:: নাগরিক বিনোদন ::
সোনালি দিনের সাড়াজাগানো চিত্রনায়িকা সুনেত্রা মারা গেছেন। গত ২০ এপ্রিল ভারতের কলকাতায় শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন নব্বই দশকের জনপ্রিয় এই অভিনেত্রী। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৫৩ বছর। কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি।
আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে নব্বইয়ের দশকে বড় পর্দায় মায়াবী চোখের সুনয়না সুনেত্রা সুপারহিট বহু সিনেমার নায়িকা ছিলেন।
সুনেত্রার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খান। নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুকে দেওয়া একটি স্ট্যাটাসে অভিনেতা জায়েদ খান লিখেছেন, ‘একসময়ের জনপ্রিয় নায়িকা, শৈশবের আমার পছন্দের একজন নায়িকা, চোখের প্রেমে পড়ত যে কেউ, তিনি সুনেত্রা। অনেক দিন আগেই বাংলাদেশ ছেড়ে কলকাতায় গিয়েছেন।’
‘আমি চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক থাকাকালীন কয়েকবার ফোনে কথা বলেছিলাম। আজকে হঠাৎ শুনলাম তিনি আর নেই, মৃত্যুবরণ করেছেন। নীরবে নিভৃতে চলে গেলেন। এভাবেই হারিয়ে যায় মানুষ, চলে যায়। আপনি ভালো থাকবেন ওপারে। অনেক চলচ্চিত্র দেখব আর আপনাকে মিস করব।’ যোগাযোগ করার হলে প্রথম আলোকে তিনি জানান, খবরটি নিশ্চিত করেছেন অভিনেত্রীর ভাই। কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে চিত্রনায়িকা মারা গেছেন।
আশি-নব্বইয়ের দশকে বড় পর্দার সাড়া জাগানো অভিনেত্রী সুনেত্রার মৃত্যুর খবরে খুব কষ্ট পেয়েছেন অঞ্জনা। মনের কষ্ট থেকে বলেছেন, চলচ্চিত্রের নোংরা রাজনীতির শিকার হয়েছিলেন সুনেত্রা।
ফেসবুক পোস্টে অঞ্জনা উল্লেখ করেছেন, ‘সুনেত্রা আমাদের মাঝে আর বেঁচে নেই শুনে এতটা কষ্ট পেলাম, যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। অশ্রুসিক্ত নয়নে বারবার সেই মায়ামাখা মিষ্টি হাসির অপরূপ চেহারাটা চোখে ভাসছে। আশির দশকে আমাদের বাংলা চলচ্চিত্রের অসংখ্য সুপারহিট ব্যবসাসফল চলচ্চিত্রের গুণী চিত্রনায়িকা সুনেত্রা। কিংবদন্তি চিত্রনায়কদের সাথে সে অনেক ভালো মানের, মনে রাখার মতো চলচ্চিত্র উপহার দিয়েছে। নায়করাজ রাজ্জাক, আলমগীর, সোহেল রানা, ফারুক, জাফর ইকবাল, জসীম, ইলিয়াস কাঞ্চন, উজ্জ্বল, ওয়াসিম, মাহমুদ কলি, জাভেদ, রুবেল ও মান্নার সাথে রয়েছে তার অভিনীত অনেক চলচ্চিত্র। কিন্তু তারপরও একরাশ কষ্ট নিয়ে সে এক সময় কলকাতায় পাড়ি জমায়। সেখানেও সে কিছুসংখ্যক চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পর একসময় লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যায়। আর কখনোই কারও সামনে আসেনি।’
অঞ্জনা তাঁর লেখায় মনে করছেন, অনেক কষ্ট নিয়ে মারা গেছেন সুনেত্রা। আর এই কষ্ট অনেক না পাওয়া থেকে।
অঞ্জনা বললেন, ‘একবুক কষ্ট নিয়ে, অনেক পাওয়া-না পাওয়ার বেদনায় জর্জরিত হয়ে বড্ড অভিমান করে সে পরপারে পাড়ি দিয়েছে। তোমার অন্তিমযাত্রা শান্তির হোক বোন। আমাদের ক্ষমা করে দিয়ো, আমরা তোমার সঠিক মূল্যায়ন করতে পারিনি। অনেক ভালো রুচিসম্মত চলচ্চিত্র তুমি আমাদের উপহার দেওয়ার পরও তোমাকে দিতে পারিনি জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় কোনো সম্মান। গুণীরা এভাবেই অনেক চাপা অভিমান নিয়ে চলে যায় না ফেরার দেশে। আমরা ব্যর্থ তোমার মতো অনেক গুণী শিল্পীকে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার আমরা সঠিক সময়ে দিতে পারিনি বলে, মেধার মূল্যায়ন করতে পারিনি বলে। চলচ্চিত্রের নোংরা রাজনীতির শিকার হয়েছিল সুনেত্রা। এই নোংরা রাজনীতির কারণে আশির দশকে সুনেত্রার মতো অনেক গুণী শিল্পী জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার থেকেও বঞ্চিত হয়েছেন। তখনকার সময় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের জুরিবোর্ডে থেকেও যাঁরা সুনেত্রার মতো এমন প্রতিভাময়ী গুণী শিল্পীদের প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত করেছেন, সকলের প্রতি আমি ধিক্কার জানাই।’
সুনেত্রা মূলত ওপার বাংলার অভিনেত্রী। যদিও ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের বহু সিনেমায় অভিনয় করেছেন তিনি। ১৯৭০ সালের ৭ জুলাই সুনেত্রা জন্মগ্রহণ করেন কলকাতার এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারে। পারিবারিক নাম তার রিনা সুনেত্রা কুমার। দুই ভাইবোনের মধ্যে সুনেত্রা ছোট। তিনি মাধ্যমিক শেষ করেছিলেন কলকাতার গখলে মেমোরিয়াল গার্লস হাই স্কুলে। পরবর্তীতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি প্রাণিবিদ্যায় মাস্টার্স ডিগ্রি নেন। ছোটবেলা থেকেই সংস্কৃতি চর্চার প্রতি মনযোগী ছিলেন তিনি। নাচ, গান ও অভিনয়ে নিজেকে তৈরি করেছিলেন।
সুনেত্রাকে বাংলাদেশি সিনেমায় নিয়ে আসেন পরিচালক মমতাজ আলী। ১৯৮৫ সালে মুক্তি পাওয়া ‘উসিলা’ সিনেমাতে সে সময়ের হার্টথ্রব নায়ক জাফর ইকবালের বিপরীতে মাত্র ১৫ বছর বয়সে অভিষিক্ত হন তিনি। মূলত ১৯৯০ সালে দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর ‘পালকি’ ছবির মাধ্যমেই প্রথম জনপ্রিয়তা এবং দর্শকমহলে পরিচিতি পান সুনেত্রা। তার অভিনয় চলাকালীন সময়ের জনপ্রিয় অভিনেতা চিত্রনায়ক জসীম, সোহেল রানা, ফারুক, জাফর ইকবাল, ইলিয়াস কাঞ্চন, মান্নাসহ আরও অনেকের সঙ্গেই অভিনয় করে দর্শকের পছন্দের তালিকায় স্থান করে নেন গুণী এই অভিনেত্রী।
তাঁর দর্শকপ্রিয় সিনেমাগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘বোনের মতো বোন’, ‘যোগাযোগ’, ‘ভুল বিচার’, ‘সাজানো বাগান’, ‘রাজামিস্ত্রি’, ‘ঘর ভাঙ্গা ঘর’, ‘কুঁচবরণ কন্যা মেঘবরণ কেশ’, ‘শুকতারা’, ‘সুখের স্বপ্ন’, ‘রাজা জনি’, ‘বাদশা ভাই’, ‘ছোবল’, ‘ভাই আমার ভাই’, ‘দুঃখিনী মা’, ‘বন্ধু আমার’, ‘বিধান’, ‘নাচে নাগিন’, ‘সর্পরাণী’, ‘বিক্রম’, ‘উসিলা’, ‘লায়লা আমার লায়লা’, ‘শিমুল পারুল’, ‘ভাবীর সংসার’, ‘আমার সংসার’, ‘ধনরত্ন’, ‘নির্দয়’, ‘উচিত শিক্ষা’, ‘ঘরের সুখ’, ‘সাধনা’ ও ‘আলাল দুলাল’।