■ নাগরিক প্রতিবেদন ■
সজীব ওয়াজেদ জয়কে অপহরণ ও হত্যাচেষ্টার মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত।
রোববার (২৯ সেপ্টেম্বর) সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে এ মামলায় আত্মসমর্পণ করতে আদালতে আসেন তিনি। এ সময় তার পক্ষে আপিলের শর্তে জামিন আবেদন করেন আইনজীবীরা।
শুনানি শেষে ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. মাহবুবুল হকের আদালত তার জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। একইসঙ্গে তাকে কারাগারে ডিভিশন দেওয়ার আদেশ দিয়েছেন আদালত।
কারাদণ্ডপ্রাপ্ত অন্য তিনজন হলেন- জাতীয়তাবাদী সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংস্থার (জাসাস) সহসভাপতি মোহাম্মদ উল্লাহ মামুন, তাঁর ছেলে রিজভী আহাম্মেদ সিজার এবং যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান ভূঁইয়া।
এই মামলায় সাংবাদিক শফিক রেহমান ও যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান ভূঁইয়ার সাজা এক বছরের জন্য স্থগিত করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে ২২ সেপ্টেম্বর প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁদের সাজা স্থগিত করা হলো। তবে তাঁদের আত্মসমর্পণ করে আপিল করতে হবে।
২০২৩ সালের ১৭ আগস্ট ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আসাদুজ্জামান নূরের আদালত মাহমুদুর রহমান ও সাংবাদিক শফিক রেহমানসহ পাঁচজনের পৃথক দুই ধারায় এ কারাদণ্ড দেন।
মামলার অভিযোগ বলা হয়, ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরের আগে যে কোনো সময় থেকে এপর্যন্ত বিএনপির সাংস্কৃতিক সংগঠন জাসাসের সহ-সভাপতি মোহাম্মদ উল্লাহ মামুনসহ বিএনপি ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটভুক্ত অন্যান্য দলের উচ্চপর্যায়ের নেতারা রাজধানীর পল্টনের জাসাস কার্যালয়ে, আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে, যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার আসামিরা একত্রিত হয়ে যোগসাজশে প্রধানমন্ত্রীর ছেলে ও তার প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়কে আমেরিকায় অপহরণ করে হত্যার ষড়যন্ত্র করেন। ওই ঘটনায় ডিবি পুলিশের পরিদর্শক ফজলুর রহমান ২০১৫ সালের ৩ আগস্ট বাদী হয়ে পল্টন মডেল থানায় মামলাটি করেন। ২০১৮ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি এই পাঁচজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। এ মামলায় সজীব ওয়াজেদ জয়সহ ১২ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন।
মাহমুদুর রহমানের আইনজীবী সৈয়দ জয়নাল আবেদীন মেজবাহ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘শাস্তির পরিমাণ অনুযায়ী বিচারিক আদালতের এখতিয়ার না থাকায় জামিন দেননি। আমরা আপিল করব। মিথ্যা মামলায় সাজা হয়েছে। আশা করি আমরা আপিল করলেই জামিন পাব এবং এই মামলা থেকে অচিরেই খালাস পাবেন মাহমুদুর রহমান।’
মাহমুদুর রহমানের জামিন কেন হলো না, এমন প্রশ্নে তার আইনজীবী সৈয়দ জয়নুল আবেদীন মেজবাহ বলেন, গত বছরের ১৭ আগস্ট মাহমুদুর রহমানকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। এক ধারায় পাঁচ বছর আরেক ধারায় দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী কোনো আদালত যদি এক বছরের বেশি কারাদণ্ড দেন তাহলে তিনি এ মামলায় জামিন দিতে পারেন না।
তিনি বলেন, আমরা অতিদ্রুত মহানগর দায়রা আদালতে মাহমুদুর রহমানের জামিন আবেদন করব। আশা করি তিনি জামিন পাবেন।
এদিকে তার আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার জানিয়েছেন, রাজনৈতিক ভাবে নয় বুদ্ধিবৃত্তিক পথেই এ মামলা মোকাবিলা করবেন সাংবাদিক মাহমুদুর রহমান।
অন্য দিকে তার ফাইলিং ল’ইয়ার জয়নুল আবেদীন মেসবাহ অভিযোগ করে বলেন, এ মামলার কথিত ভিকটিম জয়ের সঙ্গে রায় প্রদানকারী বিচারকের ছবিই প্রমাণ করে এ মামলার বিচার প্রক্রিয়া ছিল ষড়যন্ত্রের অংশ। মাহমুদুর রহমানকে দমানোর জন্য কাল্পনিক অভিযোগে দায়ের করা মামলায় সাজা দেওয়া হয়। আমরা আজকের আদেশের পূর্ণাঙ্গ কপি পেলেই উচ্চ আদালতে আপিলে যাবো। আশা করছি শিগগিরই তিনি কারামুক্ত হবেন।
গত শুক্রবার দেশে ফিরে দেশের প্রচলিত আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়েই তিনি আদালতে আত্মসমর্পণ করতে এসেছেন। এসময় তাকে কোন কথা বলতে দেখা যায়নি। জনাকীর্ণ আদালত কক্ষে আসামির ডকে দাঁড়িয়ে ছিলেন মাহমুদুর রহমান। এরপর আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। সেইসঙ্গে কারাবিধি অনুযায়ী তাকে ডিভিশন দেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়। বেলা ১১টা ২৫ মিনিটে কড়া নিরাপত্তায় প্রিজন ভ্যানে করে তাকে আদালত থেকে কারাগারে পাঠানো হয়।
রাজধানীর চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ঘুরে দেখা যায়, আদালতের প্রধান ফটকে অবস্থান নিয়েছিল সেনাবাহিনীর সদস্যরা। সেখানে প্রায় ১৫ জনের মতো সেনাসদস্য প্রাথমিক নিরাপত্তার বিষয়টি দেখছিলেন। তাদের পেছনেই ছিল প্রাধান ফটক। ফটকের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। খোলা ছিল শুধু পকেট গেট। এই গেটেও অবস্থান নিয়েছিল সেনাসদস্যরা। তারা আদালত এলাকায় যারা প্রবেশ করতে চেয়েছেন, তাদের পরিচয় নিশ্চিত হতে পরিচয়পত্র দেখছিলেন প্রবেশকারীদের।
ওই সময়টাতে শুধুমাত্র সাংবাদিক ও আইনজীবীদের প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছিল। এরপর আদালত ভবনের গেটের সামনেও অবস্থান নিয়েছিলেন ১০ জনের বেশি সেনা সদস্য। কয়েকজন পুলিশ সদস্যও এসময় উপস্থিত ছিলেন।
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে পুরান ঢাকার জনসন রোড দিয়ে আদালতের দিকে আসেন মাহমুদুর রহমান। এসময় তাকে হেঁটে আসতে দেখা যায় এবং তার অনুসারীরা সঙ্গে ছিলেন। তারা স্লোগানে মাতিয়ে তুলছিলেন জনসন রোড। শুরুতে মাহমুদুর রহমান এসেছিলেন একটি প্রাইভেটকারে। আর তারা অনুসারী এসেছিলেন ২টি পিকআপে। পরে তারা একসঙ্গে মিছিল নিয়ে আদালত এলাকায় প্রবেশ করতে চান। কিন্তু নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সেনাসদস্যরা এতে বাধা দেন। এসময় অনুসারীদের সঙ্গে সামান্য ধাক্কাধাক্কির ঘটনাও ঘটে।
এরপর মাহমুদুর রহমান অনুসারীদের নিয়ে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের গেট দিয়ে প্রবেশ করেন। পরে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ভবনের ৪ তলার সংযোগ সড়ক দিয়ে চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. মাহবুবুল হকের আদালতে প্রবেশ করেন তিনি। বেলা পৌনে এগারোটায় আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। এর আগে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন মাহমুদুর রহমান। এসময় তিনি বলেন, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতেই আত্মসমর্পণ করছি।
এদিন তার পক্ষে বিএনপি-জামায়াতপন্থি বেশ কয়েকজন আইনজীবী শুনানি করেন। তারা আদালতকে জানান, সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগে দায়ের করা মামলায় মাহমুদুর রহমানকে সাজা দেওয়া হয়েছে। তিনি একজন বিপ্লবী সাংবাদিক নেতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েট থেকে পড়াশোনা করেছেন। একসময় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ছিলেন, বিনিয়োগ বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যানও ছিলেন। তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে আদালতে জামিন নেবেন না।