■ নাগরিক প্রতিবেদক ■
দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমেছে। আকুর দায় পরিশোধের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার মোট রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২৪ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলার। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে বিপিএম-৬ গণনার হিসাব মান অনুযাযী এটা ১৯ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলার।
এর আগের কর্মদিবস ৬ মার্চ বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভ ছিল ২৬ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার। আর বিপিএম-৬ হিসাবে ছিল ২১ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার। আইএমএফের পরামর্শ অনুযায়ী ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যয়যোগ্য রিজার্ভের লক্ষ্য ছিল ১৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এই পরিমাণ রিজার্ভ সন্তোষজনক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসের জন্য এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দেশভুক্ত ৯টি দেশের আমদানি পণ্যের বিল বাবদ ১ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। এর আগে অক্টোবর ও নভেম্বর মাসের আকু বিল ছিল ১ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার। তার আগে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে ছিল ১ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার। বিগত ছয় মাসে আকু বিল পরিশোধের পরও রিজার্ভের স্থিতিশীলতা বজায় রয়েছে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।
আকু আন্তঃদেশীয় লেনদেন নিষ্পত্তি ব্যবস্থা। ইরানের রাজধানী তেহরানে আকুর সদর দপ্তর। এর মাধ্যমে একটি চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মধ্যকার লেনদেনের দায় প্রতি দুই মাস পরপর পরিশোধ করা হয়। জাতিসংঘের এশিয়া অঞ্চলের অর্থনীতি ও সামাজিক কমিশনের (এসক্যাপ) ভৌগোলিক সীমারেখায় অবস্থিত সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর জন্য আকুর সদস্য পদ উন্মুক্ত।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বিপিএম-৬ মানদণ্ড অনুযায়ী, বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট অব্যাহত রয়েছে। যার ফলে ২২ জানুয়ারি পর্যন্ত রিজার্ভ ১৯ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। একই দিনে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী মোট রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৫ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলারে।
গত ১৫ জানুয়ারিতে বিপিএম-৬ স্ট্যান্ডার্ডে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। আর মোট রিজার্ভ ছিল ২৫ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার। গত ছয় দিনে বিপিএম-৬ এর মানদন্ড অনুযায়ী রিজার্ভ ২০ কোটি ডলার কমেছে। এছাড়া নেট বা প্রকৃত রিজার্ভের আরেকটি গণনা রয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রকাশ করে না।
সূত্র জানায়, দেশের ব্যবহারযোগ্য বা প্রকৃত রিজার্ভ এখন ১৬ বিলিয়ন ডলারের নিচে।
দায়মুক্ত এসব রিজার্ভ ঋণ ব্যবস্থার সময় আইএমএফের মানদন্ড অনুযায়ী হিসাব করা হয়। আইএমএফ বাংলাদেশকে তার ঋণের শর্ত হিসেবে নির্দিষ্ট বিরতিতে প্রকৃত রিজার্ভের নির্দিষ্ট মাত্রা বজায় রাখতে বাধ্য করে।
সেই হিসাবে দেশের ব্যয়যোগ্য প্রকৃত রিজার্ভ এখন ১৫ বিলিয়ন ডলারের কিছুটা ওপরে। সাধারণত একটি দেশের ন্যূনতম তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমান রিজার্ভ থাকতে হয়। আমাদের দেশে সে পরিমাণ রিজার্ভ রয়েছে। আর নিট রিজার্ভ গণনা করা হয় আইএমএফের ‘বিপিএম-৬’ পরিমাপ অনুসারে। মোট রিজার্ভ থেকে স্বল্পমেয়াদি দায় বাদ দিলে নিট বা প্রকৃত রিজার্ভের পরিমাণ পাওয়া যায়।
উল্লেখ্য, ১৯৮১-৮২ অর্থবছর থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১২ কোটি ১০ লাখ ডলার।
পাঁচ বছর পর ১৯৮৬-৮৭ অর্থবছর শেষে সেই রিজার্ভ বেড়ে হয় ৭১ কোটি ৫০ লাখ ডলার। ১৯৯১-৯২ অর্থবছর শেষে রিজার্ভ ১০০ কোটি (১ বিলিয়ন) ডলার অতিক্রম করে ১ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলারে ওঠে। পরের ১৯৯২-৯৩ অর্থবছর শেষে রিজার্ভ ২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে ২ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়।
৩ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে ১৯৯৪-৯৫ অর্থবছর শেষে। ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছর শেষে তা কমে ২ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। ১৯৯৬-৯৭ অর্থবছরে তা আরও কমে ১ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে।
এরপর ১৯৯৭-৯৮ থেকে ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছর পর্যন্ত রিজার্ভ দেড় থেকে দুই বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ওঠানামা করে।
২০০০-০১ অর্থবছরে রিজার্ভ কমে ১ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি নেমে আসে। ওই অর্থবছর শেষে রিজার্ভ ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার থাকলেও অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে তা ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারে নেমে গিয়েছিল। তখনই আকুর বিল পুরোটা পরিশোধ না করে অর্ধেক করা হয়েছিল।
২০০১-০২ অর্থবছর শেষে রিজার্ভ বেড়ে হয় ১ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার।
২০০৫-০৬ অর্থবছর শেষে রিজার্ভ ৫ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে ১০ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। ২০১২-১৩ অর্থবছরে তা ১৫ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে।
২০১৪ সালের ১০ এপ্রিল রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। পরের বছর ২০১৫ সালের ২৫ জানুয়ারি রিজার্ভ ২৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। ২০১৬ সালের জুনে রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে।
দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর ২০২০ সালের মার্চ শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। মহামারির এই সময়েই রিজার্ভ বেড়েছে সাড়ে ১২ বিলিয়ন ডলার।
২০২০ সালের ৩ জুন বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো রিজার্ভ ৩৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। তিন সপ্তাহের ব্যবধানে ২৪ জুন সেই রিজার্ভ আরও বেড়ে ৩৫ বিলিয়ন ডলার হয়।
২০২০ সালের ৩০ জুন রিজার্ভ ৩৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। এক মাস পর ২৮ জুলাই রিজার্ভ ৩৭ বিলিয়ন ডলারের ঘরও অতিক্রম করে। তিন সপ্তাহ পর গত ১৭ আগস্ট রিজার্ভ ৩৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়।
২০২০ সালের মাত্র দেড় মাসে ৩৪ বিলিয়ন ডলার থেকে রিজার্ভ ৪ বিলিয়ন ডলার বেড়ে ৩৮ বিলিয়ন ডলারে ওঠে।
২০২০ সালের ১ সেপ্টেম্বর রিজার্ভ ছাড়ায় ৩৯ বিলিয়ন ডলার। ৮ অক্টোবর ছাড়ায় ৪০ বিলিয়ন ডলার। ২৯ অক্টোবর অতিক্রম করে ৪১ বিলিয়ন ডলার। ৪২ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায় ১৫ ডিসেম্বর।
২০২০ সালের ৩০ ডিসেম্বর ৪৩ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করে রিজার্ভ।
২০২১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ৪৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়।
২০২১ সালের ২৮ এপ্রিল অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে রিজার্ভ ৪৫ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। একই বছরের ৪ মে আকুর ১ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ ৪৪ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে।