সাবেক সেনাসদস্যদের বিক্ষোভ ও সেনাবাহিনীর অবস্থান

■ নাগরিক প্রতিবেদন ■ 

জাতীয় প্রেসক্লাব চত্বরে রোববার কতিপয় বরখাস্ত/অব্যাহতিপ্রাপ্ত সাবেক সেনাসদস্যরা তাদের চাকরিতে পুনর্বহাল, শাস্তি মওকুফ ও আর্থিক ক্ষতিপূরণসহ বিভিন্ন দাবি নিয়ে বিক্ষোভ এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমে বক্তব্য প্রদান করেন। শান্তিপূর্ণ সমাধানের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি প্রতিনিধি দল জাতীয় প্রেসক্লাবে গমন করেন এবং অত্যন্ত ধৈর্য ও আন্তরিকতার সঙ্গে তাদের বক্তব্য শোনেন।

প্রতিনিধি দল সেনাবাহিনীর প্রচলিত বিধি-বিধান অনুসারে দাবি-দাওয়া যাচাই ও সমাধানে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস দেন। একইসঙ্গে অভিযোগগুলো কোনো তৃতীয় পক্ষ বা প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে না পাঠিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে সরাসরি উপস্থাপনের পরামর্শ দেন।

রোববার (১৮ মে) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানিয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর)।

উল্লেখ্য, গত ১৪ মে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয় এ ধরনের মোট ৮০২টি আবেদন গৃহীত হয়েছে, যার মধ্যে ১০৬টি আবেদন নিষ্পত্তি হয়েছে এবং বাকি আবেদনগুলো প্রক্রিয়াধীন রয়েছে‌ যা সেনাবাহিনী সর্বোচ্চ আন্তরিকতা ও মানবিকতার সঙ্গে বিবেচনা করছে।

আইএসপিআর আরও জানায়, তবে দুঃখজনক যে, আজকের কিছু অনভিপ্রেত আচরণ এই সুশৃঙ্খল বাহিনীর ঐতিহ্য ও মূল্যবোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। পরপর দুবার সফল বৈঠক শেষে, প্রতিনিধি দল ফেরত যাওয়ার সময় কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল বরখাস্ত সেনা সদস্যদের উস্কানিতে উক্ত প্রতিনিধি দলের গাড়ির সম্মুখে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ এবং অশ্রাব্য ভাষায় স্লোগান দেওয়া হয়।

সমগ্র দিন জুড়ে সেনাবাহিনী সর্বোচ্চ ধৈর্য ও সহমর্মিতার সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালালেও এক পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিছু সংখ্যক বিশৃঙ্খল সাবেক সদস্যকে ছত্রভঙ্গ করতে বাধ্য হয়।

যেকোনো ধরনের উসকানিমূলক কার্যকলাপ, জনস্বার্থবিরোধী আচরণ কিংবা বাহিনীর সুনাম ক্ষুণ্ন করতে পারে— এমন কর্মকাণ্ড কখনোই কাম্য নয়। সব ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী অত্যন্ত ধৈর্য, সহমর্মিতা এবং সংবেদনশীলতার সঙ্গে বিষয়টি বিবেচনা করছে। সাংবিধানিক কাঠামো ও শৃঙ্খলার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে দায়িত্বশীল আচরণ করার জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পুনরায় সবার প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছে।

সেনা কর্মকর্তাদের আশ্বাসে কর্মসূচি স্থগিত

চাকরি ফিরে পাওয়াসহ চার দফা দাবিতে রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে দিনভর বিক্ষোভ শেষে আজ রোববার সন্ধ্যায় কর্মসূচি স্থগিত করেছেন বিভিন্ন সময় সশস্ত্র বাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত হওয়া একদল ব্যক্তি। দুই দফা বৈঠক শেষে সন্ধ্যা সোয়া ছয়টার দিকে তাঁরা কর্মসূচি স্থগিতের ঘোষণা দেন।

আন্দোলনকারীরা জানিয়েছেন, সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাঁদের দাবিগুলো শুনেছেন। দাবিগুলো মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। তাঁরা আশ্বস্ত হয়ে আন্দোলন আপাতত স্থগিত করেছেন। এ বিষয়ে আগামীকাল সোমবার তাঁরা একটি বিবৃতি দিয়ে পরবর্তী করণীয় বিষয়ে জানাবেন।

এদিকে আলোচনা শেষে সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জাতীয় প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণ ত্যাগ করার পর কিছু ব্যক্তি গাড়িবহরের পেছন পেছন গিয়ে নানা ধরনের উসকানিমূলক স্লোগান দেন। এ সময় প্রেসক্লাবের উল্টো দিকের সড়কে গাড়িবহরের পিছু নেওয়া ব্যক্তিদের লাঠিপেটা করে ছত্রভঙ্গ করে দেন সেনাসদস্যরা।

আন্দোলনকারীরা জানান, ‘বাংলাদেশ সহযোদ্ধা প্ল্যাটফর্ম’–এর ব্যানারে আজ সকাল সাতটার পর থেকেই তাঁরা প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান নেন। বেলা ১১টার দিকে প্রেসক্লাব এলাকা থেকে জাহাঙ্গীর গেটের দিকে যাওয়ার জন্য রওনা দেন। তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বাধা দেওয়ায় এগোতে পারেননি। বেলা দুইটার দিকে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আসেন সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমিনুর রহমান। পরে দুই দফা তিনি আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বৈঠক করেন। দ্বিতীয় দফা বৈঠক শেষে তিনি গাড়িবহর নিয়ে জাতীয় প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণ ত্যাগ করেন।

সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে দ্বিতীয় দফা বৈঠক শেষে সন্ধ্যা সোয়া ছয়টার দিকে আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন চাকরিচ্যুত সৈনিক মো. কামরুজ্জামান। তিনি বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আলোচনায় বলেছেন, ১০ বছরের কম চাকরি করে যাঁরা চাকরিচ্যুত হয়েছেন, তাঁদের পুনর্বহালের সর্বাত্মক চেষ্টা করবেন। যাঁদের চাকরির বয়স শেষ, তাঁদের পেনশনের আওতাভুক্ত করবেন। যাঁরা চাকরি ফিরে পেতে আবেদন করেছেন, তাঁদের নতুন করে আবেদনের দরকার নেই। আর যাঁরা আবেদন করেননি, তাঁদের আবেদন দিতে হবে। তিনি বলেন, ‘আজ রাতের মধ্যে আমাদের কাছে আবেদন পৌঁছে দেবেন।’

আন্দোলনকারীদের একটি দাবি ছিল গতকাল গ্রেফতার হওয়া বাংলাদেশ সহযোদ্ধা প্ল্যাটফর্মের সমন্বয়ক চাকরিচ্যুত সৈনিক নাঈমুল ইসলামসহ গ্রেফতার তিনজনের মুক্তি দিতে হবে। এ বিষয় ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে জানিয়ে কামরুজ্জামান বলেন, এ বিষয়ে দাবি ছিল নাঈমুল ইসলামকে আজ মুক্তি দিতে হবে। যেহেতু সন্ধ্যা ছয়টা পার হয়ে গেছে, সে জন্য আগামীকাল নাঈমুলসহ যাঁরা গ্রেফতার হয়েছেন, তাঁদের মুক্তির ব্যবস্থা করা হবে। তিনি বলেন, ‘এ জন্য আপনারা আগামীকাল পর্যন্ত ঢাকায় অবস্থান করবেন। মুক্তি না দিলে আবার কর্মসূচি দেওয়া হবে।’

কামরুজ্জামান বলেন, ‘যেহেতু একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এসেছেন, একজন কর্নেল এসেছেন, তাঁদের প্রতি সম্মান জানিয়ে কর্মসূচি স্থগিত করা হচ্ছে। আমরা তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা রাখব। তাঁরা আশ্বাস দিয়েছেন, মানবিক দিক বিবেচনা করে বিষয়গুলো দেখবেন।’

দ্বিতীয় দফা বৈঠকে সমঝোতা হওয়ার পর সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জাতীয় প্রেসক্লাব ত্যাগ করলে তাঁদের পেছনে পেছনে গিয়ে স্লোগান দেন কিছু ব্যক্তি। এ সময় তাঁদের লাঠিপেটা করেন সেনাসদস্যরা। আজ রোববার সন্ধ্যায় রাজধানীর তোপখানা রোড এলাকায়ছবি: দীপু মালাকার

এর আগে বেলা দুইটার দিকে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আসেন সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমিনুর রহমান। তিনি আন্দোলনরত ব্যক্তিদের একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে প্রেসক্লাবের ভেতরে আলোচনা করেন। পরে বিকেল সোয়া চারটার দিকে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা তাঁদের দাবিদাওয়াগুলো শুনেছি। আমরা সব দাবিদাওয়া নোট করেছি। এগুলো নিয়ে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

সেনা কর্মকর্তা আমিনুর রহমান বলেন, ‘তাঁদের বলেছি, সবাইকে আলাদা আলাদা করে আবেদন করতে। আবেদনের ঠিকানা আমরা দিয়ে গেছি। ইনডিভিজ্যুয়াল কেসের মেরিট (প্রতিটি ঘটনার গুরুত্ব) অনুযায়ী আমরা বসব, আলাপ-আলোচনা করে আপনাদের যত দ্রুত সম্ভব যতখানি দেওয়া সম্ভব আমরা অ্যাড্রেস করব। এটাও বলেছি যে সেনাবাহিনীর যে শৃঙ্খলা, এটা অবশ্যই মেইনটেইন (বজায় রাখা) করতে হবে। আমরা মানবিকভাবে যতটুকু সাহায্য করার করব।’

এরপর বিকেল সাড়ে চারটার দিকে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমিনুর রহমান প্রেসক্লাব থেকে বের হতে যান। এ সময় তাঁর গাড়িবহরের সামনে চাকরিচ্যুতরা শুয়ে পড়েন। পরে প্রেসক্লাবের ভেতর থেকে গাড়ি আর বের হতে পারেনি। পরে আমিনুর রহমান আবার গাড়ি থেকে নেমে সবাইকে বোঝান। তবে তাঁর কথার বিপরীতে চাকরিচ্যুতরা প্রেসক্লাবে বসেই সমাধান করতে বলেন। কিছুক্ষণ এই অবস্থা চলতে থাকে। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে আন্দোলনকারীদের একটি প্রতিনিধিদল আবারও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমিনুর রহমানের সঙ্গে আলোচনা করতে প্রেসক্লাবের ভেতরে যান। প্রায় সোয়া ঘণ্টা আলোচনা শেষে আন্দোলনকারীরা সন্ধ্যা সোয়া ছয়টার দিকে কর্মসূচি স্থগিত করেন।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *