জীবনের সীমানা পেরিয়ে গেলেন অভিনেত্রী সীমানা

:: বিনোদন প্রতিবেদন ::

অভিনেত্রী ও মডেল রিশতা লাবনী সীমানা জীবনের সীমানা পেরিয়ে গেলেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৩৯ বছর।

হাসপাতালে ১৪ দিনের লড়াইয়ের পর মঙ্গলবার (৪ জুন) সকাল ৬টার দিকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। সীমানার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন তার ছোট ভাই এজাজ বিন আলী। সীমানা স্বামী সংগীতশিল্পী পারভেজ সাজ্জাদ ও দুই ছেলে রেখে গেছেন। বড় সন্তান শ্রেষ্ঠর বয়স আট, আর ছোট সন্তান স্বর্গ তিন বছর বয়সী।

সীমানার পরিবার গণমাধ্যমকে জানিয়েছে, গত সপ্তাহে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে সীমানাকে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকরা জানান, তার মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়েছে। শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ধানমন্ডির আরেকটি হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। সেখান থেকে তাকে নেওয়া হয় আগারগাঁওয়ের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালে। গত শনিবার ওই হাসপাতালেই তার মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার হয়। তারপর সেখান থেকে গত বুধবার বিকেলে তাকে নেওয়া হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমইউ)।

সীমানার ভাই এজাজ বিন আলী গণমাধ্যমকে জানান, শুরুর দিকে তাকে আইসিইউতে রাখা হলেও বুধবার থেকে তাকে লাইফ সাপোর্ট দেওয়া হয়। কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেছে। 

সীমানার পিতা সেকান্দার আলী অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা। দুই বোন এক ভাইয়ের মধ্যে সীমানা সবার বড় ছিলেন। ঢাকায় জানাজা শেষে এই অভিনেত্রীর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় তার গ্রামের বাড়ি নকলা পৌরসভাধীন কায়দা বাজারদী এলাকায়। মঙ্গলবার (৪ জুন) সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে নকলার কায়দা বাজারদী গোরস্থান মাঠে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর জারদী গোরস্থানে দাফন করা হয়।

২০০৬ সালে লাক্স-চ্যানেল আই সুপারস্টার প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বিনোদন অঙ্গনে অভিষেক হয় রিশতা লাবনী সীমানার। মডেল হিসেবে কাজ করতে করতে একপর্যায়ে শুরু করেন অভিনয়। ‘দারুচিনি দ্বীপ’ ছবিতে অভিনয় করে প্রশংসিত হয়েছিলেন তিনি। পরে তিনি বেশ কিছু নাটকেও অভিনয় করেন। সাকিন সারিসুরি ও কলেজ টুডেন নাটকে সীমানার অভিনয় দর্শকের কাছে প্রশংসিত হয়।

মাতৃত্বকালীন বিরতি এবং দুই সন্তানকে দেখাশোনায় কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন অভিনেত্রী। শোবিজ অঙ্গন থেকে নেওয়া টানা পাঁচ–ছয় বছরের বিরতি ভেঙে সম্প্রতি আবার কাজে ফেরেন অভিনেত্রী। ফেরার পর সংবাদমাধ্যমে সাক্ষাৎকারও দেন তিনি। বেসরকারি চ্যানেল দেশ টিভিকে দেওয়া সেই সাক্ষাৎকারে সীমানা তুলে ধরেন ক্যারিয়ারের নানা গল্প। সেই পুরোনো সাক্ষাৎকারে সীমানার কথাগুলো তুলে ধরা হলো।

অভিনয়ে দীর্ঘ বিরতি নিয়ে সীমানা বলেন, ‘২০১৬ পর্যন্ত আমি কাজে নিয়মিত ছিলাম। তবে সেই বছরই আমি বিরতি নিই। পরপর দুটি সন্তান হওয়ায় একটা লম্বা সময় বিরতি হয়ে যায়। এখন আবার অভিনয়ে ফিরেছি। ফিরেই একটা সিনেমার জন্য ডাক পাই। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত অসুস্থ হয়ে পড়ি। যে কারণে শুটিং আর চালিয়ে যেতে পারিনি। পরবর্তী সময়ে পরিচালকের সঙ্গে কথা বলে কাজটা ছাড়তে হয়েছিল। আগে তো জীবন রক্ষা, পরে কাজ।’

২০২৩ সালের কাজ প্রসঙ্গে অভিনেত্রী সীমানার ভাষ্য, ‘এখন কাজের মাধ্যমটাই পরিবর্তন হয়ে গেছে। ওটিটি প্ল্যাটফর্ম–নির্ভর হয়ে গেছে। এখানে কাজের ধরন থেকে সিস্টেম—সবকিছুই আলাদা। সে কারণে বিষয়টা বুঝতে কিছুটা সময় লাগছে। এখনো সময় নিচ্ছি। একদিক থেকে তো খুবই ভালো হয়েছে, আমরা অনেক ধরনের কাজের সুবিধা পাচ্ছি, এটা নতুন অভিজ্ঞতা। এখানে নতুন করে অনেক কিছু শেখার আছে। দুই মাস হলো কাজ শুরু করেছি। এখনো অনেকে জানেই না। সময়ের সাথে সাথে সবাই জানবে।’

দরজা খোলো মাকে দেখব, ছেলের আকুতি

চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে দুপুর ১২টায় লাশবাহী গাড়িতে অভিনেত্রী সীমানার লাশ এল। আশপাশে তখন নীরবতা। কেউ কেউ ক্যামেরা নিয়ে ছুটে গেলেন লাশবাহী গাড়ির কাছে। পাশেই মাইক্রোফোনে ঘোষণা করা হচ্ছে জানাজা আদায় করার কথা। এমন সময় ভিন্ন এক দৃশ্য চোখে পড়ল। ৯ বছরের একটি শিশু দৌড়ে চলে এল লাশবাহী গাড়ির কাছে। এসেই জোরে তালা নাড়তে শুরু করল। বলতে শুরু করল, ‘দরজা খোলো, মাকে দেখব।’ বোঝা গেল, শিশুটি সদ্য মরহুমা অভিনেত্রী সীমানার ছেলে। তার নাম শ্রেষ্ঠ। মাকে দেখার জন্য ছোট্ট শ্রেষ্ঠর আকুলতা আশপাশের সবাইকে আবেগাপ্লুত করে।

বাবা গায়ক পারভেজ সন্তানকে বুঝিয়ে চ্যানেল আই ভবনের ভেতরে নিয়ে যেতে চান। কিন্তু মা যে গাড়িতে। ওকে মায়ের কাছ থেকে দূরে নেওয়ার সাধ্য কার। কিছুক্ষণ পর দৌড়ে আবার চলে লাশবাহী গাড়িটির কাছে। জোরে জোরে তালায় ধাক্কা মারতে শুরু করল। শিশুটি তখন বলছিল, ‘এখানে মা আছে। দরজা খোলো, দরজা খোলো। এখানে মা রয়েছে, আম্মু তোমাকে দেখব। খোলো খোলো, দরজা খোলো।’ পরে দৌড়ে চলে গেল চালকের আসনের কাছে। সেখানে কেউ নেই। চালককে আর দরজা খোলার অনুরোধ করা হলো না শিশুটির।

নির্মাতা ও অভিনেতা সালাহউদ্দিন লাভলুসহ বেশ কয়েকজন কলাকুশলী ও সংবাদকর্মী এ দৃশ্য দেখছিলেন। পাশ থেকে একজন বললেন, ‘আহা রে, এত ছোট বয়সেই মা শব্দটা শিশুর জীবন থেকে চলে গেল। হয়তো বুঝতে পারছে, আজই মাকে শেষবার দেখার সুযোগ।’

কতবার মায়ের সঙ্গে শেরপুরে নানাবাড়িতে ঘুরতে যাওয়া হয়েছে। সেই নানাবাড়িতে মায়ের সঙ্গে আজই শেষ যাওয়া। আর মায়ের ইচ্ছা ছিল আমাকে ক্যাডেট কলেজে পড়াবে। কিন্তু মা তো এখন নেই। মা মারা গেছে, আমার ভালো লাগছে না।’

মায়ের মারা যাওয়াটা এখনো বোঝেনি শিশুটি। সে মনে করছে, মা ফিরে আসবেন। আবার আদর করবেন, গান শোনাবেন, একসঙ্গে খেতে নিয়ে যাবেন। মায়ের সঙ্গে বাইরে খেতে যেত। যেভাবে আগে ঘুরতে যেত। শিশুটি আরও বলতে থাকে, ‘আল্লাহ, তুমি আমার মাকে সুস্থ করে দিয়ো। তুমি আমার মাকে জান্নাতে নিয়ে যেয়ো। আমার মায়ের জন্য সবাই দোয়া করবেন। মা অসুস্থ। আমি মাকে অনেক ভালোবাসি।’

তখন পাশেই কাঁদছিলেন সীমানার বাবা। মেয়ের মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছেন তিনি। কথা বলতেই পারলেন না। পাশ থেকে সীমানার মা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘আমার মেয়েকে তোমরা এনে দাও। আমার ভালো মেয়েটা চলে গেল। কোথা থেকে কী হয়ে গেল, কিছুই বুঝলাম না। কত কিছু নিয়ে কত ইচ্ছা ছিল মেয়ের। কিছুই করা হলো না। আমার মেয়ের জন্য সবার কাছে দোয়া চাই।’ এ সময় সীমানার সহকর্মীদের উদ্দেশে এই অভিনেত্রীর ছোট ভাই এজাজ বিন আলী বলেন, ‘আমার বোন যদি তার কোনো সহকর্মী কারও কাছে কোনো ভুল করে থাকে, আপনারা ক্ষমা করে দেবেন।’

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *