:: নাগরিক প্রতিবেদন ::
বাজেটে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী নতুন করে মূলধনি মুনাফার ওপর করারোপের এ প্রস্তাব করেছেন। যদিও বাজেটের আগে থেকেই শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের দাবি ছিল, ব্যক্তিশ্রেণির বিনিয়োগকারীদের ক্ষেত্রে নতুন করে যেন করারোপ করা না হয়। কিন্তু সেই দাবি পূরণ হয়নি।
৫০ লাখ টাকার বেশি মুনাফায় কর দিতে হবে
অর্থমন্ত্রী বাজেটে প্রস্তাব করেছেন, ব্যক্তিশ্রেণির বিনিয়োগকারীদের ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত মূলধনি মুনাফায় কোনো কর বসবে না। তবে ৫০ লাখ টাকার বেশি মুনাফা করলে তার ওপর কর দিতে হবে। উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, সেকেন্ডারি বাজারে শেয়ার লেনদেন করে কোনো বিনিয়োগকারী এক বছরে ৫৫ লাখ টাকা মুনাফা করেছেন। সে ক্ষেত্রে মুনাফার ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত করমুক্ত–সুবিধার আওতায় থাকবে। বাকি ৫ লাখ টাকা মুনাফা ওই বিনিয়োগকারীর মোট আয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে। তাতে ওই বিনিয়োগকারীর নির্দিষ্ট একটি অর্থবছরে তার মোট আয়ের ওপর যে হারে কর প্রযোজ্য হবে, সেই হারে কর দিতে হবে। তবে কোনো বিনিয়োগকারী যদি কোনো শেয়ার একটানা ৫ বছর ধরে রেখে ৫০ লাখ টাকার বেশি মুনাফা করেন, সে ক্ষেত্রে ওই মুনাফার ওপর ১৫ শতাংশ হারে করারোপ হবে।
বাজেটে আরও প্রস্তাব করা হয়েছে, ব্যক্তিশ্রেণির বিনিয়োগকারীর বাইরে কোনো করপোরেট প্রতিষ্ঠান শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে যে মুনাফায় করুক, সেই মুনাফার ওপর করারোপ হবে।
বাজার–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ৯০ শতাংশই প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী। তাদের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালক, প্লেসমেন্ট শেয়ারধারী, স্টক ব্রোকার, ডিলার। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের সবাই মূলধনি মুনাফার ওপর সর্বনিম্ন ৫ থেকে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ হারে কর দেন। মূলধনি মুনাফার ওপর কর দেন না শুধু ব্যক্তিশ্রেণির সাধারণ বিনিয়োগকারীরা, যা শেয়ারবাজারের মোট বিনিয়োগকারীর মাত্র ১০ শতাংশ।
মূলধনি মুনাফার ওপর করারোপের বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশের পর থেকে বিষয়টি আলোচনায় আসে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) কর্তৃপক্ষ সংবাদ সম্মেলন করে এই করারোপ না করার দাবি জানায়। তবে শেয়ারবাজার–সংশ্লিষ্ট সেই দাবি শেষ পর্যন্ত রাখেননি অর্থমন্ত্রী।
এ ছাড়া নতুন বাজেটে শেয়ারবাজারে ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্তি উৎসাহিত করতে তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত কোম্পানির করপোরেট করহারের ব্যবধান বাড়ানোরও প্রস্তাব করা হয়েছিল। সেই সঙ্গে তালিকাভুক্ত কোম্পানির কর হার কমিয়ে সাড়ে ১৭ শতাংশ করার দাবি করেছিল ডিএসই কর্তৃপক্ষ। আর অতালিকাভুক্ত কোম্পানির ক্ষেত্রে তা বাড়িয়ে সাড়ে ৩৭ থেকে ৪০ শতাংশ করার দাবি করা হয়। কিন্তু অর্থমন্ত্রী এই দাবিও আমলে নেননি।
আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে করপোরেট কর হারে কোনো পরিবর্তন আনেননি অর্থমন্ত্রী। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানি যদি তাদের পরিশোধিত মূলধনের ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার বাজারে ছাড়ে, তাহলে ওই কোম্পানির ক্ষেত্রে শর্ত সাপেক্ষে করপোরেট কর আগের মতোই ২০ শতাংশ অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। শর্ত পূরণ না করলে তালিকাভুক্ত কোম্পানির ক্ষেত্রে এ করহার হবে সাড়ে ২২ শতাংশ। আর যেসব কোম্পানি পরিশোধিত মূলধনের ১০ শতাংশের কম শেয়ার বাজারে ছাড়বে, তাদের ক্ষেত্রে শর্ত পরিপালন সাপেক্ষে করপোরেট করহার হবে সাড়ে ২২ শতাংশ। এ ধরনের কোম্পানির ক্ষেত্রে যারা শর্ত পালন করবে না, তাদের ক্ষেত্রে এ করহার হবে ২৫ শতাংশ।
তালিকাভুক্ত কোম্পানির ক্ষেত্রে আড়াই শতাংশ কম করপোরেট করের সুবিধা পেতে যে শর্ত দেওয়া হয়েছে, সেটি হলো যেসব কোম্পানি ৫ লাখ টাকার বেশি একক লেনদেন ও বার্ষিক ৩৬ লাখ টাকার বেশি লেনদেন ব্যাংকের মাধ্যমে করতে হবে। এ শর্ত পালন না করলে কোম্পানিগুলো কম করপোরেট করের সুবিধা পাবেন না।
তিন বছর কর অব্যাহতি পেল তথ্যপ্রযুক্তি খাত
তিন বছরের জন্য কর অব্যাহতি পেল দেশের তথ্য প্রযুক্তি (আইসিটি) খাত। তবে বর্তমানে এই খাতের ২৭টি উপখাতে কর অব্যাহতির সুবিধা থাকলেও সেই সুবিধা কিছুটা কমে ২০টি খাতে নেমে আসতে পারে।
এদিন সংসদে অর্থমন্ত্রী বাজেট প্রস্তাবনায় বলেন, স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের সহায়ক হিসেবে আমি কোনো নিবাসী ব্যক্তি বা অনিবাসী বাংলাদেশি স্বাভাবিক ব্যক্তির নিম্নবর্ণিত ব্যবসা থেকে উদ্ভূত আয়, ওই ব্যক্তির সব ব্যবসায়িক কার্যক্রম ক্যাশলেস হওয়ার শর্তে তিন বছর করমুক্ত করার প্রস্তাব করছি।
খাতগুলো হলো— এআই বেজড্ সলিউশন ডেভেলপমেন্ট, ব্লকচেইন বেজড্ সলিউশন ডেভেলপমেন্ট, রোবোটিক্স প্রসেস আউটসোর্সিং, সফটওয়্যার অ্যাজ আ সার্ভিস, সাইবার সিকিউরিটি সার্ভিস, ডিজিটাল ডেটা অ্যানালাইটিক্স ও ডেটা সায়েন্স, মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট সার্ভিস, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট ও কাস্টমাইজেশন, সফটওয়্যার টেস্ট ল্যাব সার্ভিস, ওয়েব লিস্টিং, ওয়েবসাইট ডেভেলপমেন্ট ও সার্ভিস, আইটি সহায়তা ও সফটওয়্যার মেইনটেন্যান্স সার্ভিস, জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিস, ডিজিটাল অ্যানিমেশন ডেভেলপমেন্ট, ডিজিটাল গ্রাফিক্স ডিজাইন, ডিজিটাল ডেটা এন্ট্রি ও প্রসেসিং, ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম ও ই-পাবলিকেশন, আইটি ফ্রিল্যান্সিং, কল সেন্টার সার্ভিস, ডকুমেন্ট কনভারশন এবং ইমেজিং ও ডিজিটাল আর্কাইভিং।
এই আইটি সেবাগুলোকে ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৭ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত করমুক্ত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে এসব সেবার ব্যবসা থেকে উদ্ভূত আয়, সব ব্যবসায়িক কার্যক্রম ‘ক্যাশলেস’ হওয়ার শর্ত দেওয়া হয়েছে প্রস্তাবনায়। পাশাপাশি অপটিক্যাল ফাইবার কেবলের উৎপাদন পর্যায়ে ৫ শতাংশের অতিরিক্ত মূল্য সংযোজন কর (মূসক) অব্যাহতির মেয়াদও আগামী ২০২৭ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থ্যাৎ আইটি খাত সংশ্লিষ্ট উল্লিখিত সেবা ও পণ্য আরও ৩ বছর কর অব্যাহতি সুবিধা পাচ্ছে।
এফবিসিসিআই উপদেষ্টা ও বেসিসের সাবেক সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবীর তিন বছরের কর অব্যাহতি এবং অব্যাহতিপ্রাপ্ত সেবার তালিকা বৃদ্ধিকে স্বাগত জানান। তিনি বলেন, আইটি প্রসেস আউটসোর্সিং, মেডিকেল ট্রান্সক্রিপশন, সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন—এই সেক্টরগুলোতে প্রচুর পরিমাণে পরিষেবা রপ্তানি করি। এসবের ওপর কর অব্যাহতি না থাকলে খরচ বেড়ে যাবে, ফলে রপ্তানি বাজারে প্রতিযোগিতার সামর্থ্য হারাবে এবং রপ্তানি কমে যাবে।
হাইটেক পার্ক বা এ ধরনের অর্থনৈতিক অঞ্চলের ডেভেলপার এবং বিনিয়োগকারীরা শূন্য শতাংশ (০%) আমদানি শুল্ক সুবিধা ভোগ করে আসছিলেন। বাজেটে এই সুবিধা কর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে। হাইটেক পার্কে অবস্থিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক মূলধনি যন্ত্রাংশ ও নির্মাণ সামগ্রী আমদানিতে দুই ধরনের পণ্য সামগ্রীতে শূন্য শতাংশ আমদানি শুল্কের পরিবর্তে ১ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। পাশাপাশি ডেভেলপার কর্তৃক উন্নয়ন কাজে ব্যবহৃত পণ্য আমদানিতে শূন্য শতাংশ আমদানি শুল্কের পরিবর্তে ৫ শতাংশ নির্ধারণে সুপারিশ করেছেন অর্থমন্ত্রী।
এ বিষয়ে বেসিসের পরিচালক ও হাইটেক পার্কে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান বন্ডস্টাইন টেকনোলজিস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, বিভিন্ন ধরনের কর রেয়াতি সুবিধার প্রতিশ্রুতি দিয়েই হাইটেক পার্কে বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করা হয়েছে। দেশে ২৮টি হাইটেক পার্ক রয়েছে, যেগুলোতে শতাধিক দেশি-বিদেশি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ রয়েছে। ২০২৫ সাল নাগাদ এসব পার্কে ৩ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রত্যাশা রয়েছে। তবে বিনিয়োগকারীদের জন্য শুরুতেই একটি বাধা হিসেবে কাজ করবে শুল্ক বৃদ্ধির এ সিদ্ধান্ত। বিশেষ করে, সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগে প্রভাব ফেলবে বিষয়টি।