:: নাগরিক নিউজ ডেস্ক ::
বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে পাকিস্তানের নিচে বাংলাদেশ। সূচকে দুই ধাপ পিছিয়ে ১৬৫তম স্থানে নেমে গেছে বাংলাদেশ। পাকিস্তান আছে ১৫২তম অবস্থানে। ২০২৪ সালে ১৮০টি দেশের মধ্যে ২৭ দশমিক ৬৪ স্কোর নিয়ে বাংলাদেশের এই অবস্থান।
বিশ্বজুড়ে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা ফ্রান্সভিত্তিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) শুক্রবার (২ মে) এই সূচক প্রকাশ করেছে।
গতবারের মত এবারও বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম ইস্যুতে বৈশ্বিক সূচকে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে নরওয়ে। দেশটির পয়েন্ট ৯১ দশমিক ৮৯। শীর্ষ দশের বাকি দেশগুলো হলো- ডেনমার্ক, সুইডেন, নেদারল্যান্ডস, ফিনল্যান্ড, এস্তোনিয়া, পর্তুগাল, আয়ারল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড ও জার্মানি।
সূচক অনুযায়ী, বিশ্বে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে আফ্রিকার দেশ ইরিত্রিয়া ১৮০তম। দেশটির স্কোর ১৬ দশমিক ৬৮।
সূচকে খারাপের দিক দিয়ে দ্বিতীয় সিরিয়া ১৭৯তম, তৃতীয় আফগানিস্তান ১৭৮তম, চতুর্থ উত্তর কোরিয়া ১৭৭তম, পঞ্চম ইরান ১৭৬তম।
গণমাধ্যম সূচকের মোট ১০০ পয়েন্টের মধ্যে বাংলাদেশ পেয়েছে ২৭ দশমিক ৬৪। ২০২৩ সালে যা ছিল ৩৫ দশমিক ৩১। অবস্থান ছিল ১৬৩তম।
২০২২ সালে ৩৬ দশমিক ৬৩ পয়েন্ট নিয়ে ১৬২তম অবস্থানে এবং ২০২১ সালে ৫০ দশমিক ২৯ পয়েন্ট নিয়ে ১৫২তম অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ।
দক্ষিণ এশিয়ায় গণমাধ্যমের স্বাধীনতার দিক দিয়ে এবার শীর্ষস্থান দখল করেছে নেপাল; ৬০ দশমিক ৫২ পয়েন্ট নিয়ে দেশটি ৭৪তম অবস্থান দখল করেছে। এর পরের অবস্থানে আছে মালদ্বীপ। ৫২ দশমিক ৩৬ পয়েন্ট নিয়ে দেশটির অবস্থান ১০৬তম। এবারের তালিকায় প্রথম অবস্থান থেকে ছিটকে তৃতীয় স্থানে চলে গেছে ভুটান। ৩৭ দশমিক ২৯ পয়েন্ট নিয়ে দেশটির অবস্থান ১৪৭তম।
এবারের সূচকে ভারতের দুই ধাপ অগ্রগতি হয়েছে। ১৫৯তম অবস্থানে আছে দেশটি। পাকিস্তান আছে ১৫২তম অবস্থানে, গত বছরের তুলনায় দুই ধাপ অবনমন হয়েছে। এ ছাড়া শ্রীলঙ্কা ১৫০তম, মালদ্বীপ ১০৬তম, ভুটান ১৪৭তম ও নেপাল ৭৪তম অবস্থানে রয়েছে। সূচকে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ৫৫তম, রাশিয়ার ১৬২তম এবং চীনের অবস্থান ১৭২তম।
আফগানিস্তান দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বশেষ স্থান পেয়েছে। ২৬ ধাপ পিছিয়ে দেশটির বৈশ্বিক অবস্থান ১৭৮তম, পয়েন্ট মাত্র ১৯ দশমিক ০৯।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জের দিক দিয়ে গোটা বিশ্বে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক কর্মস্থল হিসেবে মিয়ানমার, চীন, উত্তর কোরিয়া, ভিয়েতনাম ও আফগানিস্তানের নাম উল্লেখ করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে।
প্রকাশিত সূচক অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শুধু আফগানিস্তানের চেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। আর ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, নেপাল ও ভুটানের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে।
আরএসএফের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশ -এর বড় অবনমন ঘটেছিল ২০২২ সালে। ২০২১ সালের তুলনায় ওই বছর সূচকে বাংলাদেশের ১০ ধাপ অবনমন হয়। পরের বছর আরও এক ধাপ পেছায় বাংলাদেশ। সে হিসাবে, ২০২১ সাল থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে তিন বছরে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের অবনমন ঘটল ১৩ ধাপ। অর্থাৎ ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৫২ তম থেকে ১৬৫ তম অবস্থানে নেমে গেল বাংলাদেশ।
প্রতিবেদনে আরএসএফ বলেছে, বাংলাদেশের প্রায় ১৭ কোটি নাগরিকের মধ্যে এক–পঞ্চমাংশের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেন এবং মূলধারার সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে তাদের সংযোগ সামান্যই। এ দেশে তথ্য প্রবাহে ইন্টারনেটভিত্তিক মাধ্যমগুলোর ভূমিকা বাড়ছে।
আরএসএফের মতে, রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ও বাংলাদেশ বেতার সরকারি প্রচার–প্রচারণার মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে। রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) ভূমিকাও একই। ব্যক্তি মালিকানায় ৩ হাজার ছাপা পত্রিকা (দৈনিক ও সাময়িকী), ৩০টি রেডিও স্টেশন, ৩০টি টিভি চ্যানেল ও কয়েকশ নিউজ পোর্টাল। এর মধ্যে সরকারপন্থী সংবাদভিত্তিক টিভি চ্যানেল সময় টিভি ও একাত্তর টিভি খুব জনপ্রিয়। স্বাধীন অবস্থান নিয়ে চলা বা বিরোধীদের মালিকানায় কোনো টিভি চ্যানেল বর্তমানে নেই। যদিও শীর্ষস্থানীয় দুটি দৈনিক প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার নির্দিষ্ট মাত্রায় স্বাধীন সম্পাদকীয় নীতি মেনে চলে।
আরএসএফ বলছে, ক্ষমতাসীন দলের কর্মী–সমর্থকেরা পছন্দ না হলেই সাংবাদিকদের ওপর প্রায়ই শারীরিক হামলা চালায়। কোনো সাংবাদিককে চুপ করিয়ে দিতে বা সংবাদমাধ্যম বন্ধ করতে বিচারিক হয়রানি অব্যাহত রয়েছে। এ ধরনের বৈরী পরিস্থিতিতে সরকারি ভাষ্যকে চ্যালেঞ্জ করে এমন বিষয় সম্পাদকেরা সতর্কতার সঙ্গে এড়িয়ে যান।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করে যে সাইবার নিরাপত্তা আইন (সিএসএ) করা হয়েছে, সেটির সমালোচনা করে আরএসএফ বলেছে, এই আইন সাংবাদিকদের জন্য বিশ্বের অন্যতম কঠোর আইন। বিশেষত, এই আইনে পরোয়ানা ছাড়াই অনুসন্ধান এবং গ্রেফতার; ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি জব্দ; নির্বিচারে তথ্যের উৎসের গোপনীয়তা লঙ্ঘন এবং ‘সরকারের অবমাননা’ বলে বিবেচিত তথ্য প্রকাশকারী যে কোনো সাংবাদিকের ১৪ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। এই পরিবেশে সম্পাদকেরা নিয়মিত সেলফ সেন্সর করেন।
এ ছাড়া, বাংলাদেশে ব্যক্তিমালিকানাধীন সংবাদমাধ্যমের বেশির ভাগই এ দেশে অর্থনৈতিক অগ্রগতির মধ্যে আত্মপ্রকাশ করা বড় ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রিত। তাঁরা নিজেদের সংবাদমাধ্যমকে দেখেন প্রভাব বিস্তার ও মুনাফা তৈরির হাতিয়ার হিসেবে। এ ক্ষেত্রে তাঁরা সম্পাদকীয় স্বাধীনতা বজায় রাখার চেয়ে সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্কের ওপর বেশি গুরুত্ব দেন।
বাংলাদেশে প্রায় ১ কোটি ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ইস্যুগুলোও মূল ধারার সংবাদমাধ্যমে খুব একটা প্রতিফলিত হয় না।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলের সাংবাদিকরা কতটুকু স্বাধীনভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করেন, তা এই বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকের মাধ্যমে যাচাই করা হয়। এই সূচকে পাঁচটি বিষয় আমলে নেয়া হয়- রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, আইনি অবকাঠামো, অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট, আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও নিরাপত্তা।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সারা বিশ্বের মুক্ত গণমাধ্যম রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে হুমকির মুখোমুখি হচ্ছে। চলতি বছর এই সূচকের বৈশ্বিক গড় সাত দশমিক ছয় শতাংশ কমেছে।
বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলের সাংবাদিকরা কতটুকু স্বাধীনভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করেন, তা যাচাই করা হয়।
এই সূচকে পাঁচটি বিষয় আমলে নেওয়া হয়। এগুলো হলো—রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, আইনি অবকাঠামো, অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট, আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও নিরাপত্তা।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সারা বিশ্বের মুক্ত গণমাধ্যম রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে হুমকির মুখোমুখি হচ্ছে, যাতে রাজনৈতিক সূচকের উল্লেখযোগ্য হ্রাস থেকে নিশ্চিত হয়েছে।
এ বছর এই সূচকের বৈশ্বিক গড় সাত দশমিক ছয় শতাংশ কমেছে।
বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে আর্টিকেল নাইনটিনের দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক পরিচালক শেখ মনজুর-ই-আলম বলেন, ‘বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে জবাবদিহিতার সংকট তৈরি হয়েছে এবং বিষয়টির রাজনৈতিক চেহারা দেয়া হচ্ছে। আমরা অপরাধকে অপরাধ হিসেবে দেখতে পারছি না। এই যে সামগ্রিকভাবে অসহিষ্ণুতা তৈরি হয়েছে, যেটা আসলে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। তাতে আরও রসদ জুগিয়েছে নিবর্তনমূলক বিভিন্ন আইন।’
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষেধাজ্ঞা নিয়ে তুমুল বিতর্ক তৈরি হয়েছে। এ বিষয়ে বিবিসি বাংলার সঙ্গে কথা বলেন বাংলাদেশে বাণিজ্য-অর্থনীতি বিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টাস ফোরামের জেনারেল সেক্রেটারি আবুল কাশেম।বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, ‘সাংবাদিকরা তথ্য সংগ্রহে বাধার মুখে পড়ছেন। এখন পর্যন্ত যেসব জায়গায় সাংবাদিকদের ঢুকতে বাধা আসছে, সেখানে কোথাও কিন্তু ভুল নিউজের কারণে এটা হয়নি। বরং তারা একটা জিনিস গোপন রাখতে চেয়েছে, সেটা সাংবাদিকরা প্রকাশ করে দিয়েছে। সে কারণে সাংবাদিকদের অ্যাকসেসটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বা হচ্ছে।’
সাংবাদিক নেতা আবুল কাশেম আরও বলেন, ‘নানামুখী কারণে সরকার বা রাষ্ট্র সংশ্লিষ্ট কোনো কোনো তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে চাপের মুখোমুখি হচ্ছেন অনেক সাংবাদিক। তবে ইদানিং সরাসরি সরকার সংশ্লিষ্ট নয় এমন চাপও আসছে।’তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর দিক থেকেও এই চাপ ক্রমাগত বাড়ছে। বাংলাদেশের অনেক ব্যবসায়ী গ্রুপ আছে যারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তালিকায় ঋণ খেলাপি। কিংবা নানা অনিয়মের মাধ্যমে অনেক ব্যবসায়ী ব্যাংক থেকে ঋণের নামে টাকা বের করে নিয়ে যাচ্ছে। এসব ব্যবসায়ী গোষ্ঠী নিয়ে সংবাদ করতে চাইলে নানা ধরণের চাপ আসে বলে সাংবাদিকরা অভিযোগ করছেন।’
আবুল কাশেম বলেন, আপনি যখন সংবাদের নিয়ম অনুযায়ী ঐ ব্যবসায়ীর মন্তব্য নেয়ার জন্য যোগাযোগ করবেন, তখন দুই/তিন মিনিটের মধ্যেই বিভিন্ন এজেন্সি থেকে ফোন চলে আসে। সংবাদপত্র অফিসের সম্পাদক বা শীর্ষ পর্যায়ে ফোন করে বলা হয় যে রিপোর্টটা করা যাবে না। এ ধরণের প্রেশার এখন আছে এবং এটা দিনদিন বাড়ছে।’
১৯৯১ সালে ইউনেস্কোর ২৬তম সাধারণ অধিবেশনের সুপারিশ অনুসারে ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় ৩ মে তারিখটিকে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসের স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এর পর থেকে বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমকর্মীরা দিবসটি পালন করে আসছেন।