২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি বাজেট

:: নাগরিক প্রতিবেদন ::

২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। এ বাজেটে অনুদান ছাড়া ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫৬ হাজার টাকা।

বৃহস্পতিবার (৬ জুন) জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব তুলে ধরেন অর্থমন্ত্রী।

মূল্যস্ফীতি কমিয়ে বড় প্রবৃদ্ধির আশাবাদ ব্যক্ত করে অর্থমন্ত্রী যে বাজেট প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন সেখানে অনুদান ছাড়া ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। অনুদানসহ সামগ্রিক ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এছাড়া ৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকা অনুদান পাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এ ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ২৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করা হবে ৩৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এতে নিট বৈদেশিক ঋণ দাঁড়াবে ৯০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা।

আর অভ্যন্তরীণ ঋণ নেয়া হবে ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নেয়া হবে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি, যার ৭২ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা দীর্ঘমেয়াদি ঋণ এবং ৬৪ হাজার ৮১৮ কোটি টাকা স্বল্পমেয়াদি ঋণ। ব্যাংকবহির্ভূত ঋণ নেয়া হবে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।

প্রস্তাবিত বাজেটে ঋণের সুদ পরিশোধের ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ ৯৩ হাজার কোটি টাকা। আর বৈদেশিক ঋণের সুদ ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।

এবার রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। এনবিআর বহির্ভূত কর ধরা হয়েছে ১৫ হাজার কোটি টাকা। আর কর ব্যতীত প্রাপ্তির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪৬ হাজার কোটি টাকা।

প্রস্তাবিত বাজেটে পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। পরিচালন ব্যয়ের মধ্যে আবর্তক ব্যয় ৪ লাখ ৬৮ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা। আর দেশী-বিদেশী ঋণের সুদ পরিশোধ ১ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এবার মূলধন ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৭ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকা।

প্রস্তাবিত বাজেটে উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৮১ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে স্কিমে ব্যয় হবে ৫ হাজার ৯৪৩ কোটি টাকা। এডিপি বহির্ভূত বিশেষ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৭ হাজার ৬২৭ কোটি টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। আর কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি (এডিপি বহির্ভূত) ও স্থানান্তরে ২ হাজার ৮৮৪ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে।

খাতভিত্তিক বরাদ্দ

খাতভিত্তিক বরাদ্দ হলো— প্রাথমিক ও গণশিক্ষায় ৩৮ হাজার ৮১৯ কোটি, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষায় ৪৪ হাজার ১০৮ কোটি টাকা, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ১১ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা, স্বাস্থ্যসেবা এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণে ৪১ হাজার ৪০৭ কোটি, জননিরাপত্তা খাতে ২৬ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন খাতে ৪৬ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ৩০ হাজার ৩১৭ কোটি টাকা, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে ১১ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে ২ হাজার ২১১ কোটি ৯৫ লাখ টাকা, প্রতিরক্ষা খাতে ৪২ হাজার ১৪ কোটি টাকা, কৃষি খাতে ৩৮ হাজার ২৫৯ কোটি টাকা, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের জন্য ১ হাজার ২১৭ কোটি টাকা, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ে দুই হাজার ১৩০ কোটি টাকা, পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে ৮০ হাজার ৪৯৮ কোটি টাকা, শিল্প খাতে ২ হাজার ৫১০ কোটি টাকা, সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ খাতে ১ লাখ ৩৬ হাজার ২৬ কোটি এবং ধর্ম ও সংস্কৃতি খাতে ব্যয় হবে ৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা।

দাম বাড়বে

মোবাইলের এসএমএস-কলরেট, সিগারেট, এয়ারকন্ডিশনার ও রেফ্রিজারেটর, কাজু বাদাম, আইসক্রিম, পানির ফিল্টার, এলইডি বাল্ব, গাড়ি কনভার্সন খরচ, ফার্নেস অয়েল, লুব অয়েল, মিনারেল লুব অয়েল ও বেজ অয়েল, ফিলিং স্টেশন স্থাপন, সিএনজি কনভার্সন কিট ও সিলিন্ডার, বিদ্যুৎকেন্দ্রের ইকুইপমেন্ট, ইপিজেডের আমদানিকৃত যন্ত্রপাতি ও নির্মাণ সামগ্রী, কার্বনেটেড বেভারেজ, এমিউজমেন্ট পার্ক, থিম পার্ক ও পর্যটন।

দাম কমবে

চাল, ভোজ্যতেল, চিনি, গুঁড়ো দুধ, চকলেট, ল্যাপটপ, মোটরসাইকেল, ডেঙ্গুর চিকিৎসাসামগ্রী, আমদানিকৃত কিডনি ডায়ালাইসিস ফিল্টার ও সার্কিট, ক্যানসার চিকিৎসা সরঞ্জাম, কার্পেট, সুইচ-সকেট, ইলেকট্রিক মোটর, লোহা জাতীয় পণ্য (রড, বার ও এঙ্গেল), উড়োজাহাজের যন্ত্রাংশ ও মিথানল।

দাম বাড়ার কারণ

  • এসএমএস-কলরেট: সম্পূরক শুল্ক বাড়ায় মোবাইল ফোনের এসএমএস ও কলরেটে খরচ বাড়তে পারে।
  • জ্বালানি খাত: ফার্নেস অয়েল, লুব অয়েল, মিনারেল লুব অয়েল ও বেজ অয়েলের ন্যূনতম শুল্কায়ন মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করার প্রস্তাব করায় এসব পণ্যের শুল্ককর বাড়তে পারে।
  • সিগারেট: প্রতিবারের মতো এবারও সিগারেট উৎপাদন পর্যায়ে সম্পূরক শুল্ক ও মূল্যস্তর বাড়ানো হয়েছে। তাই সব ধরনের সিগারেটের দাম বাড়তে পারে। সিগারেটের ক্ষেত্রে বিভিন্ন স্তরে সম্পূরক শুল্ক ৬০ থেকে ৬৫ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।
  • ফিলিং স্টেশন স্থাপন, সিএনজি কনভার্সন কিট ও সিলিন্ডার: সিএনজি এলপিজি ফিলিং স্টেশন স্থাপন, সিএনজি কনভার্সন কিট, সিলিন্ডার অন্যান্য সরঞ্জামের আমদানি শুল্ক তিন শতাংশ থেকে পাঁচ শতাংশ করার প্রস্তাব করায় ব্যয় বাড়তে পারে এ খাতে।
  • বিদ্যুৎকেন্দ্রের ইকুইপমেন্ট: রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাশাপাশি বিভিন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কেন্দ্রের জন্য ইকুইপমেন্ট ও ইরেকশন ম্যাটেরিয়াল আমদানিতে শূন্য শতাংশ শুল্ককর থেকে বাড়িয়ে পাঁচ শতাংশ করা হয়েছে।
  • ইপিজেডের আমদানিকৃত যন্ত্রপাতি ও নির্মাণ সামগ্রী: অর্থনৈতিক অঞ্চলের মূলধনী যন্ত্রপাতি ও নির্মাণ সামগ্রী আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা (শুল্কমুক্ত) পরিবর্তে এক শতাংশ হারে শুল্ককর আরোপের সুপারিশ করা হয়েছে।
  • এয়ারকন্ডিশনার ও রেফ্রিজারেটর: দেশে এসি উৎপাদনে ব্যবহৃত কম্প্রেসার ও স্টিল সিটের পাশাপাশি রেফ্রিজারেটরের কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। ফলে এয়ারকন্ডিশনার ও রেফ্রিজারেটরের দাম বাড়তে পারে।
  • পানির ফিল্টার: পানি পরিশোধন যন্ত্র দেশে উৎপাদন হওয়ায় পণ্যটি আমদানিতে শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। ফলে গৃহস্থালিতে ব্যবহৃত পানির ফিল্টারের দাম বাড়তে পারে।
  • এলইডি বাল্ব: এনার্জি সেভিং বাল্ব উৎপাদনের উপকরণ আমদানিতে শুল্ক ১০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। তাই এলইডি বাল্বের দাম বাড়তে পারে।
  • গাড়ি কনভার্সন খরচ: গাড়ি সিএনজি-এলপিজিতে কনভার্সনের ব্যবহৃত কিট, সিলিন্ডার ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ আমদানিতে শুল্ক তিন শতাংশ থেকে বাড়িয়ে পাঁচ শতাংশ করা হয়েছে। এ কারণে গাড়ি কনভার্সন খরচ বাড়তে পারে।
  • কাজু বাদাম: দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা দেওয়ার অংশ হিসেবে খোসা ছাড়ানো কাজু বাদাম আমদানিতে শুল্ক পাঁচ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। এতে কাজু বাদামের দাম বাড়তে পারে।

দাম কমার কারণ

  • উড়োজাহাজের যন্ত্রাংশ: দেশীয় বিমান পরিচালনা সংস্থাগুলো বিদেশি সংস্থাগুলোর তুলনায় পিছিয়ে আছে। এই অবস্থায় এভিয়েশন খাতের উত্তরণকল্পে ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা বিবেচনায় এয়ারক্রাফট ইঞ্জিন ও প্রপেলার আমদানিতে ভ্যাট প্রত্যাহার করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
  • গুঁড়ো দুধ: প্যাকেটজাত গুঁড়ো দুধ আমদানিতে ২০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে। এতে আমদানিকৃত গুঁড়ো দুধের দাম কমতে পারে।
  • চকলেট: চকলেট আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক ৪৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করা হয়েছে। এ কারণে চকলেটের দাম কমতে পারে।
  • ল্যাপটপ: ল্যাপটপ আমদানিতে শুল্ক বাড়ানো হলেও ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়েছে। এতে ৩১ শতাংশের পরিবর্তে ২০ দশমিক ৫০ শতাংশ শুল্ককর দিতে হবে বিধায় ল্যাপটপের দাম কমতে পারে।
  • মোটরসাইকেল: সিকেডি ইঞ্জিনের পার্টস আমদানির শুল্ক কমানো হয়েছে। এ কারণে দেশে তৈরি মোটরসাইকেলের দাম কমতে পারে।
  • ডেঙ্গুর চিকিৎসাসামগ্রী: ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন ধরনের কিটসহ সব ধরনের পরীক্ষা সরঞ্জামের ওপর শুল্ককর রেয়াত সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।
  • আমদানিকৃত কিডনি ডায়ালাইসিস ফিল্টার ও সার্কিট: কিডনি রোগী চিকিৎসার অন্যতম সরঞ্জাম ডায়ালাইসিস ফিল্টার ও ডায়ালাইসিস সার্কিট পণ্যের আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে এক শতাংশ করা হয়েছে।
  • ক্যানসার চিকিৎসা সরঞ্জাম: ক্যানসার রোগীর চিকিৎসার ব্যবহৃত কিছু সরঞ্জাম রেয়াতি সুবিধায় যুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
  • কার্পেট: কার্পেট তৈরির প্রধান কাঁচামাল পলিপ্রেপাইলিন ইয়ার্ন আমদানির শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে পাঁচ শতাংশ করা হয়েছে। এতে দেশে তৈরি কার্পেটের দাম কমতে পারে।
  • লোহা জাতীয় পণ্য: রড, বার ও এঙ্গেল তৈরির কাঁচামাল ম্যাঙ্গানিজ আমদানিতে শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে পাঁচ শতাংশ করা হয়েছে। এতে লোহা জাতীয় পণ্যের দাম কমতে পারে।
  • সুইচ-সকেট: দেশে উৎপাদিত সুইচ-সকেট, হোল্ডার উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামালের আমদানি শুল্ক কমানো হয়েছে বিধায় এসব পণ্যের দাম কমতে পারে।
  • ইলেকট্রিক মোটর: এ পণ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত যন্ত্রাংশ আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এ কারণে ইলেকট্রিক মোটরের দাম কমতে পারে।
  • মিথানল: ওষুধ, ওয়াশিং প্ল্যান্ট, পেইন্ট প্রভৃতি শিল্পের অন্যতম কাঁচামাল হচ্ছে মিথানল। শতভাগ আমদানিনির্ভর এ পণ্যটি বাল্ক আকারে আমদানি করলে শুল্কহার ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে পাঁচ শতাংশ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *