■ বিশেষ প্রতিবেদন ■
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির বিপরীতে ইসলামপন্থি ও উদার মধ্যপন্থি দলগুলোর মধ্যে একটা ‘সমঝোতায়’ পৌঁছার জন্য জোর তৎপরতা চলছে। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার ঠিক আগে বা পরে ‘বাংলাদেশ জোট’ গঠনের ঘোষণা আসতে পারে।
উদার মধ্যপন্থিদের জোটে এনসিপি (জাতীয় নাগরিক পার্টি) ছাড়াও আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন এবং গণঅধিকার পরিষদের থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। অন্যদিকে ইসলামপন্থিদের মধ্যে জোটে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে জামায়াতে ইসলামী, চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত মজলিস, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন ও নেজামে ইসলাম পার্টির। তবে এখনো কোনো জোটই চূড়ান্ত হয়নি। এ ব্যাপারে আলোচনা প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। আলোচনার একপর্যায়ে এই দুই জোট যদি বিএনপির বিরুদ্ধে এক হয়, তাহলে গঠন হবে নতুন জোট। সে ক্ষেত্রে এই জোটের সম্ভাব্য নাম হতে পারে ‘বাংলাদেশ জোট’। ইতোমধ্যে দলগুলোর মধ্যে সম্ভাব্য নাম নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে ইসলামপন্থিসহ সব দলের যোগাযোগ ও সুসম্পর্ক রয়েছে। সমঝোতা করেই নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। নানা ধরনের কথাবার্তা বা পর্যবেক্ষণ শোনা যাচ্ছে। তবে জোট হবে কি না, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর বোঝা যাবে।’
জানা গেছে, ভোটের আনুপাতিক হারে আসন বণ্টন পদ্ধতিতে (পিআর পদ্ধতি) সংসদ নির্বাচন হলে সব আসনে একক প্রার্থী দেওয়া এবং ভোটের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিএনপির বিকল্প শক্তি হিসেবে দাঁড়ানোর লক্ষ্য নিয়েই এসব দল সক্রিয় হচ্ছে।
সংবিধান সংশোধন, পিআর পদ্ধতিতে সংসদ নির্বাচন, জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনসহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু রাষ্ট্র সংস্কার প্রশ্নেও এসব দলের অধিকাংশের অবস্থান প্রায় এক। গত ২৮ জুন রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পিআর পদ্ধতিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে ইসলামী আন্দোলনের মহাসমাবেশে জামায়াত, এনসিপি, এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদসহ জোট গঠনের প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকা দলগুলোর শীর্ষ নেতারা একমঞ্চে যোগ দেন। সমাবেশে কয়েকটি দলের নেতাদের বক্তব্যে নির্বাচনে জোটবদ্ধভাবে অংশ নেওয়ার কথা প্রকাশ পায়। আগামী ১৯ জুলাই শনিবার জামায়াতে ইসলামীর জাতীয় সমাবেশে এসব দলের শীর্ষ নেতাদের মঞ্চে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। নির্বাচন সামনে রেখে ইসলামপন্থি ও উদার মধ্যপন্থি দলগুলোর একমঞ্চে আসার বিষয়টিকে জোট গঠনের প্রাক-প্রস্তুতি হিসেবেও দেখা হচ্ছে।
এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ‘নির্বাচনের জোট গঠনের ব্যাপারে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা হয়নি। আলোচনা অনানুষ্ঠানিক পর্যায়ে আছে। নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পর জোট গঠনের ব্যাপারে আলোচনার সম্ভাবনা রয়েছে।’
ইসলামপন্থিদের ভোট ‘এক বাক্সে’ আনার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে চরমোনাই পীরের নেতৃত্বে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক পাঁচটি দল একমত হয়েছে। দলগুলো হলো বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও নেজামে ইসলাম পার্টি। এই জোটে খেলাফত আন্দোলন ও ইসলামী ঐক্যজোটকে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত হয়েছে।
ইতোমধ্যে প্রতিটি দল থেকে দুজনকে নিয়ে ১০ সদস্য একটি লিয়াজোঁ কমিটি গঠিত হয়েছে। এই কমিটিতে রয়েছেন ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব মাওলানা ইউনুস আহমাদ, যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা জালালুদ্দীন আহমদ, যুগ্ম মহাসচিব আতাউল্লাহ আমিনী, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমদ আব্দুল কাদের ও যুগ্ম মহাসচিব জাহাঙ্গীর হোসাইন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী, সহসভাপতি মাওলানা আব্দুর রব ইউসূফী এবং নেজামে ইসলাম পার্টির সহসভাপতি মাওলানা আব্দুল মাজেদ আতহারি, মহাসচিব মুসা বিন ইজহার।
সম্ভাব্য এই জোটে জামায়াতে ইসলামী যুক্ত করার জন্য প্রাথমিকভাবে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনা চলছে। এরই অংশ হিসেবে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান এবং চরমোনাই পীর একাধিকবার বৈঠকও করেছেন। ঐকমত্য হলে রাজনৈতিক সমঝোতায় আসন বণ্টন করেই নির্বাচনে অংশ নেবে দলগুলো। জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন ছাড়া বাকি দলগুলো হেফাজতের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। ফলে হেফাজতে ইসলামের সমর্থন ও তাদের ভোট এই জোটে যাবে।
ইসলামী আন্দোলনের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বলেন, ‘এনসিপি নতুন বাংলাদেশের প্রত্যাশা নিয়ে এগোচ্ছে। তাদের নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদের পতন হয়েছে। ফলে তাদের সঙ্গে আমাদের ভালো বোঝাপড়া ও যোগাযোগ রয়েছে। তবে এনসিপিকে জোটে দেখা যাবে কি না, সেটি সময়ই বলে দেবে।’
তিনি বলেন, ‘ইসলামপন্থি দলগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতার চেষ্টা চলছে। মানুষ বিকল্প শক্তিকে ক্ষমতায় দেখতে চায়। সে জন্য সবাই একজোট হতে চাইছে। আগামী নির্বাচনে ইসলামপন্থিদের প্রতিটি আসনে একক প্রার্থী থাকবে। নির্বাচনের সময় এলে বড় কোনো জোট হবে কি না, তা দেখা যাবে।’
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব জালালুদ্দীন আহমদ বলেন, ‘ইতোমধ্যে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে। লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠক হয়েছে। তবে জামায়াতে ইসলামীকে নেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন সিনিয়র নেতারা।’
তিনি জানান, নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এলে জোটের পরিধি বাড়বে। কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক দলগুলো এক হওয়ার পরই বৃহত্তর ঐক্য গড়ার চেষ্টা হবে। সেখানে শুধু ইসলামি দলগুলো নয়, অন্য দলকেও জোটে দেখা যেতে পারে।
এনসিপি ও এবি পার্টিসহ কয়েকটি দলের নেতৃত্বে নির্বাচনের আগে আসতে পারে উদার মধ্যপন্থিদের বড় জোট। দলগুলো জোট করেই নির্বাচনে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেবে। এই জোটে গণসংহতি আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদ, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, বিএনপিবিরোধী বলে পরিচিত রাজনৈতিক দলের নেতা ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের মনোনয়ন দিয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হতে পারে।
গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকী বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে জোট গঠনের বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। তবে নির্বাচন হতে এখনো অনেক দেরি।’
এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, ‘জোট না একক- কোন পদ্ধতিতে নির্বাচনে অংশ নেব তা চূড়ান্ত হয়নি। আপাতত আমরা দলকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে সাংগঠনিক কাজে মনোযোগ দিয়েছি। তারই অংশ হিসেবে আমরা জেলা সফর শুরু করেছি এবং দলকে সাধারণ জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর চেষ্টা করছি।’
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, ‘নির্বাচনের জোট করার ব্যাপারে এখনো আলোচনা হয়নি। আমরা আপতত ৩০০ আসনে নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। তফসিল ঘোষণার পর জোট গঠনের আলাপ-আলোচনা হতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ও বোঝাপড়া থাকা জরুরি। ফ্যাসিবাদীবিরোধী আন্দোলনের অংশ নেওয়া দলগুলোর মধ্যে দা-কুড়াল সম্পর্ক হলে আগামীর নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। আমরা চাই সব দলের মধ্যে সুসম্পর্কের মধ্য দিয়েই গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে উঠুক।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই দলগুলো জোট করলে ৮০ থেকে ১০০ আসনে জয়লাভ করতে পারে। কারণ প্রতিটি আসনে তাদের নিবেদিতপ্রাণ নেতা-কর্মী রয়েছেন। প্রতিটি আসনে ১০০-এর মতো ভোটকেন্দ্র রয়েছে। নির্বাচন পরিচালনা করতে আসনপ্রতি কমপক্ষে ১৩ হাজার লোক দরকার। সেটাও দলগুলো পেয়ে যাবে। এর ফলে সংসদে ও মাঠে বিএনপিকে চাপে রাখতে পারবে। মানুষ মুসলিম লীগের মতো আস্তে আস্তে আওয়ামী লীগকেও ছেড়ে দেবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী বলেন, ‘ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিস, এবি পার্টিসহ অন্য দলগুলো মিলে একটা মোর্চা করতে পারে। তবে এই মোর্চার সঙ্গে জামায়াত থাকবে কি না, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। এই মোর্চা যদি ৫০ থেকে ৬০টি আসন পায়, তাহলে তারা একটা বড় বিরোধী শক্তি হিসেবে পার্লামেন্টে থাকবে। তারা পার্লামেন্টে অনেক ভূমিকা রাখতে পারবে। এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে, সেই সমীকরণের দিকে যাচ্ছে। তাহলেই ক্ষমতার মধ্যে একটা চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স আসবে।’