:: নাগরিক প্রতিবেদন ::
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের (ডিএসএ) মামলায় পাঁচ বছরে সবচেয়ে বেশি অভিযুক্ত হয়েছেন বিরোধী রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিক। অভিযুক্ত ব্যক্তির মধ্যে ৩২ শতাংশের বেশি বিরোধী দলের রাজনীতিবিদ এবং ২৯ দশমিক ৪০ শতাংশ সাংবাদিক।
অভিযোগকারীর ৭৮ শতাংশই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। প্রতি সপ্তাহে আওয়ামী লীগের করা একটি মামলার বিপরীতে আসামি রয়েছে তিনজনের বেশি।
মঙ্গলবার বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) একটি ওয়েবিনারে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পাঁচ বছরের চিত্র নিয়ে কঠিন পরীক্ষা’ নামে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা ১ হাজার ৪৩৬ মামলার তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সংবাদপত্র, আদালতের নথি, আইনজীবী, ভুক্তভোগী ও স্বজনের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এ গবেষণা হয়েছে। সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার গত সেপ্টেম্বরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত করে সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক আলী রীয়াজ এটির প্রধান গবেষক ছিলেন। ওয়েবিনারে গবেষণার তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেন তিনি। তাতে দেখা যায়, পাঁচ বছরে ডিজিটাল আইনে করা মামলায় ৪ হাজার ৫২০ জন অভিযুক্ত এবং ১ হাজার ৫৪৯ জন গ্রেফতার হয়েছেন। এ সময় মাসে গড়ে মামলা হয়েছে ২৪টি এবং গ্রেফতার হয়েছেন ২৬ জন।
প্রতিবেদন বলছে, অভিযুক্তের মধ্যে শীর্ষে রয়েছেন রাজনীতিবিদ ৪৯৫, সাংবাদিক ৪৫১, শিক্ষার্থী ১৩৮, ব্যবসায়ী ১০৮ ও শিক্ষক ৫৯ জন। এই পাঁচ বছরে গ্রেফতার হন ৫৭২ জন। এর মধ্যে রাজনীতিবিদ ১৪৩, সাংবাদিক ৯৭, শিক্ষার্থী ১০৪, বেসরকারি চাকরিজীবী ৫২ ও শিক্ষক ৪২ জন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত পাঁচ বছরে অভিযোগকারী ৮৫৯ জনের পেশা শনাক্ত করা গেছে। এর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সদস্য ১৮৯ ও রাজনীতিবিদ ৩৩৮ জন (আওয়ামী লীগের ২৬৩ জন, যা মোট অভিযোগকারীর ৭৭ দশমিক ৮১ শতাংশ)।
এ সময় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে প্রধানমন্ত্রীর মানহানির অভিযোগে মামলা হয়েছে ১৯০টি। বেশির ভাগ, অর্থাৎ ১৫৯ মামলা করেছেন তাঁর সমর্থকরা। বাকি ৩১টি করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এসব মামলায় অভিযুক্তের সংখ্যা ৪৬৪ জন। গ্রেফতার করা হয় ১৬১ জনকে।
মন্ত্রীর মানহানির মামলার সংখ্যা ৮০টি। এর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী করেছে আট মামলা। মন্ত্রীরা করেছেন মাত্র ছয়টি। আর মন্ত্রীর সমর্থকরা করেছেন ৬৬টি মামলা। এসব মামলায় মোট অভিযুক্তের সংখ্যা ৩৩৭ জন; গ্রেফতার হয়েছেন ৬৮ জন। রাজনীতিবিদদের মানহানির দায়ে করা মামলার সংখ্যা ২১২টি। এর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী করেছে সাতটি, রাজনীতিবিদ নিজে করেছেন ৯৩টি, রাজনীতিবিদের সমর্থনকারীরা করেছেন বাকি ১১২টি মামলা। এসব মামলায় মোট অভিযুক্তের সংখ্যা ৭৩৯ জন। এর মধ্যে গ্রেফতার হয়েছেন ১৩৬ জন।
ফেসবুকে মন্তব্য করার দায়ে এ আইনে মামলা হয়েছে ৯০৮টি। বাকি ৫২৮টি মামলা হয়েছে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে।
এতে বলা হয়, ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ১৪৩৬টি মামলা হয়েছে এবং কমপক্ষে ৪৫২০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এসব মামলায় সবচেয়ে বেশি অভিযুক্ত হয়েছেন রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিক। আর অভিযোগকারীদের মধ্যে ক্ষমতাসীন রাজনীতির সঙ্গে যুক্তরা শীর্ষে আছেন। সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে ২০২১ সালে।
মামলার শিকার ৪৫১ জনের মধ্যে ২০৯ জন সাংবাদিক জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন গণমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত এবং ১৯৭ জন স্থানীয় সাংবাদিক। এরমধ্যে সংবাদ লেখার কারণে ২৫৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে জানানো হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ২০২০ সাল থেকে ৪৯৫ জন রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এছাড়া অন্তত ২৮ জন অপ্রাপ্তবয়স্কের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে। তাদের মধ্যে ২২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
এতে বলা হয়, ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত ২১.৭৫% রাজনীতিবিদকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এর অর্থ হলো নির্বাচনের আগে অনেক রাজনীতিবিদকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।
ফেসবুক পোস্টের কারণে মোট ৯০৮টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় মোট ২৩২৮ জনকে আসামি করা হয়েছে।
আলোচিত “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮” পরিবর্তন করে “সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩” নামে প্রতিস্থাপিত হলেও ডিজিটাল মামলায় গ্রেফতার অনেকেই এখনো কারাগারে আছেন।
আলী রীয়াজ বলেন, মামলায় দেশের কোনো জেলা বাদ যায়নি। সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে ঢাকায়। এ ছাড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলায় ২৮ শিশুকে অভিযুক্ত করার পাশাপাশি ২২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
মামলার চিত্র বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ডিজিটাল আইনের অপরাধ ও শাস্তিযোগ্য ২২টি ধারার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে ২৫, ২৯, ৩১ ও ৩৫ ধারা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে ২৫ ধারায়। এসব মামলার সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো– স্বচ্ছতার অভাব, বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা, বিচারপূর্ব বন্দি বা আটক, শিশু-কিশোরদের আইনের আওতায় আনা এবং আইনের স্বেচ্ছাচারী ব্যবহার।
গবেষণায় সুপারিশের মধ্যে রয়েছে, ডিজিটাল আইনের অধীনে আটক ব্যক্তির জামিন এবং গত পাঁচ বছরে এ আইনের অধীনে করা মামলাগুলো পর্যালোচনার জন্য নাগরিক সমাজ ও বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করা।
প্রতিবেদন প্রকাশের সময় আলী রীয়াজ বলেন, ‘এখন সাংবাদিকতার অনেক চ্যালেঞ্জ। মালিকানা, নিজেদের দলীয়করণ এবং ডিএসএর মতো আইন। ডিএসএ শুধু সাংবাদিকতার ওপরই প্রভাব ফেলছে না। এটা একাডেমিক গবেষণার ওপরও প্রভাব ফেলছে।’ তিনি বলেন, ‘স্বাধীন সাংবাদিকতা, কোয়ালিশন (জোট) করতে হবে। সেটা না হলে প্রতিকূল পরিস্থিতি দীর্ঘমেয়াদি হবে।’
আলোচনায় অংশ নিয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘নির্বাচনের পর যে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করছে, তা কবরস্থানের মতো; যেখানে পাখির কিচিরমিচিরসহ শান্তিময় পরিস্থিতি বিরাজ করে। এটা কাম্য নয়। এর কারণ হচ্ছে ডিএসএর মতো আইন।’ ডিজিটাল আইনে নাগরিক সমাজকে অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে ঠেলে দেওয়া হয়েছে বলে মন্তব্য করেন সুজন সম্পাদক। তিনি বলেন, ‘এ আইনগুলো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে; যেখানে প্রতিপক্ষ মাঠছাড়া। তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারছে না।’
সরকার, রাজনৈতিক দল ও অঙ্গসংগঠনকে এবং এক-দুটি পরিবারকে সুরক্ষা দিতে যদি কোনো আইন হয়, তবে সে আইনের অপব্যবহারের সুযোগ থাকে বলে মন্তব্য করেছেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সল। তিনি বলেন, ‘সরকার ১৫ বছর ক্ষমতায় আছে কিন্তু ডিজিটাল আইনের এই পাঁচ বছরই তাদের কলঙ্কময় করতে যথেষ্ট।’
এএফপির ব্যুরোপ্রধান শফিকুল আলম বলেন, ‘ডিএসএর উদ্দেশ্য ছিল মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে অপরাধ বানানো। ডিএসএ পুরোপুরি বাতিল করারই আন্দোলন করা উচিত ছিল। কারণ, এটা ডিএসএ বা সিএসএ যে ফর্মেই থাককু না কেন, এটার অপপ্রয়োগ হবেই।’
সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান এই ওয়েবিনারে সঞ্চালনা করেন। আরও বক্তব্য দেন সংস্থার চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী এবং সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শিহাব উদ্দিন খান।