এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচনের ঘোষণা দিলেন প্রধান উপদেষ্টা

■ নাগরিক প্রতিবেদক ■

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধের যেকোনো একটি দিনে অনুষ্ঠিত হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

শুক্রবার (৫ জুন) সন্ধ্যা ৭টায় পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে এ ঘোষণা দেন তিনি।

ভাষণের শুরুতে পবিত্র ঈদুল আজহার শুভেচ্ছা জানিয়ে শিশু, কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী, ছাত্র-ছাত্রী, বয়স্ক, বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ সবাইকে সালাম জানান প্রধান উপদেষ্টা।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমি জানি, আগামী জাতীয় নির্বাচন কখন হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানার জন্য রাজনৈতিক দল ও জনগণের মধ্যে বিপুল আগ্রহ রয়েছে। আমি বারবার বলেছি, এই নির্বাচন ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে। এ সময়ের মধ্যে দেশে নির্বাচন উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টির জন্য যা যা করা দরকার, সরকার তাই করছে।

তিনি আরও বলেন, এখানে মনে রাখা জরুরি, বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর থেকে যতবার গভীর সংকটে নিমজ্জিত হয়েছে তার সবগুলোরই প্রধান কারণ ছিল ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন। ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বারবার ক্ষমতা কুক্ষিগত করার মধ্য দিয়ে একটি রাজনৈতিক দল বর্বর ফ্যাসিস্টে পরিণত হয়েছিল। এ ধরনের নির্বাচন যারা আয়োজন করে তারা জাতির কাছে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যায়। এমন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে দল ক্ষমতায় আসে তারাও জনগণের কাছে ঘৃণিত হয়ে থাকে।

ড. ইউনূস বলেন, এ সরকারের একটি বড় দায়িত্ব হলো একটি পরিচ্ছন্ন, উৎসবমুখর, শান্তিপূর্ণ, বিপুলভাবে অংশগ্রহণের পরিবেশে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। এমন একটি নির্বাচন আয়োজন করা যাতে করে দেশ ভবিষ্যতে নতুন সংকটে না পড়ে। এজন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার। যেই প্রতিষ্ঠানগুলো নির্বাচনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত সেগুলোতে যদি সুশাসন নিশ্চিত করা না যায় তাহলে ছাত্র-জনতার সকল আত্মত্যাগ বিফলে যাবে।

তিনি বলেন, সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন—এই তিনটি ম্যান্ডেটের ভিত্তিতে আমরা দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলাম। সে বিবেচনায় আগামী রোজার ঈদের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে আমরা একটি গ্রহণযোগ্য জায়গায় পৌঁছাতে পারব বলে বিশ্বাস করি। বিশেষ করে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার—যা কিনা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের শহীদদের প্রতি আমাদের সম্মিলিত দায়—সে বিষয়ে আমরা দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখতে পারব।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এতে আমাদের ওপর আপনাদের অর্পিত ম্যান্ডেট ন্যূনতম হলেও বাস্তবায়ন করে যেতে পারব। সে বিবেচনায় ও ইতিহাসে সবচেয়ে অবাধ, সুষ্ঠু, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের জন্য সকল পক্ষের সঙ্গে আমরা আলোচনা করেছি। পাশাপাশি, বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন সংক্রান্ত চলমান সংস্কার কার্যক্রম পর্যালোচনা করে আমি আজ দেশবাসীর কাছে ঘোষণা করছি যে আগামী জাতীয় নির্বাচন ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধের যেকোনো একটি দিনে অনুষ্ঠিত হবে। এই ঘোষণার ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন উপযুক্ত সময়ে আপনাদের কাছে নির্বাচনের বিস্তারিত রোডম্যাপ প্রদান করবে।

তিনি বলেন, আমরা এমন নির্বাচন চাই যা দেখে অভ্যুত্থানের শহীদদের আত্মা তৃপ্তি পাবে, তাদের আত্মা শান্তি পাবে। আমরা চাই আগামী নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ভোটার, সবচেয়ে বেশি প্রার্থী ও দল অংশ নিক। এটা সবচেয়ে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হিসেবে জাতির কাছে স্মরণীয় থাকুক।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, তারা নানা ধরনের অপপ্রচারে লিপ্ত। তাদের মূল লক্ষ্য হলো, জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গড়ে ওঠা জাতীয় ঐক্য ও গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে ব্যর্থ করা এবং বাংলাদেশকে পুনরায় করায়ত্ব করা। আমি আগেও বলেছি, আজ আবারও বলছি—আমরা একটা যুদ্ধাবস্থায় আছি। এই মুহূর্তে আমাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো একতাবদ্ধ থাকা। পরাজিত শক্তি ও তাদের সহযোগীরা সুযোগ খুঁজে বসে আছে আমাদের থামিয়ে দিতে। আমরা তাদের এই সুযোগ কোনোভাবেই দেব না।

ভাষণে দেশের জনগণের প্রতি ঐক্য বজায় রাখার আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আসুন, আমরা একসঙ্গে প্রতিরোধের একটি সুদৃঢ় প্রাচীর গড়ে তুলি। মাতৃভূমির স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও জাতীয় মর্যাদার বিরুদ্ধে যেকোনো আঘাত আমরা একযোগে প্রতিহত করব। স্বৈরাচারী সরকারের আমলে গত ১৬ বছরে রাজনৈতিক ভিন্নমত দমনের জন্য বিপুল সংখ্যক মানুষকে গুম করা হয়েছে। এই মানুষগুলোকে এমন সব বন্দিশালায় আটকে রাখা হয়েছিল, যার কোনো কোনোটির আয়তন ছিল মাত্র তিন ফিট বাই তিন ফিট। গুমের ঘটনা তদন্ত ও এই ভয়াবহ অপরাধের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিচারের জন্য একটি স্বাধীন গুম সংক্রান্ত কমিশন নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তারা গুমের এমন এমন রোমহর্ষক ঘটনা আবিষ্কার করেছে যা নিষ্ঠুরতার চূড়ান্ত সীমা ছাড়িয়ে গেছে। মানুষকে পেট কেটে সিমেন্টের বস্তা ঢুকিয়ে নদীতে ডুবিয়ে দেওয়া হতো, ইনজেকশন দিয়ে অজ্ঞান করে জলন্ত ইট ভাটায় নিক্ষেপ করা হতো, ট্রেন ও গাড়ির নিচে ছুঁড়ে ফেলা হতো। কমিশন এখন পর্যন্ত দুটি অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তারা এখনও প্রতিনিয়ত নতুন নতুন অভিযোগ পাচ্ছে।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, গুমের তদন্ত কার্যক্রমের জন্য ঢাকা শহরের তিনটি, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও বগুড়া জেলায় তিনটি গুমের কেন্দ্র পরিদর্শন ও সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। তদন্তকাজে মানুষের সম্পৃক্ততা বাড়াতে বিশ্ববিদ্যালয়-মাদ্রাসা পর্যায়ে গণশুনানি গ্রহণ করা হয়েছে। মোট আট শতাধিক শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও সাধারণ মানুষ গণ-শুনানিতে অংশ নিয়েছেন। গুম সংক্রান্ত বেশ কিছু অভিযোগ ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কাছে জমা হয়েছে। এছাড়াও এ সংক্রান্ত একটি আইন প্রণয়নের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে আছে। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এটি চূড়ান্ত হবে বলে আশা করছি। গত ১৬ বছর ধরে এদেশের প্রতিটি স্তরে অপরাধ, অনিয়ম, দুর্নীতির ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছিল। এই রোগাক্রান্ত রাষ্ট্রব্যবস্থাকে রোগমুক্ত করে জনগণের কল্যাণমুখী করতে হলে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি। আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছি। বিভিন্ন ইস্যুতে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলাদা করে বৈঠক করেছি।

প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, সপ্তাহজুড়ে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সৎপরিচিতি এবং চলমান জাতীয় ঐক্য গঠনের বিষয়ে বৈঠক শুরু হয়েছে। সরকারের ব্যবস্থাপনায় এই বৈঠকগুলোতে তারা পরিস্থিতির গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনার একটি ধারা শুরু হয়েছে এবং এই আলোচনার মধ্য দিয়ে সমঝোতার সম্ভাবনাও দেখা দিয়েছে। অংশগ্রহণকারীরা বলেছেন, চলমান সংকট থেকে উত্তরণের জন্য সম্মিলিত উদ্যোগ ও জাতীয় ঐক্যই একমাত্র পথ। সেই লক্ষ্যে তারা ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে প্রস্তুত বলেও জানিয়েছেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, ‘দেড় দশক পর দেশে একটি সত্যিকারের জনপ্রতিনিধিত্বশীল সংসদ গঠিত হবে। বিপুল সংখ্যক তরুণ প্রথমবারের মতো ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে। এটা ঐতিহাসিক একটি সুযোগ এবং দায়িত্ব।’

তিনি জনগণকে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি আদায়ে সচেষ্ট হতে বলেন, যাতে আগামী সংসদের প্রথম অধিবেশনেই সংস্কারমূলক আইনসমূহ পাস হয় এবং ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠিত হয়।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘পতিত ফ্যাসিবাদ এবং তাদের দেশি-বিদেশি দোসররা নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রচেষ্টাকে বারবার বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে। আমরা এখনো যুদ্ধাবস্থায় রয়েছি। তাই সকল দেশপ্রেমিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধের প্রাচীর গড়ে তুলতে হবে।’

তিনি দেশবাসীকে সতর্ক করে বলেন, ‘তারা (পরাজিত শক্তি) ওত পেতে আছে, গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকে রুখে দেওয়ার জন্য। কিন্তু আমরা তাদের কোনোভাবেই এই সুযোগ দেব না। আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী নতুন প্রজন্মের সহায়তায় আমরা বিজয়ী হব।’

ভাষণের শেষ অংশে অধ্যাপক ড. ইউনূস বলেন, ‘এই নির্বাচন শুধু একটি দিন নয়; এটি একটি গৌরবময় দায়িত্ব ও ঐতিহাসিক সুযোগ। আমাদের সুচিন্তিত ও দায়িত্বশীল ভোটই নির্মাণ করবে নতুন বাংলাদেশ। শহীদদের রক্তদান সার্থক হবে। তাই এখন থেকেই আপনার ভোটের গুরুত্ব অনুধাবন করুন, মতবিনিময় করুন, সিদ্ধান্ত নিন।’

ভাষণের শেষ মুহূর্তে তিনি সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা জানান এবং দেশবাসীর শান্তি ও কল্যাণ কামনা করে বক্তব্য শেষ করেন।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *