:: নাগরিক প্রতিবেদন ::
চলমান চার দফা দাবিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে এক দফা দাবিতে নামিয়ে ফের সারা দেশে ব্লকেড কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা।
রোববার (৭ জুলাই) রাত ৮টায় শাহবাগে অবরোধ কর্মসূচির শেষে নতুন এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম।
রাত ৮টা ৫ মিনিটে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা অবরোধ তুলে নিলে শাহবাগে যানচলাচল স্বাভাবিক হয়। এর আগে পূর্বঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে বিকেল সোয়া তিনটা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়। মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে রাজু ভাস্কর্য-চারুকলা শাহবাগ মোড়ে গিয়ে শিক্ষার্থীরা অবরোধ করেন।
নাহিদ ইসলাম বলেন, সোমবার (৮ জুলাই) বিকেল সাড়ে ৩টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে থেকে মূল ব্লকেড আন্দোলন শুরু হবে। তাছাড়া একই সময়ে সারা দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে এই ব্লকেড কর্মসূচি শুরু হবে।
শিক্ষার্থীদের এক দফা দাবি হলো- সব গ্রেডে সব ধরনের অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে সংবিধানে উল্লিখিত অনগ্রসর গোষ্ঠীর জন্য কোটাকে ন্যূনতম পর্যায়ে এনে সংসদে আইন পাস করে কোটা পদ্ধতিকে সংশোধন করতে হবে।
এই আন্দোলনের তিন সমন্বয়কের সঙ্গে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা বৈঠক করেছেন বলে জানা গেছে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম ও হাসনাত আব্দুল্লাহ।
এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন কোটাবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী হাসিব আল ইসলাম।
বিকেল ৩টায় শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হল থেকে আলাদা ব্যানারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল লাইব্রেরির সামনে জড়ো হন। পরে সেখান থেকে বিশাল মিছিল নিয়ে হলপাড়া-ভিসি চত্বর-টিএসসি হয়ে বিকেল পৌনে ৪টায় শাহবাগ ও ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড়ে অবস্থান নেন। তবে সুফিয়া কামাল হল, অমর একুশে হল, শহীদুল্লাহ হলের শিক্ষার্থীরা চানখারপুল অবরোধ করেন। তাছাড়া ঢাকা কলেজ ও ইডেন কলেজ শিক্ষার্থীরা নিউমার্কেট-সায়েন্সল্যাব রোড অবরোধ করায় এই এলাকার সবকিছু স্থবির হয়ে পড়ে। পরে রাত ৮টায় সংবাদ সম্মেলনে সোমবারের কর্মসূচি ঘোষণার মাধ্যমে শাহবাগ অবরোধ শেষ করেন আন্দোলনকারীরা।
আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, আমরা অনেক আলোচনা করেছি, এখন আলোচনার সময় শেষ হয়েছে। বিনিময়ে আমরা পেয়েছি প্রহসন। এবার কোনো প্রহসন মেনে নেওয়া হবে না। কোটা বৈষম্যেরও চূড়ান্ত সমাধান করতে হবে। আমরা স্পষ্ট বলতে চাই, আমাদের দাবি শুধু আদালতের কাছে নয়, আমরা নির্বাহী বিভাগের কাছেও জানতে চেয়েছি কেন ২০১৮ এর পরিপত্র বাতিল করা হলো। সরকারের কাছে এখনো সুযোগ রয়েছে নতুন করে পরিপত্র ঘোষণা করার। ২০১৮ সালে কোটা সমস্যার আংশিক সমাধান হয়েছিল। সে সময় আমরা তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে কোটার যৌক্তিক সংস্কার পাইনি। এবার যখন মাঠে নেমেছি আমরা সব গ্রেডে কোটার সংস্কার নিয়েই ঘরে ফিরব। আমরা কোন আপসে যাব না, আমরা কোনো আলাপে যাব না।
আদালত দেখানোর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা সংবিধানের পক্ষে লড়াই করছি। কেননা সংবিধানে সুযোগের সমতার কথা বলা হয়েছে। আমাদের আদালতের জন্য অপেক্ষা করার কথা বলা হচ্ছে। আমরা ৫০ বছর অপেক্ষা করছি। আর কত? শিক্ষার্থীদের পিঠ দেয়ালে লেগে গেছে। হয় কোটা দূর করতে হবে নয়তো পুরো বাংলাদেশকে শতভাগ কোটার আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
কর্মসূচি ঘোষণা করে নাহিদ ইসলাম বলেন, আমরা আজকের ব্লকেড কর্মসূচিতে অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছি। আগামীদিনে এই ব্লকেড কর্মসূচি আরো ছড়িয়ে যাবে। অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে ছাত্র ধর্মঘট চলবে। একইসঙ্গে সারা দেশে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি চলবে। আজকে শাহবাগ থেকে বাংলামোটর পর্যন্ত অবরোধ গিয়েছে কালকে ফার্মগেট পর্যন্ত যাবে। আগামীকাল বিকেল সাড়ে ৩টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে থেকে এই ব্লকেড কর্মসূচি শুরু হবে।
চার দফার পরিবর্তে একদফা দাবি ঘোষণা করে হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, আমরা এতদিন চার দফা দাবিতে আন্দোলন করেছি। আগামীকাল থেকে আমরা এক দফা দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাব। আমাদের দাবি হলো- সব গ্রেডে সব ধরনের অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে সংবিধানে উল্লিখিত অনগ্রসর গোষ্ঠীর জন্য কোটাকে ন্যূনতম পর্যায়ে এনে সংসদে আইন পাস করে কোটা পদ্ধতিকে সংশোধন করতে হবে।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছের লোকগুলো তার কাছে সঠিক বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে না। আপনার কাছে বলতে চাই, সারা দেশের সবাই আপনার দিকে তাকিয়ে আছে। চাকরিতে নাতিপুতি কোটা আমরা মানি না। ৫৬ শতাংশ কোটা একটি দেশের চাকরিতে থাকতে পারে না। আমাদের ব্যাপারে বলা হচ্ছে, আমরা নাকি নেতা হতে এই আন্দোলন করছি। আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, আজকে আমাদের দাবি মেনে নেওয়া হলে আগামীকাল থেকে আমাদের কোনো আন্দোলনে দেখবেন না। আমরা টেবিল থেকে এসেছি টেবিলেই ফিরে আসতে চাই।
রাজধানীজুড়ে তৈরি হয় তীব্র যানজট
সরকারি চাকরির নিয়োগে কোটা বাতিল এবং ২০১৮ সালের পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়, শাহবাগ মোড়, নীলক্ষেত, ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের মোড় ও চানখারপুলে সড়ক অবরোধ করেছে শিক্ষার্থীরা। এর ফলে রাজধানীর এসব গুরুত্বপূর্ণ মোড়ের চারদিক থেকে আসা কয়েক হাজার গাড়ি আটকা পড়েছে। ফলে রাজধানী জুড়ে তৈরি হয়েছে তীব্র যানজট। চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন ব্যক্তিগত ও গণপরিবহনের যাত্রীরা।
দুপুরের পর সরেজমিনে দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ মিছিলের কারণে শাহবাগ, সায়েন্সল্যাব, চানখাঁরপুল মোড়, আগারগাঁও, মহাখালী ও পল্টন এলাকার গুরুত্বপূর্ণ মোড় অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। এর কারণে রাজধানীর কারওয়ান বাজার, সোনারগাঁও, সাতরাস্তা, মহাখালী, বনানী, কাকলী, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, গুলশান-১, গুলশান-২, গুলশান লিংকরোড এবং প্রগতি সরণিসহ বিভিন্ন এলাকা রাস্তায় থমকে যায় সারি সারি যানবাহন।
যানজটে পড়ে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারও। চানখাঁরপুল মোড়ে হানিফ ফ্লাইওভারের উঠানামার রাস্তা অবরুদ্ধ করে ফেলে শিক্ষার্থীরা। এতে ফ্লাইওভার থেকে মূল সড়কে নামার মুখে গাড়িগুলোকে দীর্ঘ সময় আটকে থাকতে হয়। বেলা ২টা থেকে থেমে থেমে গাড়ি চললেও বিকেল ৪টার পর থেকে উড়ালসড়ক হয়ে রাজধানীর ভেতরে গাড়ি প্রবেশ করতে পারছিল না। অনেককে বাস থেকে নেমে গন্তব্যে হেঁটে রওনা দিতেও দেখা যায়। এ ছাড়া ফ্লাইওভার থেকে নেমে যাত্রাবাড়ীর জনপথ মোড়ে দক্ষিণাঞ্চল থেকে আসা বাসগুলো সড়কের একই স্থানে থেমে যায়। যাত্রীরা বাস থেকে নেমে হেঁটেই রওনা হন। আর বাসগুলো বন্ধ করে চালক ও সহকারীরা ভেতরে অবস্থান করতে দেখা যায়।
ব্যক্তিগত গাড়ি করে বাসায় ফিরছিলেন কল্পনা আক্তার নামে এক নারী সঙ্গে ছিল তার এইচএসসি পরীক্ষার্থী মেয়ে। তিনি বলেন, এই জ্যাম ধানমন্ডি পর্যন্ত ছড়িয়েছে। সাধারণ মানুষের খুব ভোগান্তি হচ্ছে। দুপুর দুইটা থেকে রাস্তায় বসে আছি, এখন সাড়ে তিনটা বাজে।
মৌমিতা পরিবহনের এক বাসচালক বলেন, গাড়ি নিয়ে সায়েন্সল্যাব আসতে দেখি রাস্তা বন্ধ। এখানেই প্রায় এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে আছি। কখন ছাড়বে জানি না।
ডিএমপির ধানমন্ডি জোনের সহকারী কমিশনার (ট্রাফিক) নবকুমার বিশ্বাস বলেন, কলাবাগান সাইন্স ল্যাব, ধানমন্ডি, নীলক্ষেত আশপাশের এলাকায় শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে পুরো সড়ক বন্ধ হয়ে আছে। কোনো গাড়ি চলাচল করতে পারছে না। তবে ধানমন্ডি থেকে গাবতলীর সড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে।
ফার্মগেট হয়ে গাজীপুরগামী এক বাসের চালক বলেন, গাড়ি নিয়া ২ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে আছি। পেছনে গাড়ির সারি। ঘুরিয়ে যে চলে যাব সেই সুযোগও নাই। যানজটে অতিষ্ঠ হয়ে অনেককেই বাস থেকে নেমে হেঁটে চলে যাচ্ছে।
ডিএমপির কারওয়ান বাজার জোনের সহকারী কমিশনার (ট্রাফিক) স্নেহাশীষ কুমার দাস বলেন, কোটাবিরোধী আন্দোলনের ফলে কোনো গাড়ি কারওয়ান বাজার থেকে শাহবাগের দিকে যেতে পারছে না। ফলে এ যানজট ফার্মগেট-তেজগাঁও ছাড়িয়ে বিজয় সরণি পর্যন্ত পৌঁছেছে। আজ সপ্তাহের প্রথম দিক সব অফিস আদালত খোলা থাকায় সড়কে গাড়ির চাপও বেশি।