■ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি ■
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচনে প্রায় ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী ভোট দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মনির উদ্দিন।
বুধবার (১৫ অক্টোবর) সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার সাংবাদিকদের এ তথ্য দেন। এদিন সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত একটানা ভোটগ্রহণ চলে।
অধ্যাপক মনির উদ্দিন বলেন, ‘এখনো পর্যন্ত আমাদের কাছে সব কেন্দ্রের তথ্য আসেনি। তবে সার্বিকভাবে বলা যায়, প্রায় ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী ভোট দিয়েছেন। সমাজবিজ্ঞান অনুষদ ভবনে ৬৭ দশমিক ১৭ শতাংশ, আইটি ভবনে ৭২ শতাংশ এবং বিজ্ঞান অনুষদ ভবনে ৬৯ শতাংশ ভোটারের ভোট পড়েছে।’
অন্যদিকে চাকসু নির্বাচন কমিশনের সদস্য সচিব অধ্যাপক একেএম আরিফুল হক সিদ্দিকী সাংবাদিকদের বলেন, ‘মোট ভোটারের ৬০ শতাংশেরও বেশি ভোট পড়েছে, এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।’
এর আগে দুপুরে নির্বাচন ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য ও আইসিটি সেলের প্রধান অধ্যাপক সাইদুর রহমান বলেন, ভোট গণনা শেষ করতে এবং ফলাফল ঘোষণা করতে আগামীকাল বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
সন্ধ্যায় পৃথক সংবাদ সম্মেলনে বামপন্থী শিক্ষার্থীদের প্যানেল ‘বৈচিত্র্যের ঐক্য’ এবং সুফিবাদী আদর্শে বিশ্বাসী ‘অহিংস শিক্ষার্থী ঐক্য’ প্যানেল এসব অভিযোগ তুলে ধরে।
বৈচিত্র্যের ঐক্য প্যানেলের ভিপি প্রার্থী ধ্রুব বড়ুয়া বলেন, ৩৫ বছর পর এই বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকসু নির্বাচন হলো, যা একটি ঐতিহাসিক দিন হতে পারত। কিন্তু দুপুরের পর থেকে বেশ কিছু ঘটনা এই নির্বাচনকে কলঙ্কিত করেছে। ভোটের সময় ব্যবহৃত কালি অমোচনীয় ছিল না- কিছুক্ষণ পর তা মুছে যাচ্ছিল। এছাড়া অনেক কেন্দ্রে ভোটারদের স্বাক্ষর নেওয়া হয়নি, যার ফলে একই ব্যক্তি একাধিকবার ভোট দিতে পেরেছেন। এতে নির্বাচন কমিশন একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করেছে।
সংবাদ সম্মেলনে ধ্রুব আরও বলেন, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের ৩৫৩ নম্বর কক্ষে একই আইডি দিয়ে দুবার ভোট দেওয়া হয়েছে। নতুন কলা ভবনের একটি কক্ষে সাংবাদিকদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি। একই ভবনের এলইডি ডিসপ্লে ভাঙচুর ও ভোট গণনার সময় পোলিং এজেন্টদের হুমকি দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে, ‘অহিংস শিক্ষার্থী ঐক্য’ প্যানেলের ভিপি প্রার্থী ফরহাদুল ইসলাম প্রশাসনের একপেশে আচরণ ও অনিয়মের আটটি অভিযোগ তুলে ধরে বলেন, নির্বাচন কমিশনের কাছে আমরা বিষয়গুলো জানালেও তারা কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। আইটি ভবনের ২১৪ নম্বর কক্ষে ২০টি স্বাক্ষরবিহীন ব্যালট পেপার বাক্সে ঢোকানো হয়েছে। পানি দিলেই মুছে যাচ্ছে অমোচনীয় কালি- এটা প্রশাসনের গাফিলতি। অনেক ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের স্বাক্ষরও নেওয়া হয়নি।
তার দাবি, নির্দিষ্ট প্যানেলের লিফলেট ভোটকেন্দ্রের সামনে রেখে ভোটারদের প্রভাবিত করা হয়েছে, আবার অনেক প্রার্থী ভোটকেন্দ্রের কাছে গিয়ে ভোটারদের কাছে ব্যালট নম্বর লিখে দিয়েছেন। আমাদের প্যানেলের পর্যবেক্ষকদের কোনো কার্ড দেওয়া হয়নি। অন্যদিকে, প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তা একটি বিশেষ পক্ষের হয়ে কাজ করেছেন।
তিনি আরও অভিযোগ করেন, বহিরাগতরা ক্যাম্পাসে ঢুকে নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছে। প্রশাসন সেটা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে, যা রহস্যজনক। ৩৫ বছর পর চাকসু নির্বাচন একটি নতুন প্রজন্মের আশা জাগিয়েছিল। কিন্তু প্রশাসনের ব্যর্থতা ও অদূরদর্শিতার কারণে সেই আনন্দের আমেজ শিক্ষার্থীরা অনুভব করতে পারেননি।
ধবার (১৫ অক্টোবর) রাত ৮টার পর সরেজমিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা এবং সমাজ বিজ্ঞান অনুষদ ভবনের সামনে গিয়ে দেখা যায়, চারপাশে টানটান উত্তেজনা।
ভবনের ভেতরে গণনা চললেও বাইরে থাকা এলইডি স্ক্রিন ঘিরে সতর্ক অবস্থান নিয়েছেন নারী শিক্ষার্থীরা। তাদের চোখে স্পষ্ট দৃঢ়তা।
তারা বলছেন, ফলাফল যাতে কেউ প্রভাবিত করতে না পারে, সেটিই নিশ্চিত করতে তারা কেন্দ্রে অবস্থান করছেন।
এক নারী শিক্ষার্থী বলেন, সারাদিন আমরা ভোট দিয়েছি বিশ্বাস নিয়ে। এখন যদি কেউ কারচুপি করে, তাহলে সেই বিশ্বাসটা নষ্ট হয়ে যাবে। তাই আমরা চাই, ফলাফল যেন নিরপেক্ষভাবে ঘোষণা হয়। এজন্যই আমরা এখানে আছি।
চাকসু নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা ২৭ হাজার ৫১৬ জন। এর মধ্যে এর মধ্যে ছাত্র ভোটার ১৬ হাজার ৮৪ জন ও ছাত্রী ভোটার ১১ হাজার ৩২৯ জন। তাদের ভোটে এক বছরের জন্য গঠিত হবে ২৬ সদস্যের কেন্দ্রীয় সংসদ। একই মেয়াদে ১৪টি হল ও একটি হোস্টেলেও গঠিত হচ্ছে সংসদ। আর চাকসু মনোনীত পাঁচ শিক্ষার্থী প্রতিনিধি হবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম—সিনেটের সদস্য।
চাকসু নির্বাচনে সহসভাপতি (ভিপি) পদে ২৫ জন, সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে ২২ জন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) ২২ জন, খেলাধুলা ও ক্রীড়া সম্পাদক ১২ জন, সহ-খেলাধুলা ও ক্রীড়া সম্পাদক ১৫ জন, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও প্রকাশনা সম্পাদক ১৮ জন, সহ-সাহিত্য, সংস্কৃতি ও প্রকাশনা সম্পাদক ১৬ জন, দপ্তর সম্পাদক ১৮ জন, সহ-দপ্তর সম্পাদক ১৪ জন প্রার্থিতা করবেন।
এছাড়া ছাত্রী কল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক (নারী শিক্ষার্থীদের জন্য সংরক্ষিত) ১২ জন, সহ-ছাত্রী কল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক (নারী শিক্ষার্থীদের জন্য সংরক্ষিত) ১১ জন, বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক ১১ জন, গবেষণা ও উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক ১৩ জন, সমাজসেবা ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক ২০ জন, স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ১৭ জন, মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন বিষয়ক সম্পাদক ১৭ জন, ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ১৬ জন, যোগাযোগ ও আবাসন বিষয়ক সম্পাদক ২০ জন সহ-যোগাযোগ ও আবাসন বিষয়ক সম্পাদক ১৪ জন, আইন ও মানবাধিকার ১১ জন, পাঠাগার ও ক্যাফেটেরিয়া বিষয়ক সম্পাদক ২১ জন এবং নির্বাহী সদস্য ৫টি পদের বিপরীতে ৮৪ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
সর্বশেষ চাকসু নির্বাচন হয়েছিল ১৯৯০ সালে। এবার ৩৫ বছর পর হচ্ছে নির্বাচন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে চাকসু গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
১৯৬৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরপরই গঠিত হয়েছিল চাকসু। শিক্ষার মান, শিক্ষার্থীদের মানসিক সংস্কৃতির বিকাশ, ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যকার পারস্পরিক সৌহার্দ্যবোধ ও রাষ্ট্রের দমনপীড়নের বিরুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা রাখার জন্যই গঠিত হয় এটি। প্রতিষ্ঠার পর প্রথম কেবিনেট নির্বাচন হয় ১৯৭০ সালে। পরের বছর ১৯৭১ সালেই হয় এর পরের নির্বাচন।এর পর ১৯৭৩ ও ১৯৮০ সালে হয় পরবর্তী দুইটি নির্বাচন। সর্বশেষ নির্বাচন হয় ১৯৯০ সালের ফেবরুয়ারিতে। ১৯৯০ সালে ছাত্র ঐক্য নেতা ফারুকুজ্জামান নিহত হওয়ার অযুহাতে বন্ধ করে দেয়া হয় চাকসু নির্বাচন। সেই থেকে আজ পর্যন্ত অকেজো হয়ে পড়ে ছিল ছাত্র-ছাত্রীদের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ক্রীড়া চর্চার প্রাণ কেন্দ্রটি।