সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থ ৬8 শতাংশ কমেছে

:: নাগরিক নিউজ ডেস্ক ::

সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় জমাকৃত অর্থ বাংলাদেশি আমানতকারীরা এক বছরে তুলে নিয়েছেন ৪৯৫ কোটি ২৬ লাখ ৯১ হাজার টাকা। তুলে নেওয়া এই অর্থের পরিমাণ মোট আমানতের প্রায় ৬৮ শতাংশ। 

বৃহস্পতিবার (২০ জুন) সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া গেছে। 

বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ সাল শেষে বাংলাদেশিদের মোট আমানত কমে দাঁড়িয়েছে ১৭ দশমিক ৭১৩ মিলিয়ন সুইস ফ্রাঁ অথবা ২৩৩ কোটি ৫৮ লাখ ৪৬ হাজার টাকা (প্রতি ১ সুইস ফ্রাঁর বিনিময় হার ১৩১ টাকা ৮৭ পয়সা হিসাবে)।

বাংলাদেশে সুইস ফ্রাঁর খুব বেশি লেনদেন হয় না। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রতি ফ্রাঁর বিনিময় মূল্য প্রায় ১৩২ টাকা। সেই হিসাবে সুইস ব্যাংকে ২০২৩ সালের শেষে বাংলাদেশিদের যে ১ কোটি ৭৭ লাখ ফ্রাঁ জমা ছিল, তার মূল্য দেশীয় মুদ্রায় প্রায় ২৩৪ কোটি টাকার মতো হয়। ২০২২ সালে এই পরিমাণ ছিল প্রায় ৭৩০ কোটি টাকা।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, দুই বছর ধরে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেছে। সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থ কমে যাওয়ার একাধিক কারণের কথা বলছেন স্থানীয় অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা মনে করেন, সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে জমা হয়।

সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন দেশ থেকে জমা হওয়া এসব অর্থ সে দেশের দায় হিসাবে আর্থিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে ডলার–সংকটসহ অর্থনৈতিক সংকটে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা অনেক কমে গেছে। এ কারণে দেশটির ব্যাংকে বাংলাদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জমা অর্থ যেমন উত্তোলিত হয়েছে, তেমনি নতুন করে জমা অর্থেও টানা পড়েছে। পাশাপাশি সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে অর্থ জমার ক্ষেত্রে আগে যে গোপনীয়তা দেশটি রক্ষা করত, এখন আর সেটি নেই।

আন্তর্জাতিক নানা চুক্তির কারণে এখন সুইজারল্যান্ড বিভিন্ন দেশের সরকারের চাহিদা অনুযায়ী তথ্য সরবরাহ করে। এ কারণে যাঁরা পাচারের অর্থ আগে দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকে জমা রাখতেন, তাঁরা এখন আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। সুইজারল্যান্ডের বাইরে এখন পাচারের অর্থ গোপন রাখার সুবিধা অন্য অনেক দেশে পাওয়া যাচ্ছে। সেসব দেশেই এখন পাচারের অর্থের বড় অংশ চলে যাচ্ছে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ দেশের বাণিজ্যিক অনেক ব্যাংকও বৈধ অর্থ জমা রাখে। সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সংকটের কারণে হয়তো বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তাদের জমা অর্থ তুলে নিয়েছে। এ কারণে গত বছর দেশটির ব্যাংকে জমা বাংলাদেশিদের অর্থ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে। তার মানে এই নয়, দেশ থেকে অর্থ পাচার কমেছে; বরং দেশ থেকে অর্থ পাচার আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, সুইজারল্যান্ড যেহেতু এখন পাচার হওয়া অর্থের তথ্য সরবরাহের আন্তর্জাতিক চুক্তির আওতায় এসেছে, তাই পাচারকারীরা তাদের গন্তব্য বদলেছে। এখন দুবাই, পানামাসহ বিশ্বের অন্য অনেক দেশ ও আইল্যান্ড আছে, যেখানে এখন পাচারের অর্থ বেশি যাচ্ছে। কারণ, তারা পাচারের অর্থের গোপণীয়তা রক্ষা করে।

এসএনবির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৯৬ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ২৮ বছরে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে বাংলাদেশিদের সবচেয়ে কম অর্থ ছিল গত বছর। আর সর্বোচ্চ ৮৭ কোটি ফ্রাঁ ছিল ২০২১ সালে।

ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সুইস ব্যাংকে জমা অর্থের পুরোটাই যে অবৈধ বা পাচারের অর্থ, তা–ও নয়। কারণ, বৈধভাবেই প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিপর্যায়ের অনেকে দেশটিতে অর্থ জমা রাখেন।

গত বছর বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার কারণে সৃষ্ট মূল্যস্ফীতির চাপ সামলাতে অনিবাসী বাংলাদেশিরা তাদের জমানো অর্থ তুলে নিয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

২০২১ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের সর্বোচ্চ ৮৭১ মিলিয়ন সুইস ফ্রাঁ জমা ছিল। যার বিনিময় মূল্য দাঁড়ায় ১১ হাজার ৪৮৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা।

২০২০ সালে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ তার আগের বছরের তুলনায় কম ছিল। ওই বছর সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ ছিল ৫৬ কোটি ৩০ লাখ সুইস ফ্রাঁ; যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৫ হাজার ২০৩ কোটি টাকার বেশি।

২০১৯ সালে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা করা অর্থের পরিমাণ ছিল ৬০ কোটি ৩০ লাখ ফ্রাঁ। ২০১৮ সালে এই অর্থের পরিমাণ ছিল ৬২ কোটি সুইস ফ্রাঁ। আর ২০১৭ সালে এর পরিমাণ ছিল ৬৬ কোটি ১৯ লাখ সুইস ফ্রাঁ।

এদিকে, বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও নাগরিকের সুইস ব্যাংকে অর্থ আমানতের হার ২০২৩ সালে প্রায় ৭০ শতাংশ কমেছে। গত চার বছরের মধ্যে ভারতীয়দের আমানতের পরিমাণ সর্বনিম্নে পৌঁছেছে ২০২৩ সালে।

তবে সুইস ব্যাংকে বিদেশি গ্রাহকদের অর্থ জমার তালিকায় শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাজ্য। সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে ব্রিটিশ নাগরিকদের ২৫৪ বিলিয়ন সুইস ফ্রাঁ রয়েছে। এরপরই ৭১ বিলিয়ন সুইস ফ্রাঁ নিয়ে তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

আর ফ্রান্স রয়েছে এই তালিকার তৃতীয় স্থানে। সুইস ব্যাংকে দেশটির নাগরিকদের প্রায় ৬৪ বিলিয়ন ফ্রাঁ রয়েছে। ওই তিন দেশের পর শীর্ষ দশ দেশের তালিকায় আছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, জার্মানি, হংকং, সিঙ্গাপুর, লুক্সেমবার্গ এবং গার্নসি।

আমানত হ্রাস পাওয়ার পরও সুইস ব্যাংকে ভারতীয়দের অর্থের পরিমাণ ১ দশমিক ০৪ বিলিয়ন সুইস ফ্রাঁতে দাঁড়িয়েছে; যা ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৯ হাজার ৭৭১ কোটি রুপি। এ নিয়ে সুইস ব্যাংকে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ও নাগরিকদের আমানত টানা দ্বিতীয়বারের মতো কমেছে।

সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের ‘মোট দায়ের’ মধ্যে ব্যক্তিগত, ব্যাংক এবং অন্যান্য উদ্যোগের আমানতসহ সব ধরনের তহবিল অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের হাজার হাজার মানুষ সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বৈধ-অবৈধ পথে উপার্জিত অর্থ গচ্ছিত রাখেন। দেশটির কঠোর গোপনীয় ব্যাংকিং নীতির কারণে সারা দুনিয়ার মানুষ সেখানে অর্থ জমা রাখেন।

সুইজারল্যান্ডের আইনে গ্রাহকদের গোপনীয়তা দৃঢ়ভাবে রক্ষার নিয়ম রয়েছে। এ আইনের ফলে দেশটির ব্যাংকগুলো কোনো পরিস্থিতিতেই গ্রাহকদের তথ্য কারও কাছে প্রকাশে বাধ্য নয়।

ফলে কারা, কেন অথবা কীভাবে অর্থ ব্যাংকে রাখছেন, সে সম্পর্কে ব্যাংকগুলো কাউকে কোনো তথ্য দেয় না। তবে সম্প্রতি গোপনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় ও সমালোচনা দেখা দেওয়ায় অনেকে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংক থেকে বিশ্বের অন্যান্য দেশে তাদের অর্থ সরিয়ে নিচ্ছেন।

প্রায় এক দশক ধরে ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশির আমানত বৃদ্ধির পর হুট করে তা কমছে কেন, এর ব্যাখ্যা নেই ওই প্রতিবেদনে।

ধারণা করা হচ্ছে, সুইজারল্যান্ডে গোপনীয়তা কমতে থাকায় বাংলাদেশিসহ অনেক দেশের ধনীরাই এখন অবৈধ টাকা জমা রাখার জন্য কানাডা, দুবাই, লুক্সেমবার্গ, কেম্যান আইল্যান্ড, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড কিংবা বারমুডার মতো ট্যাক্স হ্যাভেন দেশগুলোর দিকে ঝুঁকছেন।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *