নতুন ব্যাংক নোটে দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি

■ নাগরিক প্রতিবেদক ■

বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারে আনছে নতুন ডিজাইনের টাকার নোট। এসব নোটে দেশের গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক, প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতীকগুলোকে বিশেষভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, নতুন ডিজাইনের টাকায় কোনো ব্যক্তির ছবি থাকছে না। এর বদলে থাকছে দেশের ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা, প্রাকৃতিক দৃশ্য ও সাংস্কৃতিক প্রতীক।

পবিত্র ঈদুল আজহার আগেই বাজারে নতুন তিন ধরনের টাকার নোট বাজারে ছাড়বে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে এসব নোটে কোনো ব্যক্তির ছবি থাকবে না; এর পরিবর্তে প্রাকৃতিক দৃশ্য বা স্থাপনার ছবি থাকবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর এসব তথ্য জানিয়েছেন।

জানা গেছে, প্রথম ধাপে ২০, ৫০ ও ১০০ টাকার নোট বাজারে ছাড়া হবে, যা পবিত্র ঈদুল আজহার আগেই – জুনের ২ অথবা ৩ তারিখের মধ্যে সাধারণ মানুষ হাতে পাবে। পর্যায়ক্রমে অন্য মূল্যমানের নোটও বাজারে আসবে। তবে এখনই সব নোট পুরোপুরি বাজারে না এলেও সীমিত পরিসরে ছাড়ার পরিকল্পনা রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর এক অনুষ্ঠানে জানান, নতুন নোটে দেশের প্রকৃতি, ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘নতুন ডিজাইনে কোনো ব্যক্তির ছবি রাখা হয়নি। নোটগুলোতে দেশের চিত্র ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরা হয়েছে।’

জানা গেছে, নোটগুলো বাজারে ছাড়ার আগে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে দেখানো হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন নোট নিয়ে ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছে ব্যাপক আগ্রহ। এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান জানান, ‘নতুন নোটের ডিজাইন কেমন হবে, তা গভর্নর স্যার আগেই জানিয়েছেন। এসব নোটে কোনো ব্যক্তির ছবি থাকছে না। বরং দেশের ঐতিহ্য, প্রকৃতি ও সাংস্কৃতিক নিদর্শনকে গুরুত্ব দিয়ে ডিজাইন করা হয়েছে।’

তিনি আরও জানান, ঈদের আগে – জুনের ২ বা ৩ তারিখের মধ্যে – ২০, ৫০ ও ১০০ টাকার নতুন নোট সাধারণ মানুষের হাতে পৌঁছে যাবে। ছাপার কাজ চলছে পুরোদমে। প্রথমে এই তিনটি নোট বাজারে আসবে, পরে ধাপে ধাপে অন্য মূল্যমানের নোট ছাড়া হবে।

নতুন ডিজাইনের কয়েকটি নোটে সুন্দরবন, ঐতিহাসিক স্থাপনা ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতীক দেখা গেছে। এসব নোটে দেশের পরিচিতি ও গৌরবময় ইতিহাসের ছাপ সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

গভর্নর জানিয়েছে, পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনা অন্তর্বর্তী সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার।

তিনি বলেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রচারিত হওয়ায় তা ফেরত পাঠাতে চাপ তৈরি হয়েছে। পাচারকৃত অর্থ ফ্রিজ করায় অর্থ ফেরত আনার প্রথম ধাপ সম্পন্ন হয়েছে।’

গভর্নর বলেন, ‘স্কিমের আওতায় পিকেএসএফ অংশীদার এমএফআই গুলোকে ২৪০ কোটি টাকার রিজার্ভ তহবিল ভিত্তিতে ব্যাংক ঋণ গ্যারান্টি দেবে। ঋণের গ্যারান্টি অনুযায়ী এককালীন ০.৫ শতাংশ কমিশন আদায় করা হবে। এর মাধ্যমে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ব্যাংক ঋণ পাওয়া সহজ হবে।’

সরকার ও এডিবির সহায়তায় এই পাইলট প্রোগ্রামে এদিন চুক্তিবদ্ধ হয়েছে পাঁচটি বেসরকারি ব্যাংক ও নন ব্যাংকিং ফিনান্সিয়াল ইন্সটিটিশন বলেও জানান তিনি

আর্থিক স্বাক্ষরতা বাড়াতে ব্যাংকগুলোকে প্রতিটি স্কুলের সাথে কাজ করার আহ্বান জানান গভর্নর৷

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, এত দিন বাংলাদেশ ব্যাংকের নোটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি ছিল। জুলাই অভ্যুত্থানের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবিসহ নোট নিয়ে বিতর্ক ওঠায় গত ১০ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের চিঠি দিয়ে নতুন নোট বিনিময় কার্যক্রম বন্ধ রাখতে বলা হয়। পাশাপাশি ব্যাংকের শাখায় যেসব নতুন নোট গচ্ছিত আছে, তা বিনিময় না করে সংশ্লিষ্ট শাখায় সংরক্ষণের কথা বলা হয়। এরপর থেকে নতুন নোটের বিনিময় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বাজারে ছেঁড়াফাটা নোট বাড়তে থাকে।

এদিকে টাঁকশালের কর্মকর্তারা জানান, নতুন নকশার নোট ছাপাতে সাধারণত এক থেকে দেড় বছর সময় লাগে। গত বছরের আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। গত ডিসেম্বরে নতুন নকশার নোট বাজারে আনার সিদ্ধান্ত হয়। তারই ধারাবাহিকতায় চলতি মাসে নতুন নকশার নোট ছাপানো শুরু হয়। তবে একসঙ্গে তিনটি নোটের বেশি ছাপানোর সক্ষমতা নেই টাঁকশালের। তাই প্রথম ধাপে ২০, ৫০ ও ১০০০ টাকার নোট ছাপানো হচ্ছে। নতুন নোটে জুলাই অভ্যুত্থানের গ্রাফিতির পাশাপাশি আগের নকশাও ফিরে আসছে।

১০০ টাকার নতুন নোটে সুন্দরবনের ছোঁয়া

১০০ টাকার নতুন নোটে এক পাশে রয়েছে বাগেরহাটের ঐতিহাসিক ষাট গম্বুজ মসজিদ ও জাতীয় প্রাণী রয়েল বেঙ্গল টাইগারের জলছবি। অপর পাশে দেখা যাবে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন ‘সুন্দরবন’, যেখানে রয়েছে এক ঝাঁক হরিণ ও একটি বাঘের ছবি। সাদা অংশে বাঘের জলছবি সংযুক্ত করা হয়েছে।

২০০ টাকার নোটে ধর্মীয় সম্প্রীতির প্রতিফলন

নতুন ২০০ টাকার নোটে হালকা হলুদ রঙে দেখা যাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে অবস্থিত অপরাজেয় বাংলা ভাস্কর্য। অপর পাশে ফুটে উঠেছে বাংলাদেশের ধর্মীয় সম্প্রীতি—মুসলিম, হিন্দু, খ্রিষ্টান ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষ তাদের ধর্মীয় পোশাক ও উপাসনালয় সহ উপস্থাপিত হয়েছে। মাঝখানে সবুজের মধ্যে রয়েছে দেশের মানচিত্র।

৫০০ টাকার নোটে শহীদ মিনার ও সুপ্রিম কোর্ট

নতুন ৫০০ টাকার নোটে একপাশে স্থান পেয়েছে জাতীয় চেতনায় অনন্য কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। অপর পাশে রয়েছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের ছবি।

১০০০ টাকার নোটে জাতীয় স্মৃতিসৌধ ও সংসদ ভবন

সবচেয়ে বড় মূল্যমানের ১০০০ টাকার নোটে একদিকে রয়েছে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ, যা দেশের স্বাধীনতার প্রতীক। অপরদিকে রয়েছে জাতীয় সংসদ ভবন, যা বাংলাদেশের গণতন্ত্রের প্রতীক।

নতুন ডিজাইনের এই নোটগুলো বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য একত্রে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই উদ্যোগকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন অর্থনীতিবিদ ও সাধারণ মানুষ।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *