■ তারিক সাদাত ■
ভাষা আন্দোলনের কিছু স্বল্প আলোচিত ইতিহাস জেনে নেওয়া যাক; ১৯৪৭ সালে যারা ভাষা আন্দোলনের বীজ বপন করেন।
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
সর্বাগ্রে আসে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র নাম। জুলাই ১৯৪৭ এ আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ অভিমত ব্যক্ত করেন, হিন্দী ভারতের রাষ্ট্রভাষা হলে যুক্তিসঙ্গত কারণে উর্দু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিৎ।
এই অভিমত খন্ডন করে ড: মুহম্মদ শহীদুল্লাহ দৈনিক আজাদে একটা প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি লিখেন, “ভারতের হিন্দীর মতো উর্দু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হলে তা পশ্চাদগমণই হবে…. উর্দু পাকিস্তান ডোমিনিয়নের কোন অঞ্চলের ভাষা নয়…. পুর্ব পাকিস্তানের কোর্ট ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার পরিবর্তে উর্দু বা হিন্দীকে গ্রহণ করা হইলে ইহা রাজনৈতিক পরাধীনতার নামান্তর হইবে”।
আবুল মনসুর আহমদ
মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকায় ১৯৪৩ সালে প্রকাশিত ‘পূর্ব পাকিস্তানের জবান’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে রাষ্ট্রভাষা উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার বিরোধিতা করে আবুল মনসুর আহমেদ লিখেন, “উর্দু নিয়ে এই ধস্তাধস্তি না করে আমরা সোজাসুজি বাংলাকেই যদি রাষ্ট্রভাষা ও জাতীয় ভাষারূপে গ্রহণ করি, তবে পাকিস্তান প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমরা মুসলিম বাংলার শিক্ষিত সসম্প্রদায় নিজেরাই পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রিক, সামাজিক, শিক্ষাগত, অর্থনৈতিক ও শিল্পগত রূপায়নে হাত দিতে পারবো”।
পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় পাবলিক সার্ভিস কমিশনের তদানীন্তন শ্বেতাঙ্গ সচিব মি: গুডইন নভেম্বর ১৯৪৭ এ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে উচ্চতর সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার বিষয়াদি সম্পর্কে একটি সার্কুলার পাঠান। এতে ঐ পরীক্ষার জন্য ৩১টি বিষয় দেওয়া হয়, যার মধ্যে ৯টি ছিলো ভাষা। এই সকল ভাষার মধ্যে হিন্দী, উর্দু, ইংরেজি, জার্মান, ফ্রান্স, এমন কি মৃত ভাষা ল্যাটিন ক সংস্কৃতও স্থান পায়। কিন্তু স্থান পায় না পাকিস্তানের অধিকাংশ জনগণের মাতৃভাষা বাংলা।
এই সার্কুলার উল্লেখ করে অধ্যাপক আবুল কাসেম কলিকাতার দৈনিক ইত্তিহাদে একটি বিবৃতি দেন। ডিসেম্বরে দৈনিক ইত্তিহাদে সেই বিবৃতি ও এ সম্পর্কে পত্রিকার সম্পাদক আবুল মনসুর আহমদের লেখা এক কড়া সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়।
কবি ফররুখ আহমদ
“পাকিস্তান : রাষ্ট্রভাষা ও সাহিত্য” শীর্ষক প্রবন্ধে কবি ফররুখ আহমদ ১৯৪৪ সালে তৎকালীন একশ্রেণীর শিক্ষিত ব্যক্তির রাষ্ট্রভাষা বাংলার বিপক্ষে বক্তব্য রাখার কঠোর সমালোচনা করে লিখেন, “পাকিস্তান অন্তত পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা যে বাংলা হবে এ কথা সর্বাবাদিসম্মত হলেও আমাদের এই পূর্ব পাকিস্তানেরই কয়েকজন তথাকথিত শিক্ষিত ব্যক্তি বাংলাভাষার বিপক্ষে এমন অর্বাচীন মত প্রকাশ করেছেন যা নিতান্তই লজ্জাজনক।”
তিনি একটি ব্যাঙ্গ-সনেট লিখেন এ নিয়ে:
উর্দু বনাম বাংলা
দুইশ পঁচিশ মুদ্রা সে অবধি হয়েছে বেতন
বাংলাকে তালাক দিয়া উর্দুকে করিয়াছি নিকা
বাপান্ড শ্রমের ফলে উড়িছে আশার চামচিকা
উর্দু নীল আভিজাত্যে (জানে তা নিকট বন্ধুগণ)।
তমদ্দুন মজলিস ও প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম
সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক আবুল কাসেম ও অন্যান্য কয়েকজন অধ্যাপক, বুদ্ধিজীবী ও ছাত্রের উদ্যোগে ‘পাকিস্থান তমদ্দুন মজলিস’ নামে একটি আধা-রাজনৈতিক ও অয়াধা-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়। রাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা যায় কিনা এ নিয়ে ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী মহলে প্রথম চিন্তার সূত্রপাত করে এই তমদ্দুন মজলিস।
ভাষা নিয়ে তৎকালীন বুদ্ধিজীবী সমাজ তেমন চিন্তা করতেন না। তমদ্দুন মজলিসই প্রথম বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী ওঠায় এবং ভাষা আন্দোলনের পথ উন্মোচন করে। পরবর্তী পর্যায়ে ছাত্ররা একে সামগ্রিক রূপ দান করে।
বাংলা ভাষার পক্ষে ক্যাম্পেইন করতে গিয়ে তমদ্দুন মজলিস নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়। প্রথম দিকে বাংলা ভাষা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে তাদেরকে রীতিমতো নাজেহাল হতে হয়েছে। বাংলা ডিপার্টমেন্টসহ বেশিরভাগ শিক্ষক বাংলাভাষার গুরুত্ব অনুভব করতে পারেন নাই সেই সময়ে।
১৫ই সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ এ তমদ্দুন মজলিস “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু” এই শিরোনামে একটি বই প্রকাশ করে। বিভিন্ন প্রবন্ধে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে জোরালো যুক্তি ও বক্তব্য পেশ করা হয়।
এছাড়াও তমদ্দুন মজলিস বাংলাভাষার পক্ষে গণস্বাক্ষর কর্মসূচি ও সাহিত্যসভার আয়োজন করে। এই সাহিত্যসভার পরপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর নূরুল হক ভূঁইয়াকে আহবায়ক করে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।
প্রথমদিকে এই পরিষদের সভাগুলো গোপনে আয়োজন করা হতো। তমদ্দুন মজলিসের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে পুরানো ঢাকার একদল লোক তাদের অফিস তছনছ করে। পুরানো ঢাকার স্থানীয় লোকজন মনে করতো রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবী তুলে ছাত্ররা পাকিস্তান ও ইসলামী আদর্শের খেলাপ কাজ করছে।
পুরানো ঢাকায় বাংলার স্বপক্ষে ইশতেহার বিলি করতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোহাম্মদ তোয়াহা ও ডাকসুর জেনারেল সেক্রেটারি গোলাম আযমসহ আরো কয়েকজন ছাত্র স্থানীয় উত্তেজিত জনতার রোশের মুখে পড়ে। এ সময় গোলাম আযম (অধ্যাপক গোলাম আযম) সাহস করে এগিয়ে যান এবং জনতার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলেন, “আরে ভাই, আমরা কি বলতে চাই একবার শুনবেন তো।” এ বলেই তিনি বাংলাভাষার পক্ষে (মানে, বাংলা রাষ্ট্রভাষা হলে তাদের কি উপকার হবে তা নিয়ে) একটা ছোট-খাট বক্তৃতা দিয়ে উত্তেজিত জনতাকে শান্ত করেন।
উপরোক্ত ঘটনা ও রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে ক্যাম্পেইনগুলো সবই ঘটে এমনকি ১৯৪৮ এর মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জিন্নাহ’র উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণার পূর্বেই।