পুলিশের আওয়ামীকরণ: শুরু এবং শেষ

■ আনসার উদ্দিন খান পাঠান ■

২০০৮ সনে ক্ষমতায় এসেই হাসিনা সরকার পুলিশের রাজনীতিকরণ শুরু করেন। এটা তিনি আগের ক্ষমতাকালে ( ১৯৯৬-২০০১) করেননি। সেবার তিনি পুলিশে মাত্র দু’টো কাজ করেছিলেন। প্রায় বছরখানেক ক্ষমতায় থাকার পর চাপে পড়ে স্বাধীনতার পর পর অবসরপ্রাপ্ত মিলিটিরি অফিসারদের থেকে আনা পুলিশ কর্মকর্তাদের বের করে দিয়েছিলেন আর , তার আগে বিএনপি আমলে গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন কর্মকর্তাদের সরিয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ চেয়ারে বসিয়েছিলেন। ব্যস এইটুকুই। পরের বিএনপি আমলেও (২০০১-২০০৫) একইরকম পাল্টা গ্রুপের চাকুরিচ্যুতিতেই কেবল সীমাবদ্ধ ছিল। কোন দলই পুলিশকে রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত করার খেলায় মাতেননি। ২০০৮ এ ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা পুলিশের পুরো দৃশ্যপট পাল্টে দেন।

এ প্রসংগে বলে নেয়া ভাল তখন পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে দু’টো দল ছিল। কারা ছিল প্রথম গ্রুপে? মুজিববাদী ছাত্রলীগ থেকে আগত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ১৪০ জনকে ১৯৭৩ সনে নবগঠিত পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে প্রভিন্সিয়াল সিভিল সার্ভিসের বিধানমতে ডিএসপি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। পিএসসির প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবের রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমদের সরাসরি শিক্ষক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর শিক্ষককে তোফায়েল সাহেব নিজেই প্রভাব বিস্তার করে চেয়ারম্যান পদে বসান। উল্লিখিত অফিসারদের তিনি কেবলমাত্র একটি মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়ে নেন। জনশ্রুতি ছিল তোফায়েল আহমদের স্লিপ নিয়ে যিনি ভাইবা বোর্ডে হাজির হতে পেরেছিলেন ,তিনিই চাকুরি পেয়াছিলেন। আর তাই তাঁরা তোফায়েল ব্যাচ , ১৯৭৩ ব্যাচ, পরে ১ম বি সি এস ব্যাচ হিসেবে পরিচিত হন। ছাত্রলীগের অপর অংশ , যারা পরে জাসদে দলে দলে যোগ দেন, তাঁরা কেউ এই চাকুরিতে ডাক পাননি। এ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দু’পক্ষের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয় হয় বলে শোনা যায়। যা হোক, নির্বাচিতদের চিঠি দিয়ে সারদা পুলিশ একাডেমিতে হাজির হতে বলা হয়। বাছাই যেভাবেই হোক এই ব্যাচে বেশ কয়েককজন উচ্চশিক্ষিত ভদ্রজনও ছিলেন , যারা পরে সার্ভিসে বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন এবং পুলিশের শ্রদ্ধার আসনে আছেন।কিন্তু অনেকেই ছিলেন দ:খজনকভাবে উল্টো। এই মুক্তিযোদ্ধা তরুণদের দু’টি ব্যাচ সারদা পুলিশ একাডেমিতে সংক্ষিপ্ত ( ১২ মাসের জায়গায় ৬ মাস) ট্রেনিং নিয়ে জেলায় জেলায় ডেপুটি পুলিশ সুপার , পরে এ এস পি হিসেবে দায়িত্বে বসেন।তাঁদের মুষ্টিমেয় কয়েকজন বাদে সকলেই পুলিশে আওয়ামীলীগ সমর্থক হিসেবে পরিচিতি পান।

১ বছর ক্ষমতায় থাকার পর ১৯৯৭ সনের দিকে ‘মুক্তিযোদ্ধা পুলিশ গ্রুপ ‘ শেখ হাসিনাকে বুঝাতে সক্ষম হন ‘মিলিটারি পুলিশ গ্রুপ’ এর অসহযোগিতার জন্যই তিনি ৯০ এর পর নির্বাচনে ক্ষমতায় আসতে পারেননি। এটিও বুঝান আওয়ামী লীগের পক্ষ নিতে গিয়ে বিভিন্ন সময় ‘মিলিটারি গ্রুপের’ অফিসারদের কাছে নিগৃহীত হয়েছেন তারা । কমিশন ডেট থেকে সিনিওরিটি দেয়ায় , পুলিশে পরে যোগদান করেও তারা সকলেই গ্রেডেশনে ‘৭৩ ব্যাচের উপরে চলে গেছেন। এখানেই তাঁদের মূল ক্ষোভটা ছিল। ১৯৯৭ সনে পুলিশ সপ্তাহের এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনেই ‘মিলিটারি গ্রুপের’ অফিসারদের অকথ্য ভাষায় গালাগালি করেন ‘৭৩ ব্যাচের কর্মকর্তারা। কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রীর সামনেই টেবিল চাপড়ে উষ্মা প্রকাশ করতে থাকেন এবং মিলিটারি গ্রুপকে বাক্যবাণে অপমান করেন। অসহায় ভাবে মিলিটারি গ্রুপ তা সহ্য করেন। তাদের একজন মেজর অব: ওসমান আলী খান ( তখন তিনি ডি আই জি হিসেবে কর্মরত ছিলেন) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলেন, ‘আমরা মিলিটারি অফিসাররা ইচ্ছে করে পুলিশে আসিনি, সরকার এনেছেন, যদি পছন্দ না হয় আমাদের এভাবে অপমান করবেন না, আমাদের বিদায় করে দিন।’ কেউ কেউ কান্নায় ভেংগে পড়েন। বাড়তে থাকে দুই গ্রুপের বিরোধ। এর পর পরই হাসিনা , শেখ মুজিবের আনা দু’জন বাদে বাকি মিলিটিরি অফিসারদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়ে দেন।

দ্বিতীয় গ্রুপটি ছিল মিলিটিরি থেকে আগত পুলিশ অফিসারদের নিয়ে। এঁদের মধ্যে ২ জনকে আনেন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিব আর ২৩ জনকে আনেন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। তাঁরা প্রায় সকলেই বিএনপিপন্থী অফিসার হিসেবে পরিচিতি পান।

এর বাইরে ছিলেন পাকিস্তান আমলে যোগ দেয়া পিএসপি অফিসার এবং ১৯৭৬ সন থেকে অনুষ্ঠিত পূর্ণাংগ বি সি এস পরীক্ষার মাধ্যমে সুপারিশকৃত পর পর কয়েকটি বি সি এস ব্যাচের অফিসার। এঁদের কোন দলের প্রতি আনুগত্য সেই আমলে স্পষ্ট হয়নি।এর বাইরে সামান্য কয়েকজন অফিসার ছিলেন যারা বি ডি আর কমিশন্ড অফিসার ( যা পরে বিলুপ্ত) , ইন্ডাষ্ট্রিয়াল ম্যানেজমেন্ট সার্ভিস ( যা পরে বিলুপ্ত) থেকে আত্মীকৃত এবং পি এস পি ক্যাডেট ( পরে বিলুপ্ত) এর কতিপয় অফিসার। তাঁরা সকলেই ‘৭৩ ব্যাচের অফিসারদের সাথে যোগ দেন।

১ বছর ক্ষমতায় থাকার পর ১৯৯৭ সনের দিকে ‘মুক্তিযোদ্ধা পুলিশ গ্রুপ ‘ শেখ হাসিনাকে বুঝাতে সক্ষম হন ‘মিলিটারি পুলিশ গ্রুপ’ এর অসহযোগিতার জন্যই তিনি ৯০ এর পর নির্বাচনে ক্ষমতায় আসতে পারেননি। এটিও বুঝান আওয়ামী লীগের পক্ষ নিতে গিয়ে বিভিন্ন সময় ‘মিলিটারি গ্রুপের’ অফিসারদের কাছে নিগৃহীত হয়েছেন তারা । কমিশন ডেট থেকে সিনিওরিটি দেয়ায় , পুলিশে পরে যোগদান করেও তারা সকলেই গ্রেডেশনে ‘৭৩ ব্যাচের উপরে চলে গেছেন। এখানেই তাঁদের মূল ক্ষোভটা ছিল। ১৯৯৭ সনে পুলিশ সপ্তাহের এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনেই ‘মিলিটারি গ্রুপের’ অফিসারদের অকথ্য ভাষায় গালাগালি করেন ‘৭৩ ব্যাচের কর্মকর্তারা। কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রীর সামনেই টেবিল চাপড়ে উষ্মা প্রকাশ করতে থাকেন এবং মিলিটারি গ্রুপকে বাক্যবাণে অপমান করেন। অসহায় ভাবে মিলিটারি গ্রুপ তা সহ্য করেন। তাদের একজন মেজর অব: ওসমান আলী খান ( তখন তিনি ডি আই জি হিসেবে কর্মরত ছিলেন) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলেন, ‘আমরা মিলিটারি অফিসাররা ইচ্ছে করে পুলিশে আসিনি, সরকার এনেছেন, যদি পছন্দ না হয় আমাদের এভাবে অপমান করবেন না, আমাদের বিদায় করে দিন।’ কেউ কেউ কান্নায় ভেংগে পড়েন। বাড়তে থাকে দুই গ্রুপের বিরোধ। এর পর পরই হাসিনা , শেখ মুজিবের আনা দু’জন বাদে বাকি মিলিটিরি অফিসারদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়ে দেন।

পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ২০০১ সনে বেগম খালেদা জিয়া পুনরায় ক্ষমতায় এলে মিলিটারি অফিসারদের থেকে চাকুরিচ্যুতদের মধ্য থেকে দু’জনকে চাকুরিতে ফিরিয়ে আনেন এবং ‘৭৩ ব্যাচের কয়েকজন বাদে অধিকাংশ কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠান।

শুরু হয় পুলিশকে নিয়ে পর্দার অন্তরালে নানান অনভিপ্রেত কার্যকলাপ। ‘৭৩ ব্যাচের চাকুরিচ্যুত অফিসারদের কয়েকজন সংগঠিত হয়ে সুধাসদন এবং আওয়ামিলীগ অফিসের সাথে যোগাযোগ করা শুরু করেন। তাঁরা লালমাটিয়াতে অফিস নিয়ে পুলিশ বিষয়ে রীতিমত রিসার্চ সেন্টার খুলে বসেন। পুলিশের গোপন সিকিউরিটি প্রোগ্রাম, ওয়ারলেস কল রেকর্ড , নানান পরিকল্পনার খসড়া পত্রের কপি তারা সংগ্রহ করা শুরু করেন। এ কাজে তাদের সহযোগিতা করেন ডিপার্টমেন্টে থেকে যাওয়া তাঁদের প্রাক্তন সহকর্মীরা। মঈনুদ্দিন-ফকরুদ্দিনের শেষ সময়ে এই গ্রুপটি পুলিশ নিয়ে তাঁদের তৎপরতা নিয়ে প্রকাশ্যে চলে আসেন। ততদিনে তাঁরা নিশ্চিত হন তত্তাবধায়ক সরকার আওয়ামীলীগকেই সমর্থন দিচ্ছে এবং নির্বাচনে আওয়ামীলীগই বিজয়ী হবে। তারা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে দল বেঁধে জেলার কর্মরত অফিসারদের কাছে গিয়ে আওয়ামিলীগকে জয়ী করার আবেদন রাখেন। কোন কোন জেলা এস পি-কে ফোনকল করে আসন্ন ২০০৮ এর নির্বাচনে জনস্বার্থে আওয়ামীলীগকে সমর্থন দিতে উপুর্যুপরি আহবান জানাতে থাকেন। আমি নিজে একটি জেলায় তখন এস পি হিসেবে কর্মরত ছিলাম এবং বার বার এই গ্রুপের সাবধানী ফোন কল পাই।

নির্বাচনে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসায় তাঁরা উল্লসিত হন। সরকারের নানান পদে চুক্তিভিত্তিক পুনরায় নিয়োগ লাভে তৎপর হন এবং প্রত্যেককে শেখ হাসিনা নানান পদে বসিয়ে সম্মানিত করেন। বিজয়ে পর এই গ্রুপটি পুলিশে কর্মরত কিছু কর্মকর্তাদের সাথে নিয়ে শেখ হাসিনাকে বুঝাতে সমর্থ হন যে, আর রিস্ক নেয়া নয় , এবার বিদ্যমান পুলিশের খোলনলচে পাল্টে ফেলতে হবে। নইলে ভবিষ্যতে আবার নির্বাচনে জেতা কিংবা সরকারের নীতি বাস্তবায়নে সমস্যার সৃষ্টি হবে। সার্ভিসে থাকা গোপালগঞ্জের কিছু কর্মকর্তা আর ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের সাথে বিভিন্ন পদ নিয়ে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন এমন ব্যক্তিরাই তাঁদের এই পরামর্শ বাস্তবায়নের কাজে যুক্ত হন।

তাঁরা দুটো কর্মের ব্যাপারে একমত হন , কোন না কোনভাবে আওয়ামীলীগের সাথে সম্পর্কিত নেই , এমন কাউকে পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ পদে রাখা যাবে না। প্রয়োজনে ওএসডি, বিদায়, প্রমোশন বঞ্চিত করা বা একেবারে অগুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বদলি। কনষ্টবল থেকে এ এস পি পর্যন্ত নতুন রিক্রুটে যথাসম্ভব আওয়ামী সমর্থক নিয়োগ করতে হবে, বি এন পি বা জামাত ফ্যামেলির কেউ বা এমন রাজনীতি করেছে ছাত্র জীবনে তাদের পুরো বর্জন করতে হবে। নিরপেক্ষ যারা আসবে তাদের দ্রুত মগজ ধোলাই করে আওয়ামী স্রোতে সম্পৃক্ত করতে হবে।

ক্ষমতায় আসার পর ঢাকার হৃদরোগ ইনষ্টিটিউট সংলগ্ন তোফায়েল ব্যাচের এক বিতর্কিত অফিসারের বাসভবনে এক বৈঠক হয় , সেখানেই কর্মরত অফিসারদের নানান তকমা লাগিয়ে এক খসড়া তালিকা করা হয় এবং আওয়ামিলীগ অনুগত কর্মকর্তাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। সেই বিতর্কিত কর্মকর্তাকে পরে একটি রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থায় গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়। এই অফিসারই পরে বিখ্যাত আরেক ‘রাজনৈতিক মামলা তদন্তকারী’ কে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের নামে বি এন পি আমলের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরকে সি আই ডি অফিসে শারীরিকভাবে লাঞ্চিত করে পৈশাচিক আনন্দ নেন। পেশাদার পুলিশ কখনো অপরাধীকে মারধর করে না , তথ্য বের করার নানান পথ আছে, সে তাদের জানা থাকার কথা। সেই গুরুত্বপূর্ণ তদন্তকারী কর্মকর্তা ৭ বছর অতিরিক্ত চাকুরী করেন এবং অবিশ্বাস্য গতিতে প্রমোশনও বাগিয়ে নেন। পেশাদারিত্ব নয় এগ্রেসিভ মানসিকতা প্রদর্শন , আওয়ামী সংশ্লেষ প্রমাণ আর বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের হয়রানি করাই ক্রমান্বয়ে হয়ে পড়ে পুলিশ অফিসারদের উপরে উঠার সিঁড়ি।

যা হোক, শেখ হাসিনার এই আমলের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের মিন্টুরোডের সরকারি বাসায় প্রত্যেক বি সি এস পুলিশ ব্যাচের দুয়েকজন করে বিশ্বস্থ প্রতিনিধি নিয়ে পরবর্তী বৈঠক হয়। সেখানে ছিল গোপালগঞ্জ নিবাসী বেশ কিছু কর্মকর্তা, সাথে পূর্বে বিভিন্ন শিক্ষাংগনে পূর্বে ছাত্রলীগ করা কতিপয় কর্মকর্তা। তারা ব্যাচ ওয়াইজ আওয়ামীলীগ, বি এন পি , জামাত এই মর্মে সকল অফিসারদের চিহ্নিত করে। তারা নামের পাশে এক, দুই, তিন স্টার বসায়। চাকরি থেকে বের করে দেয়া, আর প্রমোশন না দেয়া, ঢাকায় ঢুকতে না দেয়া, কম গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন , ইউ এন মিশনে যেতে না দেয়া, বিদেশে প্রশিক্ষণের সুযোগ না দেয়া , গতিবিধি লক্ষ্য করা ইত্যাদি নানান মতামত চিহ্নিত অফিসারদের পাশে নোট করে রাখে। সাহারা খাতুন তা অনুমোদন করেন এবং প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর , পুলিশ সদরসহ নানান গোয়েন্দা সংস্থার দপ্তরে সে তালিকা পাঠিয়ে দেয়া হয়। পুলিশ সদর দপ্তরের সিনিয়র কর্মকর্তারা তা বাস্তবায়ন শুরু করে দেন তাৎক্ষনিক। অস্বাভাবিক লবিং এবং টাকা পয়সা খরচ করে একেবারে গুটিকয় অফিসার সে তালিকা থেকে বের হয়ে আসেন ।

স্বীয় স্বার্থে শেখ হাসিনার পুলিশকে এই সীমাহীন রাজনীতিকরণ শুরু করেন। তিনি জানতেন ১৯৯৬ সনের মত আর তত্তাবধায়ক সরকারের রিস্ক নেয়া যাবে না। মিলিটারি , নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন বা বিচারবিভাগ কেউই অনাচার করে তাকে ইলেকশনে জিতিয়ে আনবে না বা আনার স্কোপ নেই। পুলিশই একমাত্র ভরসা। তিনি তার সুফল পেয়েছেন।২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সনে , পুলিশ ,হ্যাঁ একমাত্র পুলিশই তাকে ইলেকশনে জিতিয়ে এনেছে। আই জি পি থেকে শুরু করে চিহ্নিত উর্ধতন অফিসাররা কিভাবে নির্লজ্জ হয়ে দলের হয়ে কাজ করেছেন, মিথ্যাচার করেছেন , নানান সুবিধাদি নিয়েছেন তা সে সময়ের মিডিয়া দেখলেই স্পষ্ট হবে। কি প্রক্রিয়ায় তল্পিবাহকরা সেটা সম্পন্ন করেছেন , সে এক ভিন্ন ইতিহাস, যা দেশের বিবেকবান আর সচেতন মানুষ বেদনার সাথে প্রত্যক্ষ করেছেন।

তা হাসিনা কোন ধরণের অফিসারদের ঘাড়ে সওয়ার হয়েছেন? ১. বৃহত্তর ফরিদপুর এবং কিশোরগঞ্জের অধিবাসী ২. ছাত্রলীগ-করা বা আওয়ামী পরিবারের সদস্য ৩. পূর্বে শৃংখলা ভংগের জন্য চাকুরিচ্যুত কিন্তু আওয়ামী আমলে ফিরে পাওয়া ব্যক্তি ৪. সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অফিসার ( তাঁরা অনেকেই ভাল অফিসার কিন্তু নিজ স্বার্থে হাসিনা তাদের কাছে টেনেছেন) ৫. কূটকৌশল বাস্তবায়নে সূক্ষ্ণবুদ্ধির অফিসার ( পরিকল্পনা প্রনয়ন, রিপোর্ট প্রনয়ন, জনবল বৃদ্ধির কৌশল, ডেপ্লয়মেন্ট প্ল্যান করা , জংগীসহ নানান নাটক সাজানো, গুম খুন ক্রসফায়ারে ইত্যাদিতে পারদর্শী) ৬. মেধা নয় পদলেহন যাদের কর্ম, ধরে আনতে বললে বেঁধে আনে টাইপ অফিসার।

তা যাদেরকে বাছাই করা হয়েছে তারা সবাই কি সবসময় উপরে থাকতে পেরেছে? যোগ্যতার প্রমাণ না দিতে পারলে তারা উপরে থাকতে পারেননি, নীচের দিকে গেছেন। তা কি সে যোগ্যতা? বি এন পি জামাতের কর্মীদের দৌড়ের উপর রাখতে হবে, তাদের সাথে এগ্রেসিভ আচরণ করতে হবে, কাজের পরিধির মধ্যে পড়লে মামলার পর মামলা রুজু করতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজের আওয়ামীপ্রীতি স্পষ্ট করতে হবে। মাজারে বা বিশেষ ছবিতে নিয়মিত পুষ্পার্ঘ দিতে হবে। আওয়ামীলীগ এবং এর অংগ সংগঠনের নেতাদের সাথে সদভাব রাখতে হবে এবং তাদের সাত খুন মাপ করার হিম্মত থাকতে হবে। চিহ্নিত তারকা পুলিশ অফিসার যারা ‘সুপার কপ’ অভিধা দেয়া যায়, তাদের দরবারে নিয়মিত হাজিরা দিতে হবে, লেহন করতে হবে। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে উর্ধতনদের উৎকোচ দিতে হবে।

বিনিময়ে কি পাবেন অফিসাররা? প্রথমত সীমাহীন দুর্নীতি করার লাইসেন্স। তারপর কাঙ্খিত পদায়ন, প্রমোশন , বীরত্বসূচক পদক, সরকারী কোষাগার থেকে আর্থিক উপঢৌকন , চাকুরির বিধিবিধান উপেক্ষার সুযোগ , সাধারণ অফিসার ( সিনিয়র হলেও) দের উপর নিয়ন্ত্রণ , নানান রকম কেচ্ছাকাহিনী সাজিয়ে অপারেশনের নামে নিজের বীরত্বগাঁথা সাজানো , নিজ সরকারি দপ্তরকে এলাকা কেন্দ্রিক রাজনৈতিক অফিস হিসেবে ব্যবহার, মিডিয়া কিংবা নাগরিকের আনা সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়া, দৃশ্যমান সম্পদের পাহাড় জমালেও তা ধর্তব্যে না নেয়া এবং ঘন ঘন বিদেশ ভ্রমণ। কর্তাদের এর বাইরে আর কি চাই? বাধ্য হয়ে অধিকাংশ অফিসার এই গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসান। এই অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতায় পড়ে পুলিশ সদস্যরা ক্রমাগত হয়ে পড়ে অতি উৎসাহী ।

গত ১৫ বছর পুলিশের আইজিপির তেমন কোন ক্ষমতা ছিল না, তা কুক্ষিগত ছিল গুটিকয় সুপার কপের তৈরি করা সিন্ডিকেটর কাছে। তার সাথে যোগ দিয়েছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিহ্নিত কয়েকজন ছোটবড় আমলা যারা ছিল মূলত নিজের এবং মন্ত্রীর চাঁদা কালেক্টর এবং পুলিশের উপর ছড়িঘুরানেওয়ালা ( যার স্বাদই আলাদা! )। দক্ষিণাঞ্চলের এক আই জি পি এবং গোপালগঞ্জ , সুনামগঞ্জ আর কিশোরগঞ্জের বিখ্যাত কতিপয় কর্মকর্তা তাদের বাবা-মার নামে ফাউন্ডেশন খুলে তাতে পুলিশ অ-পুলিশ সদস্যদের থেকে দেদারসে প্রকাশ্যে চাঁদা তুলেছেন। দেশের বাড়িতে তারা স্কুল কলেজ মাদ্রাসা হাসপাতাল তৈরি করেছেন। সেই আই জি পি-র ফাউন্ডেশনে অফিসাররা ৫ থেকে ২৫ লাখ টাকা করে জমা দিয়েছেন। আমি এক মোটামুটি সৎ জীবন যাপন করা ডি আই জি-কে চিনি যিনি তাঁর প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা তুলে সেই আই জি পি-র ফাউন্ডেশনের একাউন্টে টাকা জমা দিয়েছেন, নইলে আসন্ন প্রমোশন তালিকায় তার নাম থাকবে না, এই ভয়ে। সেই মহান আই জি পি আত্মপ্রশংসা আর মিথ্যার বেসাতিতে ভরা এক আত্মজীবনীও লিখে ফেলেছেন! আই জি পির দর্শনার্থীর সংখ্যার চেয়ে বহুগুন বেশী দর্শনার্থী ছিল সুপার কপদের অফিসে। যারাই গেছেন পুলিশ সদরে তারাই সে দৃশ্য দেখেছেন।উত্তর বংগের এক আই জি পি তো তার কক্ষে গুটিকয় অতি জুনিয়র সুপার কপকে অফিসে বসিয়ে তোয়াজ করতেন, উদ্দেশ্য চেয়ারটা যেন ঠিক থাকে। সে নিয়ে হাসাহাসি হত পর্দার অন্তরালে।

পুলিশের স্বাধীনভাবে ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে সবচে স্বর্ণযুগ গেছে ২০০৬ সনে দুই বছরের জন্য আসা তত্ববধায়ক সরকারের সময়। রাজনৈতিক ছত্রছায়া না থাকায় পুলিশ কর্তারা নিজেদের ক্ষমতা পুরোদমে এক্সারসাইজ করতে পেরেছেন। এই সুযোগে কেউ কেউ যেমন বাহিনী পুনর্গঠনের মত শুভ কাজে ব্যস্ত ছিলেন ,কেউ কেউ ব্যস্ত ছিলেন অবৈধ অর্থ উপার্জনে, ধমক দেয়ার কেউ ছিলেন না, সুযোগ বলে কথা! আই জি পি-র অফিস কক্ষের কাছে বসা এক সিনিয়র কর্মকর্তার দেদারসে ঘুষ গ্রহণের কাহিনী তখন পুলিশের মুখে মুখে ফিরতো।

গত ১৫ বছরে ১ লাখ ১৫ হাজার পুলিশ সদস্য নেয়া হয়। তার মাঝে নিম্নতন পদে প্রায় বিনাবাধায় ১৩ বছর ধরে দলীয় লোক ভর্তি করার পাকা লাইসেন্স দিয়ে দেয়া হয়। কাদের ভর্তি করা হয়? কয়েকটি গ্রুপকে ন্যুনতম যোগ্যতায় প্রায় বিনা প্রশ্নে নেয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান , আওয়ামী পরিবারের সন্তান, ছাত্রলীগ, সংখ্যালঘু (সম্মানের সাথে বলি তাঁরা সে বিশেষ সুযোগ প্রার্থনা করেনি)। বি এন পি কিংবা জামাত রাজনীতি করেন এমন কোন পরিবারের সন্তান ধারেকাছেও আসতে পারেনি।কিছু অরাজনৈতিক পরিবারের সন্তানদের নেয়া হয়। তা কিভাবে উপরোক্তদের নেয়া হয়েছে? সংশ্লিষ্ট এলাকার দলীয় এম পি , জেলার পুলিশ সুপার এবং ‘সুপার কপ’ দের লোক নির্বাচনের পুরো দায়িত্ব দেয়া হয়। অধিকাংশ ছেলেমেয়েরা ৩ থেকে ১৫ লক্ষ টাকা ঘুষ দিয়ে কনষ্টেবলের চাকুরিতে ঢুকে। সে টাকা কারা নিয়েছে তা সহজে বোধগম্য।ঘুষদাতা বেশী হয়ে যাওয়ায় আমার চেনা এক এম পি সাহেব তার গ্রামের বাড়িতে পুলিশে ভর্তিচ্ছুদের এক লিখিত পরীক্ষা নেয়। তিনি তাঁর নির্দিষ্ট কোটা রেখে বাকিদের টাকা ফিরিয়ে দেন।

চরম বদনাম ঠেকানোর জন্য শেষের ২ বছর রিক্রুটমেন্টের অনিয়মে কিছুটা লাগাম ধরা হয়। সেখানেও সূক্ষ্ণ কারচুপি। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর তালিকা গোপন রেখে জেলা পুলিশ সুপার চুপিচুপি প্রার্থীর ভেরিফিকেশন সারতেন, দলীয় পরিচিতি নিশ্চিত হবার পরেই চূড়ান্ত উত্তীর্ণ তালিকা প্রকাশ করা হত।এর বাইরে বিভিন্ন জেলায় অনুত্তীর্ণ প্রার্থীর কোটায় মিথ্যা পরিচয়ে গোপালগঞ্জ বা তার পার্শ্ববর্তী জেলার লোক ভর্তি করা হয় , পুলিশের কতিপয় সুপার কপ তা দেখভাল করেন।

বিরুদ্ধ মত শায়েস্তা করার জন্য আওয়ামী পুলিশকে দেয়া হয় কতিপয় অস্ত্র। কন্ঠরোধ করার জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মত বেশকিছু কড়া আইন, জংগী নাটক কিংবা সেরকম স্পেকুলেশন থেকে লোক মেরে ফেলা বা আটক করার ক্ষমতা, যেকোন রাজনৈতিক সমাবেশ ভেংগে দেয়া এবং তাতে অংশগ্রহণকারীদের গ্রেফতারের ক্ষমতা, গুম-খুন-ক্রসফায়ারের ক্ষমতা ( দেশী বিদেশী চাপে তার ধারা কিছুটা সীমিত হয় শেষের দিকে), যখন তখন মিথ্যা মামলা সাজানোর ক্ষমতা, তল্লাশী বা বাড়ি বাড়ি হানা দিয়ে রাজনৈতিক কর্মীদের হয়রানি করা , সমর্থন করছেন না এমন সহকর্মীদের বি এন পি জামাত তকমা দিয়ে একঘরে করে রেখে তাদের নিষ্ক্রিয় করা , স্থানীয় বা জাতীয় নির্বাচনে ইচ্ছেমত সরকারি দলের পক্ষে প্রভাব কাটানোর কালচার লালন, দলীয় কর্মীদের যে কোন অভিযানে সংগে রাখা ইত্যাদি।

ডিএমপির এক চরম দলবাজ আলোচিত কমিশনার তার অফিসারদের সংগে মতবিনিময় সভায় আবিষ্কার করে বসলেন এক বিস্ফোরক শব্দযুগল , গায়েবী মামলা। কোথাও কোন ঘটনা ঘটেনি, কিন্তু তার কাহিনী বানিয়ে এজাহার করা হবে এবং আসামী করা হবে নামে বেনামের অসংখ্য লোকজন। এই অস্ত্র দলীয় পুলিশের মাঝে পেয়ে যায় বিপুল জনপ্রিয়তা, চলতে থাকে তার সীমাহীন চর্চা। বিরুদ্ধ মতের রাজনৈতিক কর্মীদের বিরুদ্ধে দুই লক্ষের উপর গায়েবী এবং মিথ্যে মামলা দায়ের করা হয়েছে গত ১৫ বছরে। পুলিশী রাষ্ট্র আর কাকে বলে!

সরকারি চাকুরিতে সংরক্ষিত কোটা নিয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নির্বিচার গুলিবর্ষণ এবং নির্যাতন পুলিশের গত ১৫ বছরে লালিত কালচারেরই সর্বোচ্চ প্রয়োগ।এমন বিপুল প্রাণহানির ঘটনা এবং বর্বরতা অতীতের সকল রেকর্ড ছাপিয়ে গেছে।

পরাক্রমশালী রাজনীতিক আর পুলিশের সুপার কপরা পুলিশকে পরিচিত করেছে পুলিশলীগ হিসেবে। পুলিশে প্রমোশনে যাচ্ছেতাই করা হয়েছে, সার্ভিস রুলসে স্পষ্ট লেখা আছে কারা কারা কি শর্তে কখন প্রমোশন পাবে। সেসব বিধান টয়লেট পেপারের মত কমোডে ফেলে ফ্ল্যাশ করে দেয়া হয়। সিনিয়রিটি ভেংগে ইচ্ছেমত পছন্দের অফিসারকে প্রমোশন দেয়া হয়েছে। এর কোন ব্যাখ্যা নেই, কৈফিয়ত নেই।সহজ হিসাব, আওয়ামীলীগ প্রমাণে ব্যর্থ হলে প্রমোশন নেই।অফিসার আর ফোর্স বেপরোয়া হয়ে উঠে প্রমোশনের দৌড়ে জেতার জন্য।

গুরুত্বপূর্ণ আর ঘুষের জায়গায় পদায়নে আরেক ভিন্ন নোংরা প্রতিযোগিতা তৈরি হয়। অভিজ্ঞতা , কর্মউদ্যোগ , সততা বা প্রজ্ঞা নয় ,এক্ষেত্রেও দলীয় লেজুড়বৃত্তি, সুপারকপদের ভোট আর ক্ষেত্রবিশেষে আর্থিক লেনদেন হয়ে উঠে প্রধান নিয়ামক। প্রয়োজনের অতিরিক্ত পদসৃষ্টি করা হয়েছে। প্রায় চার হাজার ইন্সপেক্টরের মধ্যে মাত্র ৫০০ মত ওসি হতে পারেন, প্রায় ৭০০ এর মত এস পি র মধ্যে ৬৪ জন জেলা এসপি হতে পারেন। বাকিরা একেবারে গুরুত্বহীন আর কর্মহীন পদে কাজ করেন। শুরু হয় অসুস্থ প্রতিযোগিতা। এক্ষেত্রেও রাজনৈতিক পরিচয় আর টাকা হয়ে উঠে প্রধান যোগ্যতা। গত তিন নির্বাচনেই জেলা এস পি এবং মেট্রোপলিটন কমিশনারদের প্রতিজনকে কোটি টাকার উপর উৎকোচ দেয়া হয়েছে। নির্বাচনে দায়িত্বপালনের জন্য কষ্টবল থেকে উপর পর্যন্ত সকল অফিসারকে টাকা দেয়া হয়েছে , তাদের নিয়মিত টিএডিএ-র বাইরে। ২০১৩ এর নির্বাচনের পর থেকে প্রত্যেক অফিসারকে মাসে মাসে নানাভাবে উপঢৌকন দেয়ার রেওয়াজ চালু হয়েছে।অন্তর্বাস থেকে শুরু করে ঘর গেরস্থালির যাবতীয় সামগ্রী ও পোষাক ফ্রি দেয়া শুরু হয় একই সময় থেকে। দেয়া শুরু হয় অফিসার ও ফোর্সের আজীবন রেশন।এসবই শেখ হাসিনার আশীর্বাদ ও আদর হিসেবে প্রচার করে সুপার কপরা , হাসিনা তথা আওয়ামিলীগকে ক্ষমতায় রাখতেই হবে এসব সুবিধা অব্যাহত রাখার জন্য। এভাবেই পুলিশ নামের সংগঠনটি হয়ে উঠে আওয়ামী পুলিশ। জনতার পুলিশ বিদেয় হয়। মানসিকতা এমন জায়গায় নিয়েছে যে বলপ্রয়োগের সাধারণ বিধান ভুলে পুলিশ লাশ ফেলানোর উন্মত্তায় মেতেছিল। হাসিনাকে রাখতেই হবে ক্ষমতায়। পরিণতি যা হবার হয়েছে। জনরোষে পুড়েছে দল আওয়ামীলীগের সাথে পুলিশও। বীভৎস মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছে নিমপদস্থ হুকুম তামিলকারী পুলিশ। সেই সুপার কপরা চেয়ার ছেড়ে গেছেন পালিয়ে, তাদের টিকিটিও পাওয়া যায় নি। এখন ধরা না পড়লেও তাদের আইনের হাত থেকে বাঁচার কোন উপায় দেখছি না, জবাব দিতেই হবে।

পুলিশ যতই তওবা করুক , পুলিশকে রাজনীতিকরনের বিদ্যমান সুযোগ রহিত না করলে এই চর্চার আবার উথথান ঘটার আশংকা থেকেই যাবে। শুধু পোষাক পরিবর্তন করে লাভ হবে না, হয়ত কারো ঢিল ছোঁড়া থেকে রক্ষা পাবেন মাত্র। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তালাবদ্ধ ধুলি-পড়া বহুল আলোচিত ‘ পুলিশ রিফর্ম প্রোগ্রাম’ এর সুপারিশ মালা বের করুন। ইউ এন ডি পি আর ইউ কে সরকারের অর্থায়নে প্রয়াত এ এস এম শাহজাহানের নেতৃত্বে সেই প্রোগ্রামের আওতায় তৈরি করা প্রস্তাবের বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবী। সাধারণ জনগণ, সুধীজন, দেশী বিদেশী বিশেষজ্ঞ, পুলিশ সদস্যসহ অংশীজনদের মতামতের ভিত্তিতে বছরের পর বছর ধরে কাজ করে সে সুপারিশ তৈরি করা। পুলিশের জবাবদিহিতা , অভিযোগ , নিয়োগ, বদলি, প্রমোশন নিয়ে দু’টি পৃথক স্বাধীন কমিশন করার কথা আছে তাতে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা দলবাজ আমলা নয়, স্বাধীন কমিশনের আওতায় কাজ করবে পুলিশ।

রাজনীতিক আর পুলিশের পিরীতি ভাংগতে হবে। ফিরিয়ে আনতে হবে পেশাদারিত্ব। সার্ভিস রুলস , পি আর বি , অন্যান্য আইনে বিধৃত পুলিশের দায়িত্ব , কর্তব্য এবং বলপ্রয়োগের বিধান কড়াকড়ি মানতে হবে। এ বিষয়ে সব স্পষ্ট আছে, নতুন আইনের দরকার নেই। ক্যারিয়ার প্ল্যান থাকবে অর্থাৎ কখন কি শর্তে , প্রমোশন আর বদলি হবে তার সুস্পষ্ট পথরেখা থাকতে হবে অফিসার আর ফোর্সের সামনে, তদবির আর অনুগ্রহের প্রয়োজন হবে না। পুলিশে আইডল হিসেবে সামনে রাখতে হবে অভিজ্ঞ ও সফল তদন্তকারী , মানবিক পুলিশ, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যারা শ্রম আর উদ্ভাবন দিয়ে সফল হবেন ,তারা। বেনজির-হারুন-বিপ্লব- আসাদ- মনিরুল গং পুলিশের আইডল হবেন না।

রাজনৈতিক পক্ষপাত প্রকাশ্যে এনে কথা বললে, সম্মানিত ব্যক্তিদের নাজেহাল করলে, অন্যায় সুবিধা নিলে , তাদের সাথে সাথে প্রতিহত করতে হবে, বিধানমতে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।পদক, পদায়ন , পুরস্কার ইত্যাদি শুধুমাত্র সফল পেশাদার পুলিশ সদস্যদের জন্য। একই অফিসারের ২/৩ বছরের বেশী গুরুত্বপূর্ণ পদে রাখা যাবে না, নির্দিষ্ট সময় পর কম গুরুত্বপূর্ণ পদে বদলি নিশ্চিত করতে হবে। কোন অফিসারকেই অনিবার্য হতে দেয়া যাবে না।বেপরোয়াদের ছেঁটে ফেলুন।

পেশাদার, জনবান্ধব আর দলনিরপেক্ষ পুলিশ না পেলে আগষ্ট বিপ্লবের পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে। তীব্র জনরোষে পড়ে পুলিশের পুনরায় ক্ষতবিক্ষত হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যাবে।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *