাফিক বন-জঙ্গলে ছিন্নমূল পথশিশুদের নিয়ে গিয়ে পর্নোগ্রাফির জন্য ভিডিও করতেন। তার বাসায় পর্নোগ্রাফির জন্য ভিডিও এডিটিং প্যানেল আছে। সেখানে তিনি এডিটিং করে বিদেশি ক্লায়েন্টদের মেইলে পাঠাতেন। যা পরে বিভিন্ন পর্নোগ্রাফি ওয়েবসাইটে আপলোড করা হতো।
আগে তিনি ইমেইলের মাধ্যমে পাঠাতেন। পরবর্তী সময়ে তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে নতুন মেগা ও টোটেনা নামক দুটি এনক্রিপটেট অ্যাপসের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক গ্রাহকদের কাছে পর্নোগ্রাফির কনটেন্টগুলো পাঠাতে শুরু করেন। আমরা তার কাছ থেকে যে ডিভাইস উদ্ধার করেছি, তাতে দেখা গেছে, ইতালি, অস্ট্রেলিয়া ও জার্মানিসহ আরও অনেক দেশের গ্রাহকদের তালিকা পাওয়া গেছে। যাদের কাছে তিনি বিকৃত ও অশ্লীল পর্নোগ্রাফির ভিডিও ছবি পাঠিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা পেতেন।
সিটিটিসির তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, টিপু কিবরিয়ার টার্গেট ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী ছেলে শিশু। এই ছেলে শিশুদের নিজের হেফাজতে নিতে রাজধানীজুড়ে তার একটা চক্র রয়েছে। চক্রের সদস্যরা ভাসমান মাদকাসক্ত টোকাই শ্রেণির। তাদের প্রথমে ২০০ থেকে ৫০০ টাকা ও কমদামি মোবাইল ফোন, সিম দিতেন তিনি। এই চক্রে রয়েছে কামরুল ও দেলোয়ার নামে দুজন। তাদের মধ্যে দেলোয়ার হকার। এরা পথশিশুদের লোভ দেখিয়ে নিয়ে আসে টিপুর কাছে। শিশু সংগ্রহ করতে পারলে তারা ১ থেকে ২ হাজার করে টাকা পায়। ছিন্নমূলের এসব শিশুদের ভালো খাবার ও টাকা দেওয়ার কথা বলে তার কাছে রাখা হয়। পরে তাদের দিয়ে পর্নোগ্রাফি তৈরি করেন টিপু কিবরিয়া।
গ্রেফতার অভিযানে থাকা সিটিটিসি সূত্র জানায়, টিপু খিলগাঁও এলাকার একটি বাসায় স্টুডিও তৈরি করেছেন। এখানেও শিশুদের ব্যবহার করে পর্নোগ্রাফির শুটিং করতেন তিনি। সেখানে ঢুকলে বোঝা যাবে না যে, ভয়ংকর অপরাধ হচ্ছে। অভিযানের সময়েও তিনি পর্নোগ্রাফি তৈরিতে ব্যস্ত ছিলেন।
এক কর্মকর্তা জানান, টিপুর কাছ থেকে বেশকিছু ডিভাইস জব্দ করা হয়েছে। এসব ডিভাইসে শিশুদের আপত্তিকর হাজার হাজার স্থিরচিত্র ও ভিডিও রয়েছে। এখন পর্যন্ত তা যাচাই করা হয়েছে, এর সবই অতিবিকৃত।
শিশুদের পর্ণ ভিডিও বিদেশিদের কাছে পাঠিয়ে কী পরিমাণ টাকা তিনি পেতেন এবং কীভাবে পেতেন? জানতে চাইলে ডিএমপির এ অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, অর্থের লেনদেন হতো ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন ও কিছু এমএফএসের মাধ্যমে। ৩/৪টি ছোট ছোট ভিডিও পাঠালেই তিনি পেতেন হাজার ডলার। সর্বশেষ এক বিদেশি গ্রাহককে তিনি তিনটি পর্নোগ্রাফির ভিডিও পাঠিয়ে এক হাজার ডলার পেয়েছেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে তার এজেন্ট। এ রকম আমরা বেশ কয়েকজন এজেন্টকে শনাক্ত করেছি। পাশাপাশি ২৫/৩০ জনের মতো ভুক্তভোগী শিশুকে শনাক্ত করা হয়েছে। ভুক্তভোগীরা সবাই ছেলে। তাদের সংখ্যা অনেক।
সিটিটিসি কর্মকর্তাদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ৫৮ বছর বয়সী টিপু কিবরিয়া জানিয়েছেন, তিনি পর্নোগ্রাফি তৈরি করে ‘মেগা’ নামের বিশেষ অ্যাপে সেই ভিডিও আন্তর্জাতিক চক্রের কাছে পাঠাতেন। তারাই তাকে এসব ভিডিও তৈরি করতে নানা ধরনের নির্দেশনা দিতেন। সেই নির্দেশনা মেনে তিনি মেঘা ছাড়াও ‘টোটা নোটা’ অ্যাপসে তা পাঠাতেন এবং যোগাযোগ করতেন।
তিনি পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে দাবি করেছেন, এবার নতুন করে এই অপকর্ম শুরু করে ইতালির এক ব্যক্তি ও অস্ট্রেলিয়ায় এক ব্যক্তির কাছে পর্নোগ্রাফি পাঠিয়েছেন। ১০ থেকে ১২টি পর্নোগ্রাফি পাঠালে তিনি এক হাজার ডলার পেতেন। ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের মাধ্যমে তিনি টাকা সংগ্রহ করেন।
দায়িত্বশীল এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, টিপু তাদের জানিয়েছেন, শিশুসাহিত্য লেখার সময় তিনি অনেক শিশুর সঙ্গে মিশেছেন। ২০০৫ সালের দিকে তিনি শিশু পর্নোগ্রাফি তৈরির মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। ২০১৪ সালে গ্রেফতার হয়ে ২০২০ সালে কারাগার থেকে বের হন। এরপর অসুস্থ হয়ে পড়েন। সুস্থ হওয়ার পর তার আর লেখালেখি আসছিল না। এরপর ফের টাকার লোভে আগের অপকর্ম শুরু করেন।
অবশ্য ওই কর্মকর্তা বলেন, টিপু সামর্থ্যবান পরিবারের সন্তান। তার সন্তানদের একজন চিকিৎসাবিদ্যায় অধ্যয়নরত। নিজেদের বাড়ি রয়েছে রাজধানীতে। কিন্তু বিকৃত মানসিকতা ও ডলারের লোভে এই অপকর্ম করে আসছিলেন। মূলত এ ধরনের ভয়ংকর অপরাধ করা তার মগজে ঢুকে গেছে।
এর আগে ২০১৪ সালে গ্রেফতার হওয়ার পর সিআইডি কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন যে, টিপু টাকার বিনিময়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের কয়েকটি দেশের অন্তত আট আন্তর্জাতিক পর্নো কারবারির কাছে বাংলাদেশি শিশুদের ব্যবহার করে পর্নো ভিডিও ও স্থিরচিত্র পাচার করে আসছিলেন।
ওই সময় ইন্টারপোলের বরাত দিয়ে সিআইডি জানিয়েছিল, আন্তর্জাতিক পর্যায়ের পর্নো ব্যবসায়ী চক্রের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরেই জড়িত টিপু কিবরিয়া। ২০০৫ সাল থেকে বাংলাদেশের শিশু পর্নোগ্রাফি বিদেশে পাচার হচ্ছিল। দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগটির বিষয়ে নজরদারি করে টিপুর চেহারা শনাক্ত করে ইন্টারপোল। ওই সময় টিপুর বাসায় অভিযান চালিয়ে শতাধিক পর্নো সিডি, লুব্রিকেটিং জেল, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, স্টিল ও ভিডিও ক্যামেরা উদ্ধার করা হয়।
২০১৪ সালের ৯ জুন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) হাতে গ্রেফতারের আগপর্যন্ত টিপু কিবরিয়া একজন জনপ্রিয় শিশু সাহিত্যিক ও আলোকচিত্রী হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
টিপু কিবরিয়ার লেখা কিশোর হরর সিরিজের বইগুলোর পেছনে দুটি লাইন লেখা থাকত, ‘পাঠক, সাবধান! ভয়ের জগতে প্রবেশ করছ তুমি!!’ ফেসবুকে নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি একজন সাদাসিধা মানুষ। সদা সত্য কথা বলার চেষ্টা করি। লেখালেখি করি, ছবি তুলি। ৫০টার মতো বই লিখেছি, যার অধিকাংশ ছোটদের জন্য। ধরণীর আলো দেখেছিলাম সেই ১৯৬৬ সালের ১১ নভেম্বর।’
সেই সময় আদালতে সাত পুলিশ সদস্য ও তিনজন ম্যাজিস্ট্রেট ছাড়া নিরপেক্ষ আরও চার সাক্ষীকে হাজির করেছিল রাষ্ট্রপক্ষ। টিপু কিবরিয়া ও একই দিনে গ্রেফতার মো. নুরুল আমিন ওরফে নুরু মিয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এ মামলায় পুলিশ এক পথশিশুকেও ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হাজির করে। কী করে এ চক্রের খপ্পরে পড়েছিল, সে সম্পর্কে শিশুটি বিবরণ দেয়।
ছয় বছর পর গত বছরের নভেম্বরে মহানগর দায়রা জজ কে এম ইমরুল কায়েশ এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। তিনি আসামি টি আই এম ফকরুজ্জামান টিপু কিবরিয়া, মো নুরুল আমিন নুরু মিয়া, মো নুরুল ইসলাম ও মো. শাহারুল ইসলামকে খালাস দেন। কেন আসামিদের খালাস দিয়েছেন, সে সম্পর্কেও তিনি রায়ে উল্লেখ করেছেন।
আদালত তিনটি বিষয় বিবেচনা করেছেন। এগুলো হলো আসামিরা অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুদের পর্নোগ্রাফি ইন্টারনেটে আপলোড করেন এবং হার্ড ডিস্কে সংরক্ষণ করেন বলে পুলিশ উল্লেখ করেছে। এই হার্ডডিস্কগুলো সাক্ষীদের উপস্থিতিতে জব্দ করা হয়েছিল কি না, পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন ৮–এর ৩,৬ ও ৭ নম্বর ধারার অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে কি না এবং আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে আসামিরা আর কী সাজা পেতে পারে।
পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনের ৩ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ইন্টারনেট, ওয়েবসাইট, মুঠোফোন বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইসের মাধ্যমে পর্নোগ্রাফি সরবরাহ করলে তিনি অপরাধ করেছেন বলে গণ্য করা হবে। এ অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ পাঁচ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড এবং দুই লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডের বিধান আছে। এ আইনের ৪ ধারায় শিশু পর্নোগ্রাফি উৎপাদন, বিক্রি বা প্রচারের জন্য সর্বোচ্চ ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার কথা বলা আছে। আর ৭ ধারায় বলা হয়েছে, এ অপরাধের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত বা সহায়তাকারী ব্যক্তি প্রত্যেকেই একই দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
মামলার নথিপত্র অনুযায়ী, সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আফতাব উদ্দীন গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালান। ওই দিন বিকেল পাঁচটার দিকে গোড়ান রেলগেট এলাকায় তিনি টিপু কিবরিয়াকে গ্রেফতার করেন। তিনি পর্নোগ্রাফি তৈরি করার কথা স্বীকার করেন এবং জানান, তাঁর বাসায় পর্নোগ্রাফি তৈরির সরঞ্জাম আছে।
২০১৪ সালে ওই তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ টিপু কিবরিয়ার খিলগাঁওয়ের বাসা থেকে হার্ড ডিস্ক ও কিছু যন্ত্রাংশ উদ্ধার করে। এই যন্ত্রাংশগুলো সাক্ষীদের উপস্থিতিতে জব্দ করা হয়। পুলিশ সাক্ষীদের স্বাক্ষর নেন। পরে টিপু কিবরিয়া বলেন, মুগদার মানিকনগরের একটি ভাড়া বাসায় পর্নোগ্রাফি তৈরি করেন। সেখানে গিয়ে পুলিশ আসামি নুরুকে একজন ভুক্তভোগীর সঙ্গে আপত্তিকর অবস্থায় পায়। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হওয়া আলামত সাক্ষীদের উপস্থিতিতে জব্দ করা হয়।
রাষ্ট্রপক্ষ আদালতে চারজন নিরপেক্ষ সাক্ষী হাজির করেন। আদালত তাঁর রায়ে বলেছেন, এই সাক্ষীদের সবাই বলেছেন, তাঁদের কাছ থেকে পুলিশ সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেন। তাঁরা কোনো জবানবন্দি দেননি। আসামিদের কাছ থেকে কী কী জিনিস উদ্ধার হয়েছে, সে ব্যাপারে তাঁরা সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলতে পারেননি।
আদালত রায়ে আরও বলেছেন, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছেন, তিনি মামলাটি তদন্ত করে অভিযোগপত্র দিয়েছেন। কিন্তু আসামিপক্ষের জেরায় তিনি বলেছেন, কোনো শিশু বা ভুক্তভোগী কারও তথ্য সংগ্রহ করতে পারেননি। আসামিরা ইন্টারনেটে ছবি আপলোড করে বিদেশি ডলার আয় করতেন বলে তথ্য আছে অভিযোগপত্রে। কিন্তু কোনো ব্যাংক হিসাব পাননি। এমনকি তদন্তের সময় এ মামলায় ভুক্তভোগী হিসেবে যে কিশোর ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বক্তব্য দিয়েছে, তাকেও আদালতে হাজির করা হয়নি।
আদালত আরও বলেছেন, কোন কোন দেশে পাচার করা হয়েছিল, তা পুলিশ নিশ্চিত করতে পারেনি। তা ছাড়া পুলিশ বলেছে, তারা আসামি ও ভুক্তভোগী শিশুকে আপত্তিকর অবস্থায় দেখতে পায়। জেরায় দাবি করেছে, ওই সময় মানিকনগরের বাসার দরজাও খোলা ছিল। আদালত মনে করে, পর্নোগ্রাফি উৎপাদনের সময় ঘরের দরজা খোলা রাখার যে কথা পুলিশ বলেছে, তা সত্য নয়।
আদালত তিনজন ম্যাজিস্ট্রেটের উদ্দেশে বলেছেন, জবানবন্দিতে আসামিরা কখন, কোথায়, কয়টায় পর্নোগ্রাফি উৎপাদন ও তা পাঠানোর কাজ করেছেন, তা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির কোথাও স্পষ্টভাবে উল্লেখ নেই। আসামিরা যে জবানবন্দি দিয়েছেন, সেই জবানবন্দির পক্ষে নিরপেক্ষ সাক্ষীরা সাক্ষ্য দেননি।
২০১৪ সালে আটকের পর টিপু কিবরিয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেন, তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করে সেবা প্রকাশনীর কিশোর পত্রিকার সহকারী সম্পাদক হিসেবে ১০ বছর চাকরি করেছেন। তাঁর একটি ফটোগ্রাফিক সোসাইটি ছিল। সেবা প্রকাশনীতে চাকরির সময় তাঁর ৫০টি কিশোর উপন্যাস বের হয়। ২০০৩ সাল থেকে তিনি ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকতা শুরু করেন। নুরুলের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ২০০০ সালে মুগদা স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে গিয়ে। আলাপ-আলোচনায় তিনি বুঝতে পারেন, নুরুল ইসলাম অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেদের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করে থাকেন।
পরে এই নুরুলের সঙ্গে তিনি জোট বাঁধেন। ঢাকা শহরের কল্যাণপুর রেলস্টেশন, সদরঘাট, সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালসহ নানা জায়গা থেকে বাচ্চাদের ছবি তোলার কাজের কথা বলে নিয়ে আসতেন নুরুল। নুরুলকে নিয়ে টিপু কিবরিয়া শিশুদের ছবি তুলতেন এবং ভিডিও ফুটেজ তৈরি করতেন। তিনি নিয়মিত ইন্টারনেটে ওই সব ছবি ও ভিডিও আপলোডও করতেন। একটা সময় কয়েকজন বিদেশি তাঁকে শিশুদের নগ্ন ছবি পাঠাতে বলেন। বিনিময়ে তাঁরা ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ থেকে টাকা পাঠাতেন। ওই সব টাকা/কারেন্সি তিনি মৌচাক, উত্তরা, মতিঝিলের ব্র্যাক ব্যাংকের মাধ্যমে তুলেছেন।
২০১৪ সালে টিপু কিবরিয়া জবানবন্দিতে এ–ও বলেছিলেন, তাঁর মক্কেলরা জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডের নাগরিক। যাঁদের কাছে তিনি এসব ছবি ও ভিডিও পাঠাতেন, তাঁদের ই–মেইল ঠিকানাও তাঁর কম্পিউটারে আছে। প্রতি মাসে এ কাজ করে টিপু কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা পেতেন টিপু। ওই টাকা দিয়ে তিনি নিজে চলতেন, আর প্রতি সপ্তাহে নুরুল ইসলাম ও নুরুল আমিনদের দুই হাজার টাকা করে দিতেন। যে ছেলেদের যৌন নির্যাতন করা হতো, তাদের দিতেন ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা।
মামলার তদন্তকালীন সিআইডির তৎকালীন অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক শাহ আলম বলেন, তদন্তে জানা গেছে, টিপু কিবরিয়া তাঁর তৈরি পর্নোগ্রাফি ১৩টি দেশের ১৩ নাগরিকের কাছে পাঠাতেন। এসব বিদেশি নাগরিককে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব দেশের মধ্যে আছে কানাডা, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকা, মধ্য ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ।