সেপ্টেম্বরের ২২ দিনে রেমিট্যান্স এল ২৫৫৫৯ কোটি টাকা

■ নাগরিক প্রতিবেদক ■ 

সেপ্টেম্বরের প্রথম ২২ দিনে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ২০৯ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় ২৫ হাজার ৫৫৯ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ১২২ টাকা ধরে)।

মঙ্গলবার (২৩ সেপ্টেম্বর) এ তথ্য জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান।

তিনি জানান, গত বছরের সেপ্টেম্বরের প্রথম ২২ দিনে রেমিট্যান্স আসে ১৭৬ কোটি ৯০ লাখ মার্কিন ডলার। তুলনামূলকভাবে এ বছর প্রবাসী আয় বেড়েছে ৩২ কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলার, যা শতকরা ১৮.৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের ২২ দিন পর্যন্ত) দেশে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স প্রায় ৭০০ কোটি মার্কিন ডলার পৌঁছেছে। তুলনামূলকভাবে গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের একই সময়ে রেমিট্যান্স ছিল ৫৯০ কোটি ডলার। অর্থবছর ভিত্তিতে এ সময়ে রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি ১৮.৪০ শতাংশ।

এর আগে চলতি অর্থবছরের জুলাই মাসে দেশে এসেছে ২৪৭ কোটি ৭৯ লাখ ১০ হাজার ডলার রেমিট্যান্স, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩০ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা। আগস্টে পুরো মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ২৪২ কোটি ২০ লাখ ডলার বা ২৯ হাজার ৫৪৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা।

মূলত হুন্ডি বন্ধ হওয়ায় বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ছে। এর পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকও বৈধপথে রেমিট্যান্স পাঠাতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। উৎসবকেন্দ্রিক আয় বৃদ্ধি ও অবৈধ পথে পাঠাতে নিরুৎসাহিত করায় রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নানামুখী তৎপরতায় অর্থ পাচার বন্ধ হওয়ায় এখন রেমিট্যান্স অব্যাহতভাবে বাড়ছে। সেই সঙ্গে ডলারের আনুষ্ঠানিক দরও অনেকটা বাড়ানো হয়েছে। এখন খোলাবাজারের সঙ্গে ব্যাংকের ডলার দরে খুব বেশি পার্থক্য নেই। ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠালে আড়াই শতাংশ হারে প্রণোদনা পান প্রবাসীর সুবিধাভোগীরা। সব মিলিয়ে বৈধভাবে বা ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে সর্বোচ্চ দর পাচ্ছেন গ্রাহক। বর্তমানে বাজারভিত্তিক করার পরও ডলারের দর স্থিতিশীল রয়েছে।

আইএমএফের পরামর্শে গতবছরের ৮ মে ডলার দরে ‘ক্রলিং পেগ’ চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই সময় এক লাফে প্রতি ডলারে ৭ টাকা বাড়িয়ে মধ্যবর্তী দর ঠিক করা হয় ১১৭ টাকা। এরপর ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স দ্রুত বাড়ছিল। তবে জুলাই আন্দোলন শুরুর পর রেমিট্যান্স শাটডাউনের ডাক, ব্যাংক বন্ধসহ বিভিন্ন কারণে প্রবাসী আয়ে ছন্দপতন হয়। জুলাই মাসে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স আসে তা ছিল ১০ মাসের মধ্যে সর্বনিন্ম। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর অর্থপাচারের বিরুদ্ধে কড়াকড়িসহ বিভিন্ন কারণে রেমিট্যান্স বাড়ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪–২৫ অর্থবছরে বৈধ চ্যানেলে মোট ৩০ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন বা ৩ হাজার ৩৩ কোটি ডলার প্রবাসী আয় দেশে এসেছে। আগের অর্থবছর এসেছিল ২ হাজার ৩৯১ কোটি ডলার। এর মানে রেমিট্যান্স বেড়েছে ৬৪১ কোটি ডলার বা ২৬ দশমিক ৮২ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সামগ্রিক পরিস্থিতির উন্নতির কারণে গত জুন শেষে বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভ বেড়ে ৩১ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলারে উঠেছে। গত ২৮ মাসের মধ্যে যা সর্বোচ্চ। এর আগে সর্বশেষ ২০২৩ সালের মার্চের শুরুতে রিজার্ভ ৩২ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমেছিল। আর জুন শেষে বিপিএম ৬ অনুযায়ী রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২৬ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩ সালের জুন থেকে আইএমএফের শর্ত মেনে হিসাব প্রকাশ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই সময় রিজার্ভ ছিল ২৪ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার। দেশের ইতিহাসে রিজার্ভ সর্বোচ্চ ৪৮ বিলিয়ন ডলারের ঘর অতিক্রম করে ২০২১ সালের আগস্টে। সেখান থেকে কমতে–কমতে আওয়ামী লীগ পতনের সময় রিজার্ভ নেমে আসে ২০ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলারে।

২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাইয়ে ১৯৭ কোটি ৩১ লাখ, আগস্টে ১৫৯ কোটি ৯৪ লাখ, সেপ্টেম্বর মাসে ১৩৩ কোটি ৪৩ লাখ, অক্টোবরে ১৯৭ কোটি ১৪ লাখ, নভেম্বর ১৯৩ কোটি, ডিসেম্বরে ১৯৯ কোটি ১২ লাখ, জানুয়ারিতে ২১১ কোটি ৩১ লাখ, ফেব্রুয়ারিতে ২১৬ কোটি ৪৫ লাখ, মার্চ মাসে ১৯৯ কোটি ৭০ লাখ, এপ্রিলে এসেছে ২০৪ কোটি ৪২ লাখ, মে মাসে এসেছে ২২৫ কোটি ৩৮ লাখ এবং জুন মাসে এসেছিল ২৫৪ কোটি ১৬ লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স।

দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেকর্ড রেমিট্যান্স এসেছিল ২০২০-২১ অর্থবছরে দুই হাজার ৪৭৭ কোটি ডলার।

২০২৩ সালে প্রবাসীরা ২ হাজার ১৯২ কোটি (২১ দশমিক ৯২ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠান। ২০২২ সালে আসে দুই হাজার ১২৭ কোটি ডলার বা ২১ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার। এর আগে ২০২১ সালে প্রবাসীরা রেকর্ড পরিমাণ দুই হাজার ২০৭ কোটি ৮৫ লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। ২০২০ সালে দুই হাজার ১৭৪ কোটি ১৮ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। ২০১৯ সালে এক হাজার ৮৩৩ কোটি মার্কিন ডলার, ২০১৮ সালে এক হাজার ৫৫৩ কোটি ৭৮ লাখ ডলার, ২০১৭ সালে এক হাজার ৩৫৩ কোটি ডলার, ২০১৬ সালে এক হাজার ৩৬১ কোটি ডলার এবং ২০১৫ সালে এক হাজার ৫৩১ কোটি মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স আসে দেশে।

২০১৯-২০ অর্থবছরে এক হাজার ৮২০ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলার, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের এক হাজার ৬৩১ কোটি ডলার, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এক হাজার ৪৯৮ কোটি ডলার, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এক হাজার ২৭৬ কোটি ৯৪ লাখ ডলার, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এক হাজার ৪৯৩ কোটি ডলার এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরে রেমিট্যান্স এক হাজার ৫৩১ কোটি ৬৯ লাখ ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা।

এর আগে দেশের ইতিহাসে একক মাসে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স ২৬০ কোটি ডলার এসেছিল ২০২০ সালের জুলাই মাসে। বছরওয়ারি হিসাবে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আসে ২০২০-২১ অর্থবছরে। ওই অর্থবছরে মোট রেমিট্যান্স আসে ২৪ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৪৭৮ কোটি ডলার। আর চলতি বছরের জুন মাসে ব্যাংকিং চ্যানেলে মোট ২৫৪ কোটি ডলারের প্রবাসী আয় দেশে এসেছে।

গণভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরও রেমিটেন্স প্রবাহে ধীরগতি ছিল। ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যাত্রা শুরু হয় অন্তর্বর্তী সরকারের; রেমিট্যান্স প্রবাহেও গতি ফেরে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকার পতনের পর থেকে রেমিট্যান্সসহ বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বৃদ্ধির প্রধান কারণ হুন্ডি চাহিদা কমেছে। বাণিজ্যের আড়ালে কিম্বা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ যারা দেশের বাইরে পাঠাতো তাদের বেশিরভাগই এখন দৌড়ের ওপরে আছে। ভোগ্যপণ্যসহ বিভিন্ন আমদানিতে কম মূল্য দেখিয়ে এলসি খোলার প্রবণতা কমেছে। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে অর্থ পাচারে কড়াকড়ি করছে সরকার। আবার ঋণ জালিয়াতি, রাজস্ব ফাঁকি, অর্থপাচারসহ বিভিন্ন অনিয়মে অভিযুক্ত ১০টি গ্রুপের অনিয়ম তদন্তে যৌথ টিম কাজ করছে। নতুন করে পাচারের সুযোগ তো দূরে থাক, উল্টো আগে পাচার করা অর্থ দেশে আনার চেষ্টা চলছে। এসব কারণে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি বাড়ছে। চলতি অর্থবছরের নভেম্বর পর্যন্ত ৫ মাসে রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ১৩ শতাংশ।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *