■ কূটনৈতিক প্রতিবেদক ■
মালয়েশিয়ার সঙ্গে পাঁচটি সমঝোতা স্মারক ও তিনটি ‘নোট অব এক্সচেঞ্জ’ সই করেছে বাংলাদেশ। পুত্রজায়ায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়। বৈঠকের পর মঙ্গলবার সকালে এসব সমঝোতা স্মারক ও নোট অব এক্সচেঞ্জ সই হয়।
প্রথম সমঝোতা স্মারকটি ছিল প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বিষয়ে। তাতে সই করেন মালয়েশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোহাম্মদ খালেদ বিন নর্দিন এবং পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন।
দ্বিতীয় সমঝোতা সই হয় স্মারক তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহ ও অবকাঠামো, পেট্রোলিয়াম পণ্য ও সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো খাতে সহযোগিতা নিয়ে। এতে সই করেন মালয়েশিয়ার ভারপ্রাপ্ত অর্থমন্ত্রী আমির হামজা বিন আজিজান এবং বাংলাদেশের পক্ষে জ্বালানি উপদেষ্টা এম ফাওজুল কবির খান।
তৃতীয় সমঝোতা স্মারক সই হয় মালয়েশিয়ার ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ (আইএসআইএস) ও বাংলাদেশের বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) মধ্যে সহযোগিতা নিয়ে। এতে সই করেন আইএসআইএস মালয়েশিয়ার চেয়ারম্যান দাতুক অধ্যাপক ড. মোহদ ফায়েজ আবদুল্লাহ এবং মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার মো. শামীম আহসান।
চতুর্থ সমঝোতা স্মারকটি ছিল চিপ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান মিমোস (এমআইএমওএস) এবং বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিএমসিসিআই) মধ্যে সহযোগিতা-সংক্রান্ত। এতে সই করেন মিমোসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ ফাউজি ইয়াহায়া এবং বিএমসিসিআইয়ের সভাপতি শাব্বির আহমেদ খান।
পঞ্চম সমঝোতা স্মারকটি ছিল হয় মালয়েশিয়ার ন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি অব মালয়েশিয়া (এনসিসিআইএম) এবং বাংলাদেশের ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই)-এর মধ্যে সহযোগিতা বিষয়ে। এতে এনসিসিআইএম-এর সভাপতি দাতো’ সেরি এন. গোপালাকৃষ্ণন ও এফবিসিসিআই প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান স্বাক্ষর করেন।
এ ছাড়া মালয়েশিয়ার ন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এনসিসিআইএম) এবং বাংলাদেশের ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) মধ্যে সহযোগিতা নিয়ে পঞ্চম সমঝোতা স্মারকটি সই হয়। এতে সই করেন এনসিসিআইএমের সভাপতি এন গোবালাকৃষ্ণন এবং এফবিসিসিআইয়ের প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান।
প্রধান উপদেষ্টার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে বাংলাদেশ সময় সকাল সাড়ে ৯টার (মালয়েশিয়ার সময় বেলা সাড়ে ১১টা) কিছু আগে এক পোস্টে সমঝোতা স্মারক ও নোট অব এক্সচেঞ্জ সইয়ের বিষয়টি জানানো হয়।
এর আগে সকাল ৯টায় প্রধান উপদেষ্টা কুয়ালালামপুরের পুত্রজায়ায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পৌঁছালে তাকে লাল গালিচা অভ্যর্থনা দেওয়া হয়। সেখানে ড. ইউনূসকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। গার্ড অব অনার প্রদান শেষে আনোয়ার ইব্রাহিম তার মন্ত্রিসভার সদস্যদেরকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। পরে ড. ইউনূস প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে মিলিত হন।
সকালে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শুরুর আগে পুত্রজায়ায় মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিদর্শন বইয়ে সই করেন অধ্যাপক ইউনূস। পুত্রজায়ায় পৌঁছানোর পর তাঁকে নিজ কার্যালয়ে স্বাগত জানান মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী। সেখানে দেশটির কূটনীতিকদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টাকে পরিচয় করিয়ে দেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী।
প্রধান উপদেষ্টা তিন দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে গতকাল সোমবার মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুর পৌঁছান। দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাইফুদ্দিন নাসুতিওন ইসমাইল বিমানবন্দরে প্রধান উপদেষ্টাকে অভ্যর্থনা জানান। এ সময় প্রধান উপদেষ্টাকে লালগালিচা সংবর্ধনা ও গার্ড অব অনার দেওয়া হয়।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান বিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়ক সংক্রান্ত বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী, বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক বিন হারুনসহ ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তারা এই সফরে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আছেন।
২০২৪ সালের ৮ আগস্ট অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস-এর নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমই প্রথম বাংলাদেশ সফর করেন। তার আমন্ত্রণে এবার মুহাম্মদ ইউনূস কুয়ালালামপুর সফর করছেন।
বাংলাদেশকে সমর্থন দেওয়ার অঙ্গীকার মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর
বাংলাদেশকে সমর্থন দিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেছেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম। একইসঙ্গে মিয়ানমার সংকট নিয়ে আসিয়ানের সদস্য দেশগুলোর মধ্যে ঐক্যেরও আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
মালয়েশিয়া সফররত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক শেষে যৌথ ব্রিফিংয়ে এ কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম। মঙ্গলবার (১২ আগস্ট) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে মালয়েশিয়ার সংবাদমাধ্যম মালয় মেইল।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে যৌথ ব্রিফিংয়ে আনোয়ার ইব্রাহিম বলেন, মিয়ানমারে শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং শরণার্থী সংকট মোকাবিলা করা মালয়েশিয়ার অন্যতম অগ্রাধিকার। বিশেষ করে, বিপুল সংখ্যক বাস্তুচ্যুত মানুষকে আশ্রয় দিয়ে যে চাপ বাংলাদেশ বহন করছে, মালয়েশিয়া এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পাশে থাকবে।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত এবং শরণার্থীদের জন্য জরুরি মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। একই সঙ্গে, মিয়ানমার সংকট সমাধানে আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রচেষ্টাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
আনোয়ার বলেন, “আমি বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষকে নিউইয়র্ক, কাতার এবং এখানে মালয়েশিয়াতে বহুপাক্ষিক ফোরামে উদ্যোগ নেওয়ার জন্য প্রশংসা করি।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী (মোহম্মদ হাসান) ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন এবং থাইল্যান্ডের সঙ্গে সমন্বয় করে আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে মিয়ানমার সফর করবেন, যাতে সেখানে শান্তি নিশ্চিত করা যায় এবং কিছু জাতিগত সংখ্যালঘু ও মিয়ানমারের জনগণের ওপর যে নৃশংসতা চলছে, তার একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান হয়।”
এর আগে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সোমবার বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান। মঙ্গলবার বিকেলে তিনি সেখানে একটি ব্যবসায় ফোরামে অংশ নেবেন।
এরপর তিনি মালয়েশিয়ায় বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় অংশ নেবেন।
পরদিন বুধবার ইউনিভার্সিটি কেবাংসান মালয়েশিয়ার (ইউকেএম) আচার্য ও নেগেরি সেমবিলান রাজা তুয়াংকু মুহরিয ইবনি আলমারহুম তুয়াংকু মুনাওয়ির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
আমরা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, এখন আমরা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। আগামী ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে নতুন সরকারের জন্য নির্বাচনের আয়োজন করব।
মঙ্গলবার (১২ আগস্ট) সকালে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে বৈঠক শেষে যৌথ ব্রিফিংয়ে এ কথা বলেন তিনি।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা দেশকে স্বাভাবিকভাবে পরিচালনার পথে ফিরিয়ে আনতে পারব। এজন্য আমাদের অনেক সহায়তা প্রয়োজন এবং আমরা মালয়েশিয়ার সহায়তা প্রত্যাশা করছি।
এসময় বাংলাদেশে মালয়েশিয়াকে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, এখানে অপার সম্ভাবনা রয়েছে।
রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা আমাদের জন্য বড় সংকট। এ সংকট সমাধানে অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথইস্ট এশিয়ান নেশনসের (আসিয়ান) সাহায্য চাই।
প্রধান উপদেষ্টা স্থানীয় সময় সোমবার (১১ আগস্ট) সন্ধ্যা ৭টা ৫০ মিনিটে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান।
মঙ্গলবার বিকেলে একটি ব্যবসায় ফোরামে অংশ নেবেন ড. ইউনূস। এরপর তিনি মালয়েশিয়ায় বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় অংশ নেবেন।
বুধবার (১৩ আগস্ট) ইউনিভার্সিটি কেবাংসান মালয়েশিয়ার (ইউকেএম) আচার্য ও নেগেরি সেমবিলান রাজা তুয়াংকু মুহরিয ইবনি আলমারহুম তুয়াংকু মুনাওয়ির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন মুহাম্মদ ইউনূস।
এরপর প্রধান উপদেষ্টাকে একটি সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি তুলে দেবে ইউকেএম বিশ্ববিদ্যালয়টি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে একটি স্মারক বক্তৃতাও দেবেন প্রধান উপদেষ্টা।