■ নাগরিক প্রতিবেদক ■
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) নতুন সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুল।
৫৭ বছর বয়সী বাংলাদেশের প্রথম এই টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান দীর্ঘদিন আইসিসির ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেছেন। পরিবার নিয়ে থেকেছেন অস্ট্রেলিয়ায়।
সাবেক দুই সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন ও ফারুক আহমেদের মতো বুলবুলও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হলেন। তিনি বিসিবির ১৬তম সভাপতি নির্বাচিত হন।
শুক্রবার (৩০ মে) প্রজ্ঞাপন জারি করে আমিনুল ইসলামকে বিসিবির পরিচালক হিসেবে মনোনয়ন দেয় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি)।
এদিন ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালকদের সভায় পরিচালকদের প্রত্যক্ষ ভোটে ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি নির্বাচিত হন দেশের প্রথম টেস্ট অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুল।
উল্লেখ্য, গত বছরের আগস্টে কোটা সংস্কার নিয়ে ছাত্র আন্দোলনের তোপের মুখে পড়ে দেশ থেকে পালিয়ে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ফারুক আহমেদকে ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক হিসেবে মনোনয়ন দেয় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি)।
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কোটায় বিসিবির পরিচালক হয়ে পরিচালকদের প্রতক্ষ ভোটে প্রথমবারের মতো ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি নির্বাচিত হন ফারুক আহমেদ।
কিন্তু ৯ মাসের মাথায় পরিচালকদের অনাস্থার কারণে ২৯ মে ফারুক আহমেদের পরিচালক পদ প্রত্যাহার করে নেয় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। আর তাই তিনি বিসিবির সভাপতি হিসেবে থাকার যোগ্যতা হারালেন। তার পরিবর্তে ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি হলেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল।
সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার পর মিরপুরে প্রথমবার গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়েছেন আমিনুল। সেখানে এক প্রশ্নের জবাবে বিসিবির সঙ্গে এ যাত্রায় যুক্ত হওয়ার গল্প শুনিয়েছেন তিনি। বলেছেন, ‘এপ্রিল মাসের শেষের দিকে আমি একটা ফোন কল পাই যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের এনএসসি থেকে। বলা হয়, আপনাকে একটা সুযোগ দেওয়া হবে আপনি কি গ্রহণ করবেন?’
যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার এক ফোনেই বিসিবির দায়িত্ব নিয়ে আগ্রহী হন জানিয়ে আমিনুল যোগ করেন, ‘ফোনটা পেয়েছিলাম সম্মানিত ক্রীড়া উপদেষ্টার কাছ থেকে। তিনি যখন কলটা করেছেন, তখন পিছনে ফিরে তাকাইনি। শুধু ভেবেছি, কীভাবে সেই ফোনকলটাকে সম্মান করা যায়। তিনি ফোন করায় আমি খুব সম্মানিত বোধ করছি। এখন আমার কাজ দেশের ক্রিকেটকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। আমরা সবাই মিলে একটা দল। আমরা বাংলাদেশকে সমর্থন করি। সবাই মিলেই দেশের ক্রিকেটের জন্য কাজ করব।’
ক্রিকেট বোর্ডের নিজের ভাবনা ও ক্রিকেটের উন্নতি নিয়ে বুলবুল বলেন, ‘আমি আমার সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করবো। ইনশাআল্লাহ, আমি ফেইল করবো না।’
অপর এক প্রশ্নের জবাবে আমিনুল বলেছেন, ‘টেস্ট পাঁচ দিনের খেলা, ওয়ানডে হয় সাত ঘণ্টা। আমি একটা কুইক টি-টোয়েন্টি ইনিংস খেলতে চাই।’
এদিকে আগামী অক্টোবরে বিসিবির নির্বাচন হওয়ার কথা। তাই সভাপতি হিসেবে তার মেয়াদ নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় তাকে। এসময় আমিনুল বলেন, তিন মাসের নির্ধারিত সময় নিয়ে তিনি বিসিবির সভাপতি হননি, ‘আমি বিসিবির নির্বাচিত সভাপতি। কোন নির্দিষ্ট টাইমফ্রেম নিয়ে এখানে আসিনি।’
গতকাল রাতে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ফারুক আহমেদের মনোনয়ন বাতিল করার পর আজ বিকেলে আমিনুলকে পরিচালক করে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। এরপর সন্ধ্যায় এক বোর্ড সভায় তাঁকে সভাপতি নির্বাচিত করেছেন পরিচালকেরা।
বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টে দেশের হয়ে প্রথম সেঞ্চুরি করা আমিনুল জাতীয় দলে খেলেছেন এক যুগের বেশি সময় ধরে। জাতীয় দলের জার্সি গায়ে ১৩ টেস্ট ও ৩৯ ওয়ানডেতে খেলা আমিনুলের নেতৃত্বেই ১৯৯৯ সালে প্রথম বিশ্বকাপ খেলে বাংলাদেশ। ২০০২ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় বলে দেওয়ার পর দেশে কোচিং শুরু করেছিলেন। পরে অস্ট্রেলিয়ায় পরিবার নিয়ে থিতু হন।
গত এক যুগের বেশি সময় আইসিসি ও এসিসির বিভিন্ন দায়িত্বে ছিলেন আমিনুল। বিসিবিতে আসার আগপর্যন্ত আইসিসির এশিয়া অঞ্চলের ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ছাড়া আইসিসির হাইপারফরম্যান্স কার্যক্রম এবং ট্রেনিং এডুকেশনেরও প্রধান তিনি। আইসিসির ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার হিসেবে আগামী মাসে তাঁর চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে।
গত আগস্টে এনএসসি থেকে মনোনীত হয়ে বিসিবি পরিচালক হন ফারুক আহমেদ ও নাজমূল আবেদীন। তাঁদের মধ্যে ফারুককে সভাপতি মনোনীত করেন পরিচালকেরা। ৯ মাসের মাথায় তাঁর মনোনয়ন বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ক্রীড়া পরিষদ।
গত বুধবার রাতে ফারুকের সঙ্গে বৈঠক করেন ক্রীড়া উপদেষ্ট আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া। তখন বিসিবি সভাপতি পদ থেকে সরে দাঁড়াতে বলা হয় তাঁকে। তবে তিনি জানিয়ে দেন, পদত্যাগ করবেন না। এরপর সন্ধ্যায় বিসিবির ৮ পরিচালক এনএসসিতে চিঠি দিয়ে ফারুকের বিরুদ্ধে অনাস্থা জানান। রাতেই ফারুককে দেওয়া পরিচালক মনোনয়ন বাতিলের কথা জানায় এনএসসি, তাতে সভাপতির পদও হারান তিনি।
আগামী অক্টোবর পর্যন্ত বিসিবি সভাপতির দায়িত্বে থাকবেন নতুন সভাপতি আমিনুল।
আমিনুল ইসলাম বুলবুল বাংলাদেশের ক্রিকেটের সঙ্গে ঐতিহাসিকভাবে জড়িয়ে। ১৯৯৯ সালে তার অধিনায়কত্বে বাংলাদেশ প্রথম বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলে। পরের বছর বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরি করেন। খেলা ছাড়ার পর বুলবুলের পরিচয় হয়েছে ক্রিকেট উন্নয়ন কর্মকর্তা হিসেবে। এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল ও আইসিসির হয়ে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বুলবুলের হাত ধরে ক্রিকেটের চর্চা শুরু হয়েছে। অথচ সেই বুলবুলের ক্রীড়াঙ্গনে ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল ফুটবলার হিসেবে।
রাজধানী ঢাকার গেন্ডারিয়া এলাকায় বুলবুলের বেড়ে উঠা। আশির দশকে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবলার। আর সেই সময় গেন্ডারিয়াতে গেন্ডারিয়া ফেমাস, ইস্ট এন্ড ক্লাব ঘরোয়া ফুটবলে বেশ সমাদৃত। অন্য দশ জনের মতো বুলবুলের শৈশব কেটেছে ফুটবলে। এলাকার দল গেন্ডারিয়া ফেমাস, ইস্ট এন্ড হয়ে পরবর্তীতে দেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী ভিক্টোরিয়া ক্লাবের হয়ে ঢাকা প্রথম বিভাগ ফুটবল লিগ খেলেছেন।
জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার মামুন বাবুর বেড়ে উঠা গেন্ডারিয়াতেই। তাই বুলবুলকে একেবারে ছোটবেলা থেকেই তার চেনা। ফুটবলার বুলবুল নিয়ে মামুন বাবুর মন্তব্য, ‘এলাকায় বুলবুল আমাদের পরের ব্যাচ। বেশ ভালো ফুটবলারই ছিল সে। বিশেষ করে গোল করার অ্যাবিলিটি দারুণ ছিল।’
ক্রীড়াবিদ বুলবুলের মতো মানুষ বুলবুলকেও বেশ সমীহ মামুন বাবুর, ‘বুলবুল আমার খুব কাছের ছোট ভাই। আমাদের বাসা একেবারে কাছাকাছি ছিল। সে যদি ফুটবলেই থাকত তাহলে ফুটবলার হিসেবেও অনেক বড় হতে পারত। ক্রিকেটের পেছনে তার অনেক সাধনা ছিল। ক্রিকেটার হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছে। খেলোয়াড় বুলবুলের মতোই মানুষ বুলবুল অসাধারণ। এক সময়ের ফুটবলার এখন দেশের ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি বিষয়টি ফুটবলারদের জন্য দারুণ রোমাঞ্চের।’
আমিনুল ইসলাম বুলবুল ফুটবল ছেড়ে ক্রিকেটে যাওয়ার পেছনের কারণ ইনজুরি। ভিক্টোরিয়া ও মোহামেডানের মধ্যকার ম্যাচে বুলবুল ব্যথা পান। এরপর আর ফুটবলে ফেরা হয়নি। ক্রিকেটের পথ বেছে নেন। সাবেক জাতীয় ফুটবলার ও কোচ শফিকুল ইসলাম মানিক তিন যুগ আগের স্মৃতি হাতড়ে বলেন, ‘আমি মোহামেডানের হয়ে খেলছিলাম বুলবুল ভিক্টোরিয়ার। আমার এক ট্যাকেলে সে আঘাত পায়। ঐ আঘাত কাটিয়ে আর ফুটবলে ফিরেনি ক্রিকেটে মনোযোগ দিয়েছিল।’
বুলবুল ফুটবল ছাড়লেও ফুটবলারদের সঙ্গ ছাড়েননি। গত এক যুগে যখনই বিদেশ থেকে দেশে বেড়াতে এসেছেন। জাতীয় স্টেডিয়ামে এক পা দিয়েছেনই। বিদেশে থাকলেও তার সম-সাময়িক ফুটবলারদের সঙ্গে থাকত নিয়মিত যোগাযোগ। সাবেক তারকা ফুটবলার ও বাফুফে নির্বাহী সদস্য গোলাম গাউস বুলবুল সম্পর্কে বলেন, ‘আমাদের সময়ে ফুটবলার-ক্রিকেটার ও হকি খেলোয়াড়দের মধ্যে অত্যন্ত দারুণ সম্পর্ক ছিল। আমরা একেকজন একেক খেলার একেক ক্লাবের হয়ে একে অন্যের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলাম। আমাদের মধ্যে এখনো সেই সম্পর্ক রয়েছে।’
ফুটবলার থেকে পুরোদস্তুর ক্রিকেটার হওয়ার পর আমিনুল ইসলাম বুলবুলের ক্যারিয়ারের বড় সময় কেটেছে ঢাকা মোহামেডানে। তাই মোহামেডানের ফুটবলারদের সঙ্গে বুলবুলের সখ্যতা ও আন্তরিকতা আরেকটু বেশিই। মোহামেডানের সাবেক তারকা গোলরক্ষক ও বাফুফে সদস্য ছাইদ হাসান কানন বলেন, ‘মোহামেডানের স্বর্ণালী সময়ে আমরা ফুটবল আর বুলবুলরা ক্রিকেট খেলেছে। ফুটবল ছাড়লেও বুলবুল মোহামেডানের অনেক খেলা দেখতে স্টেডিয়াম গেছে। বিশেষ করে ক্লাবের সিনিয়র ফুটবলারদের প্রতি তার ছিল অন্য রকম ভালোবাসা। এজন্য আমাদের বাড়তি স্নেহও তার প্রতি সব সময়।’
দেশের অন্যতম শীর্ষ ফেডারেশন ক্রিকেট বোর্ডের সর্বোচ্চ ব্যক্তি এক সময় ফুটবলার ছিলেন। যেনতেন পর্যায়ের নয় একেবারে সেই সময় শীর্ষ স্তরেই খেলেছেন। সাবেক ফুটবলার বিসিবি সভাপতি হওয়ায় ফুটবলাঙ্গনে বাড়তি আনন্দ। সাবেক ফুটবলারদের সংগঠন সোনালী অতীতের পক্ষ থেকে বুলবুলকে সম্মাননা জানানোর পরিকল্পনা করছে।