:: নাগরিক প্রতিবেদন ::
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিদেশি ঋণ ছাড়িয়েছে ১০০ বিলিয়ন বা দশ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। ২০২৩ সাল শেষে সামগ্রিক বিদেশি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০০ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার।
এক বছর আগে ২০২২ সালে যা ছিল ৯৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। সবমিলিয়ে বছরের ব্যবধানে বিদেশি ঋণের স্থিতি বেড়েছে ৪ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এমনই তথ্য উঠে এসেছে। এতে দেখা যায়, ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ৯ হাজার ৬৫২ কোটি ডলার। সেই হিসেবে এক বছরের ব্যবধানে বিদেশি ঋণের স্থিতি বেড়েছে ৪১২ কোটি ডলার। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরের শেষে বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ৯ হাজার ৬৫৫ কোটি ডলার। তার মানে পরের তিন মাসে ৪ বিলিয়ন বা ৪০৯ কোটি ডলারের বিদেশি ঋণ বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০১৫-১৬ অর্থবছর শেষে বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ৪ হাজার ১১৭ কোটি ডলার। আর গত ২০২২–২৩ অর্থবছর শেষে তা ৯ হাজার ৮১১ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। অর্থাৎ গত আট বছরে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। গত ডিসেম্বর শেষে সেটি আরও বেড়েছে।
জনশুমারি ও গৃহগণনা শুমারির চূড়ান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ। সেই হিসাবে গত ডিসেম্বরের শেষে মাথাপিছু বিদেশি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৫৯২ ডলার (প্রায় ৬৫ হাজার টাকা)। যদিও গত জুনের হিসাবে মাথাপিছু বিদেশি ঋণ ছিল ৫৭৪ ডলার। আট বছর আগে এটা ছিল ২৫৭ ডলারের কিছু বেশি।
মোট বিদেশি ঋণের মধ্যে সরকারি খাতে ৭৯ শতাংশ আর বেসরকারি খাতে ২১ শতাংশ। গত ডিসেম্বর শেষে সরকারি খাতে বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ৭ হাজার ৯৬৯ কোটি ডলার। তার আগের তিন মাসে বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ৭ হাজার ৫২৭ কোটি ডলার। অর্থাৎ গত বছরের শেষ তিন মাসে সরকারি খাতে বিদেশি ঋণের স্থিতি বেড়েছে ৫ দশমিক ৮৭ শতাংশ। অন্যদিকে গত ডিসেম্বর শেষে বেসরকারি খাতের ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ২ হাজার ৯৫ কোটি ডলার। যা গত সেপ্টেম্বরে ছিল ২ হাজার ১২৮ কোটি ডলার।
সরকার বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) মতো সংস্থা এবং জাপান, চীন, রাশিয়া ও ভারতের মতো দেশের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি বিদেশি ঋণ নেয়। এই সব ঋণ নেওয়া হয় মূলত প্রকল্প বাস্তবায়ন ও বাজেট সহায়তা হিসেবে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) গত ডিসেম্বরের হিসাবে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ঋণদানে শীর্ষ দেশ ও সংস্থার মধ্যে ছিল বিশ্বব্যাংক, জাপান, এডিবি ও চীন। সাম্প্রতিককালে চীনা ঋণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
বিদেশি অর্থায়নে বেশ কিছু বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার। এর মধ্যে রয়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্প, মেট্রোরেল (লাইন-৬), হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল, কর্ণফুলী টানেল, মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ ইত্যাদি।
সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে সরকারের বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ২০ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার। ওই সময় বিদেশি উৎস থেকে দেশের বেসরকারি খাতের ঋণ নেয়ার সুযোগ ছিল না। অন্যদিকে সরকারি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণও ছিল খুবই কম। কিন্তু এর পর থেকে সরকারের বিদেশি ঋণ দ্রুতগতিতে বেড়েছে। একই সঙ্গে বিদেশি ঋণ বেড়েছে বেসরকারি খাতেরও।
সরকারি-বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণের স্থিতি গত ডিসেম্বর শেষে ১০০ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয় বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে উঠে এসেছে। সে হিসাবে গত ১৩ বছরে বিদেশি ঋণ বেড়েছে ৩৯৫ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবায়ন অনুযায়ী, দেশের সরকারি-বেসরকারি বিদেশি ঋণ স্থিতি মোট জিডিপির প্রায় ২৩ শতাংশ। ঋণের এ অনুপাতকে অর্থনীতির জন্য মোটেই উদ্বেগজনক নয় বলে মনে করে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, বিদেশি ঋণ ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়ালেও দেশের জিডিপির আকারের তুলনায় এটি খুব বেশি নয়। এখনও অনেক বিদেশি ঋণ নেওয়ার সক্ষমতা আমাদের রয়েছে। বিশ্ববাজারে সুদহার বাড়ায় দেশের বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার ঋণ কমে গেছে। এটি না হলে বিদেশি ঋণের স্থিতি অনেক আগেই ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০১৫-১৬ অর্থবছর শেষে বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ৪ হাজার ১১৭ কোটি ডলার। আর গত ২০২২–২৩ অর্থবছর শেষে তা ৯ হাজার ৮১১ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। অর্থাৎ গত আট বছরে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। গত ডিসেম্বর শেষে সেটি আরও বেড়েছে।
প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৮ সালের পর বিদেশি ঋণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ৬৮ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৯ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ৮১ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলারে। ২০২১-২২ অর্থবছরে এ ঋণের পরিমাণ ৯৫ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ৯৮ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। আর গত বছর শেষে এ ঋণের পরিমাণ ছাড়িয়েছে ১০০ বিলিয়ন ডলার।
মোট বিদেশি ঋণের মধ্যে সরকারি খাতে ৭৯ শতাংশ আর বেসরকারি খাতে ২১ শতাংশ। গত ডিসেম্বর শেষে সরকারি খাতে বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ৭ হাজার ৯৬৯ কোটি ডলার। তার আগের তিন মাসে বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ৭ হাজার ৫২৭ কোটি ডলার। অর্থাৎ গত বছরের শেষ তিন মাসে সরকারি খাতে বিদেশি ঋণের স্থিতি বেড়েছে ৫ দশমিক ৮৭ শতাংশ। অন্যদিকে গত ডিসেম্বর শেষে বেসরকারি খাতের ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ২ হাজার ৯৫ কোটি ডলার। যা গত সেপ্টেম্বরে ছিল ২ হাজার ১২৮ কোটি ডলার।
সরকারি বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের পাশাপাশি গত এক দশকে বিদ্যুৎ খাতেও বিপুল পরিমাণ বিদেশি ঋণ এসেছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ এসেছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণের জন্য ১১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে রাশিয়া। পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ২ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেয়া হয়েছে চীন থেকে। আর রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার ঋণসহায়তা দিয়েছে ভারত।
এ ছাড়া মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ অন্যান্য প্রকল্প ঘিরে জাপান থেকে ৪৩ হাজার ৯২১ কোটি টাকার সমপরিমাণ ঋণসহায়তা নেওয়া হচ্ছে। সরকারের পাশাপাশি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ নিচ্ছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদেশি ঋণের স্থিতি এখন ১১ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ রয়েছে ২ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার।
চলতি বছর থেকে অনেক মেগা প্রকল্পের ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হচ্ছে। এতে বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়বে। এমনিতেই দেশে ডলারের তীব্র সংকট চলছে। বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ায় আরও বেশি পরিমাণে ডলারের প্রয়োজন হবে। কিন্তু প্রত্যাশা অনুযায়ী রেমিট্যান্স, রপ্তানি আয়সহ দেশের ডলার সংস্থান বাড়ানো যাচ্ছে না। বিপরীতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্ষয় ক্রমাগত বাড়ছে।
অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি বিদ্যমান। এই অবস্থায় বিদেশি ঋণের বৃদ্ধি ভবিষ্যতে চ্যালেঞ্জ জানাবে। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, বিদেশি ঋণ বাড়ছে। এটা দেশের জন্য উদ্বেগজনক। পরিস্থিতি সামাল দিতে চীন ও রাশিয়া থেকে সাপ্লাইয়ার ক্রেডিট নেয়া বন্ধ করতে হবে।