জুলাইয়ে রেমিট্যান্স কমলো ৭৫০০ কোটি টাকা

:: নাগরিক প্রতিবেদন ::

জুলাই মাসে ১৯০ কোটি ডলার বা ১ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা গত ১০ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। চলতি বছরের জুন মাসের তুলনায় জুলাই মাসে রেমিট্যান্স কমেছে ৬৩ কোটি ২০ লাখ ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা।

এতে জুলাই শেষে দেশের গ্রস রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২৫ দশমিক ৯২ বিলিয়ন ডলার, যা বিপিএম-৬ পদ্ধতির হিসাবে ২০ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার। সেখান থেকে দায় বাবদ প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার বাদ দিলে ব্যয়যোগ্য রিজার্ভ দাঁড়াবে প্রায় সাড়ে ১৪ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত জুলাই মাসে ১৯০ কোটি ৯০ লাখ ডলার প্রবাসী আয় দেশে এসেছে। তার আগের মাস জুনে এসেছে ২৫৪ কোটি ১৬ লাখ ডলার। সে হিসাবে এক মাসে রেমিট্যান্স কম এসেছে ৬৩ কোটি ২৬ লাখ ডলার। এর আগে, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৩৩ কোটি ডলার। আর আগের বছরের একই মাসে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৯৭ কোটি ডলার। সে হিসেবে কমেছে ৭ কোটি ডলার বা ৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ। গত মে পর্যন্ত রপ্তানি আয় কমেছে ৫ দশমিক ৯০ শতাংশ। এরকম পরিস্থিতির মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আবার কমে এসেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, ‘রেমিট্যান্সের হিসাব এক মাসে তুলনা করলে হবে না। একটা বিশেষ কারণে হয়তো এ মাসে কমেছে, যা পরিবেশ স্বাভাবিক হলে বাড়বে। এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু দেখছি না।’

নিয়ম অনুযায়ী প্রতিমাসের প্রথম কার্যদিবসে আগের মাসের রেমিট্যান্সের তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। কিন্তু বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা প্রকাশ করেনি। বিকালে সাংবাদিকরা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হকের কাছে রেমিট্যান্সের তথ্য জানতে চাইলে বলা হয়, এখনো প্রতিবেদন কমপ্লিট হয়নি। কাজ চলছে, কমপ্লিট হলে জানানো হবে। পরে বিকাল ৫টার দিকে প্রতিবেদন প্রকাশ না করে সংক্ষিপ্তভাবে শুধু জুলাই মাসে কত ডলার এসেছে তা হোয়াটসঅ্যাপে দেন। মুখপাত্র জানান, জুলাই মাসে ১৯০ কোটি ৯০ লাখ ডলার প্রবাসী আয় দেশে এসেছে। যা আগের বছর জুলাই মাসে ছিল ১৯৭ কোটি ৩০ লাখ ডলার। যদিও আগের মাস জুনেও রেমিট্যান্স এসেছিল ২৫৪ কোটি ১৬ লাখ ডলার। সে হিসাবে এক মাসের ব্যবধানে রেমিট্যান্স কমেছে ৬৩ কোটি ২৬ লাখ ডলার। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গেল ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৯৭ কোটি ৩১ লাখ, আগস্টে ১৫৯ কোটি ৯৪ লাখ, সেপ্টেম্বর মাসে ১৩৩ কোটি ৪৩ লাখ, অক্টোবরে ১৯৭ কোটি ১৪ লাখ, নভেম্বর ১৯৩ কোটি, ডিসেম্বরে ১৯৯ কোটি ১২ লাখ, ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ২১১ কোটি ৩১ লাখ, ফেব্রুয়ারিতে ২১৬ কোটি ৪৫ লাখ, মার্চ মাসে ১৯৯ কোটি ৭০ লাখ, এপ্রিলে এসেছে ২০৪ কোটি ৪২ লাখ, মে মাসে এসেছে ২২৫ কোটি ৩৮ লাখ এবং জুন মাসে আছে ২৫৪ কোটি ১৬ লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স। 

সূত্র জানায়, দেশে কোটা সংস্কার নিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ইন্টারনেট বন্ধ থাকাসহ নানা কারণে চলতি মাসে রেমিট্যান্স কমে গেছে। আন্দোলনে সহিংসতায় বহু হতাহতের প্রতিবাদে দেশে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স না পাঠানোর বিষয়ে ক্যাম্পেইন করছেন অনেক প্রবাসী। তবে সব মিলিয়ে রেমিট্যান্স কমেছে তা প্রমাণিত। লক্ষণীয়, গত ১৯ থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত ৬ দিনে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ৮ কোটি ডলার। কিন্তু গত জুন মাসে প্রতিদিন গড়ে ৮ কোটি ডলারের বেশি রেমিট্যান্স এসেছিল। জুলাই মাসের প্রথম ভাগে এক দিনে যে পরিমাণ প্রবাসী আয় এসেছিল, সর্বশেষ গত ৬ দিনে এসেছে তার সমপরিমাণ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, ‘দেশপ্রেমিক প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলেই রেমিট্যান্স পাঠাবেন। তাঁরা বিদেশে শুধু নিজের জন্য কাজ করেন না। তাঁদের পরিবার বাংলাদেশেই থাকে। পরিবারের জন্য হলেও তাঁরা টাকা পাঠাবেন। তাই বিপরীতমুখী প্রচারণায় কাজ হবে না বলে আমার বিশ্বাস।’

বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে গত ৮ মে ‘ক্রলিং পেগ’ চালুর পর ডলারের দর এক লাফে ৭ টাকা বেড়ে মধ্যবর্তী দর ১১৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়।

সাধারণত তিনভাবে কোনো দেশের মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারিত হয়ে থাকে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে স্থির বিনিময় হার। দ্বিতীয় পদ্ধতিটি হচ্ছে বাজারভিত্তিক বিনিময় হার। আর ক্রলিং পেগ হলো এদের মধ্যবর্তী একটি পদ্ধতি যেখানে বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্গে বিনিময় হারের একটি উচ্চ ও নিম্ন সীমা নির্ধারণ করা থাকে। এভাবে অস্থিরতার সময় দেশীয় মুদ্রার মূল্য এবং হারের সীমা ঘন ঘন সমন্বয় করা হয়। তবে ক্রলিং পেগ পদ্ধতি অনুসরণ কোনো অর্থনীতির জন্য সুখকর নয়। সাধারণত উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও স্থানীয় মুদ্রার সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের ঘন ঘন অবমূল্যায়ন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস ইত্যাদি কারণে অস্থির একটি অর্থনীতি যখন একদম তলানিতে চলে যায় তখন উপায়ন্তর না দেখে এ পদ্ধতিকে শেষ ভরসা মানতে হচ্ছে। 

ফলে দুই মাসের বেশি সময় ধরে ডলারের দর ১১৭ থেকে ১১৮ টাকায় স্থিতিশীল ছিল। এখন এটা বাড়তে শুরু করেছে। 

আইএমএফসহ বিভিন্ন উৎস থেকে গত জুনে ২ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ পেয়েছিল বাংলাদেশ। এতে করে বিপিএম৬ অনুযায়ী জুন শেষে নিট রিজার্ভ দাঁড়িয়েছিল ১৬ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার। জুলাই মাসের শুরুর দিকে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নে (আকু) ১ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হয়।

দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারের ঘর অতিক্রম করে ২০২১ সালের আগস্টে। তবে করোনা পরবর্তী অর্থনীতিতে বাড়তি চাহিদা এবং রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি, বিদেশি ঋণ ও বিনিয়োগ কমে যাওয়া এবং আগের দায় পরিশোধ বেড়েছে। গত ৩ অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৩৩ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে। সব মিলিয়ে ধারবাহিকভাবে রিজার্ভ কমছে।

রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার খবরে খোলাবাজারে মা‌র্কিন ডলারের দাম বেড়ে ১২৫ টাকায় উঠেছে। বুধবার মানি চেঞ্জার গুলোর সংগঠন ‘মানি চেঞ্জারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’ থেকে বলা হয় খুচরা প্রতি ডলারের মূল্য সর্বোচ্চ ১১৯ টাকার বেশি বিক্রি করা যাবে না। তবে মানি চেঞ্জারদের এ নির্দেশনা মানেনি কেউ। দাম না কমে উল্টো বেড়েছে। বিভিন্ন মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বৃহস্পতিবার খোলাবাজারে এক ডলার কিনতে গ্রাহককে গুনতে হচ্ছে ১২৫ টাকা ৫০ পয়সা।    

বাজারে ডলার সংকট কাটাতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় বা রিজার্ভ থেকে ধারাবাহিক ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি অর্থবছরের (২০২৩-২৪) প্রথম ছয় মাসে ৬৭০ কোটি ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একই সময়ে বাণিজ্যিক কিছু ব্যাংক থেকে এক বিলিয়ন ডলারের মতো কেনে বাংলাদেশ ব্যাংক এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ১৩ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছিল। আর আগের অর্থবছরে ডলার বিক্রি করেছিল ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার।

উল্লেখ্য, ১৯৮১-৮২ অর্থবছর থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১২ কোটি ১০ লাখ ডলার।

পাঁচ বছর পর ১৯৮৬-৮৭ অর্থবছর শেষে সেই রিজার্ভ বেড়ে হয় ৭১ কোটি ৫০ লাখ ডলার। ১৯৯১-৯২ অর্থবছর শেষে রিজার্ভ ১০০ কোটি (১ বিলিয়ন) ডলার অতিক্রম করে ১ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলারে ওঠে। পরের ১৯৯২-৯৩ অর্থবছর শেষে রিজার্ভ ২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে ২ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়।

৩ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে ১৯৯৪-৯৫ অর্থবছর শেষে। ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছর শেষে তা কমে ২ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। ১৯৯৬-৯৭ অর্থবছরে তা আরও কমে ১ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে।

এরপর ১৯৯৭-৯৮ থেকে ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছর পর্যন্ত রিজার্ভ দেড় থেকে দুই বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ওঠানামা করে।

২০০০-০১ অর্থবছরে রিজার্ভ কমে ১ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি নেমে আসে। ওই অর্থবছর শেষে রিজার্ভ ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার থাকলেও অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে তা ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারে নেমে গিয়েছিল। তখনই আকুর বিল পুরোটা পরিশোধ না করে অর্ধেক করা হয়েছিল।

২০০১-০২ অর্থবছর শেষে রিজার্ভ বেড়ে হয় ১ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার।

২০০৫-০৬ অর্থবছর শেষে রিজার্ভ ৫ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে ১০ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। ২০১২-১৩ অর্থবছরে তা ১৫ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে।

২০১৪ সালের ১০ এপ্রিল রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। পরের বছর ২০১৫ সালের ২৫ জানুয়ারি রিজার্ভ ২৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। ২০১৬ সালের জুনে রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে।

দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর ২০২০ সালের মার্চ শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। মহামারির এই সময়েই রিজার্ভ বেড়েছে সাড়ে ১২ বিলিয়ন ডলার।

২০২০ সালের ৩ জুন বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো রিজার্ভ ৩৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। তিন সপ্তাহের ব্যবধানে ২৪ জুন সেই রিজার্ভ আরও বেড়ে ৩৫ বিলিয়ন ডলার হয়।

২০২০ সালের ৩০ জুন রিজার্ভ ৩৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। এক মাস পর ২৮ জুলাই রিজার্ভ ৩৭ বিলিয়ন ডলারের ঘরও অতিক্রম করে। তিন সপ্তাহ পর গত ১৭ আগস্ট রিজার্ভ ৩৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়।

২০২০ সালের মাত্র দেড় মাসে ৩৪ বিলিয়ন ডলার থেকে রিজার্ভ ৪ বিলিয়ন ডলার বেড়ে ৩৮ বিলিয়ন ডলারে ওঠে।

২০২০ সালের ১ সেপ্টেম্বর রিজার্ভ ছাড়ায় ৩৯ বিলিয়ন ডলার। ৮ অক্টোবর ছাড়ায় ৪০ বিলিয়ন ডলার। ২৯ অক্টোবর অতিক্রম করে ৪১ বিলিয়ন ডলার। ৪২ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায় ১৫ ডিসেম্বর।

২০২০ সালের ৩০ ডিসেম্বর ৪৩ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করে রিজার্ভ।

২০২১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ৪৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়।

২০২১ সালের ২৮ এপ্রিল অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে রিজার্ভ ৪৫ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। একই বছরের ৪ মে আকুর ১ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ ৪৪ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *